কখনো কখনো একটিমাত্র ছবিই সহস্র শব্দের আবেদনকে প্রকাশ করে। কখনো একটিমাত্র ছবিই হয়ে ওঠে সামগ্রিক ঘটনার প্রতিপাদ্য। ছবিকে ক্যামেরায় বন্দী করার প্রতি যাদের রয়েছে সীমাহীন ভালোবাসা, কঠোর পরিশ্রমের বাঁধভাঙা ইচ্ছাশক্তি, গভীর পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতা- তারাই পারেন ছবির এমন মহাকাব্যিক দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করতে, তারাই পারেন ছবির এমন কাব্য নির্মাণ করতে। ছবি তোলা তাদের মস্তিষ্কে, অস্তিত্বে, মননে ও মেধায় বিরাজ করে। ছবি তোলা তাদের জন্য স্রেফ ছবি তোলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা, মানবতার অনুচ্চারিত হাজারও কষ্টের সুনিপুণ প্রকাশ এবং সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে নিজের সত্ত্বাকে প্রশান্তি দেওয়া।
ছবি তোলার এমন তাৎপর্যের জন্যই সাংবাদিকতায় সংযোজিত হয়েছে ‘ছবি সাংবাদিকতা’ নামের স্বতন্ত্র একটি ক্যাটাগরি বা শ্রেণী। আর এই ক্যাটাগরিতেই সাংবাদিকতার নোবেল প্রাইজ হিসাবে খ্যাত ‘পুলিৎজার প্রাইজ ২০১৮’ পেয়েছেন বাংলাদেশী ছবি সাংবাদিক মোহাম্মদ পনির হোসেন। এই প্রথম কোনো বাংলাদেশী হিসাবে পুলিৎজার পুরষ্কার পেলেন তিনি। তাকে নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
যে ছবিগুলোর জন্য পুরষ্কৃত হয়েছেন
পুলিৎজার কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ২১টি ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার ঘোষণা করে। সাংবাদিকতায় এই পুরষ্কারটি যেন নোবেল প্রাইজসম। এ বছর ‘ফিচার ফটোগ্রাফি’ ক্যাটাগরিতে বেশ কিছু ছবিকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে পুলিৎজার কর্তৃপক্ষ। ছবিগুলোর বিষয়বস্তু দুটি। একটি হলো আলোকচিত্রের মাধ্যমে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তের অধীনে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ‘পুলিশ কিলিং স্কোয়াডের’ কার্যকলাপ তুলে ধরা। আর দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা তুলে ধরা।
মূলত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এ বছর এই ক্যাটাগরিতে পুরষ্কারটি অর্জন করেছে। রয়টার্সের হয়ে যে ৭ সদস্যবিশিষ্ট ছবি সাংবাদিকের দলটি কাজ করেছে সেই দলের একজন সদস্য হলেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ পনির হোসেন। মনোনীত ছবিগুলোর মধ্যে মোহাম্মদ পনির হোসেনের রয়েছে ৩টি ছবি। দেখে নেওয়া যাক তার তোলা অনবদ্য ছবি সে ৩টি ছবি।
এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে , মাত্র ৫ সপ্তাহ বয়সী মৃত সন্তানের নিথর দেহটি বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন একজন মা। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতনের ফলে নৌকায় করে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় নৌকাডুবিতে সন্তানের মৃত্যু হয়। মা থেকে থেকে সন্তানকে দেখছেন, মুখে চুমু খাচ্ছেন আর বিলাপ করে কাঁদছেন। মৃত সন্তানের মুখে সন্তানহারা মায়ের চুমু খাওয়ার এই মুহূর্তটিকে ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছিলেন মোহাম্মদ পনির হোসেন। সেদিন তার সাথে আরেকজন আলোকচিত্রী ছিলেন। দুজনে শাহপরীর দ্বীপে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাদের সিএনজি চালক জানায়, রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা ডুবে গেছে। তখনই তারা কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং সেই হৃদয়বিদারক মুহূর্তটি ফ্রেম বন্দি করেন।
দ্বিতীয় ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে সীমান্তের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় একদল রোহিঙ্গা অসহায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি তাদের সেখানে আটকে রেখেছে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে যেন তারা না পারেন। প্রচণ্ড বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন তারা। কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন না। উদারতার আকাশও যেন বৃষ্টি ঢেলে দিয়ে তাদের সাথে শত্রুতা করছে। গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে এই ছবিটি তোলেন মোহাম্মদ পনির হোসেন। ছবিটি তোলার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ছবি তুলতে গিয়ে তার ক্যামেরার লেন্সের ভিতর পানি ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। গলা পর্যন্ত পানিতে নেমেও তাকে ছবি তুলতে হয়েছে।
তৃতীয় ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, ভেলায় ভেসে নাফ নদী পাড়ি দিচ্ছেন একদল রোহিঙ্গা। তাদের গন্তব্য বাংলাদেশের দিকে। কোথাও যদি একটু মাথা গোঁজা যায়! ভেলাটি এতগুলো মানুষের ভার বহন করতে সক্ষম নয়। তবুও জীবন রক্ষার্থে গাদাগাদি করে জীর্ণ ভেলায় ভেসে নাফ নদী পাড়ি দিচ্ছেন তারা। ছবিটি গত বছর নভেম্বরের ১২ তারিখে তোলেন মোহাম্মদ পনির হোসেন।
ছবিগুলো তোলার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পনির হোসেন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“ছবিগুলো যখন তুলি তখন আমি আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। কিন্তু হোটেলে ফিরে এডিট করতে গিয়ে ল্যাপটপে যখন ছবিগুলো দেখলাম তখন আর আমার পক্ষে আবেগ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মানুষের কষ্ট কতরকম এটা রোহিঙ্গা ইস্যু যদি কাভার না করতাম তাহলে সম্ভবত আমি বিষয়টা বুঝতাম না।”
তিনি রোহিঙ্গাদের কষ্টের কথা উল্লেখ করে বলেন,
“সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য তারা রোদে পুড়ে, পানিতে ভিজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তারা জানেন না সামনে কী আছে, তারা কোথায় যাচ্ছেন, কী খাবেন বা কোথায় থাকবেন। কতটা অসহায় হলে মানুষ এমন অনিশ্চিত যাত্রার উদ্দেশ্য রওনা দেয় সেই বিষয়টি আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে।”
ছবি তুলতে গিয়ে নানরকমের সমস্যার সম্মুখীন হন তারা। বৈরি প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটু পর্যন্ত কাদা পানিতে নেমে ছবি তুলছেন। মোহাম্মদ পনির হোসেন বলেন,
“এই ছবিগুলো তুলতে গিয়ে আমি নিজে যতই কাদার মধ্যে হাঁটি, রোদে পুড়ি বা পানিতে সাঁতার কাটি, দিন শেষে যখন একটি ভালো ছবি পাই তখন আর সেই ক্লান্তির কথা মনে থাকে না।”
তিনি মনে করেন একজন আলোকচিত্রী তার কাজের ৯০ ভাগ সময় ব্যয় করেন ছবির উপাদান নিয়ে গবেষণা করে। আর বাকি মাত্র দশ ভাগ সময় ব্যয় করেন ছবি তোলার জন্য। তিনি বলেন,
“মানুষ যখন কোনো দুর্দশায় পড়ে বা জীবনে কোনো সংকট তৈরি হয় তখনই আমাদের মতো ফটোসাংবাদিকদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়। যেমন রোগী না থাকলে ডাক্তারের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ নেই, আমাদের জন্যেও বিষয়টা একই রকম।”
শখের বশে ২০১০ সাল থেকে পনির হোসেন ছবি তুলতেন। সেই শখই এখন তার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোটবেলায় চট্টগ্রামের খাজা আজমেরি হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছেন ঢাকা সিটি কলেজ থেকে। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষ করে ফিলিপাইনের অ্যাটেনিও ডি ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিজুয়াল জার্নালিজমের ওপর উচ্চশিক্ষা নেন।
অন্যান্য ছবি
রয়টার্সের হয়ে কাজ করা দলটির অন্যান্য সদস্যরাও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বিচিত্র সব ছবি তুলেছেন। একেকটি ছবি যেন একেকটি ট্র্যাজেডি বা বিয়োগাত্মক মহাকাব্য। শরণার্থীদের নিয়ে রয়টার্সের এই ছবি সাংবাদিকের দলটির তোলা আরো কিছু ছবি দেখে নেওয়া যাক।
ছেলেটার নাম শোয়াইব। বয়স মাত্র ৭ বছর। গত বছরের আগস্টে পরিবারের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় সে দেশের সেনাবাহিনীর গুলি তার বুকে লাগে। বাবা তার আহত ছেলেকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছেন। কক্সবাজারের একটি মেডিকেল সেন্টারের সামনে থেকে এই ছবিটি তোলেন পুলিৎজার বিজয়ী ছবি সাংবাদিকের গ্রুপের সদস্য ভারতীয় আলোকচিত্রী আদনান আবিদি। ছবিটি তিনি তুলেছেন গত বছর নভেম্বরের ৫ তারিখে।
মাত্র ১১ মাসের এই শিশুটির নাম আবদুল আজিজ। প্রচণ্ড জ্বর ও ঠাণ্ডার প্রকোপে শিশুটি মারা যায়। কক্সবাজারের নিকটে বালুখালি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শিশুটির পরিবার তার মৃত দেহটিকে কম্বলে পেঁচিয়ে রেখেছেন। তার নিষ্পাপ চোখ দুটিকে পানপাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। ছবিটি তুলেছেন বসনিয়ান আলোকচিত্রী দ্যামির সাগলজ। গত বছর ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ছবিটি তোলা হয়েছে ।
ছোট ভাই ভয়ে বড় ভাইয়ের হাত ধরে রেখেছে। বড়জন যেন ছোট জনকে আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তবুও ভয়ে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে বারবার। নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে প্রাণভয়ে ছুটছে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী পার হওয়ার সময় এই হৃদয়বিদারক মূহুর্তটি ফ্রেম বন্দি করেছেন ভারতীয় ছবি সাংবাদিক আদনান আবিদি। ছবিটি গত বছর নভেম্বরের ১ তারিখে তোলা হয়েছে ।
সবুজের মাঝখানে ছোপ ছোপ পোড়া কালো দাগ। এখানেই ছিল রোহিঙ্গাদের গ্রাম। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার ছবি এটি। ছবিটি তোলা হয়েছে গত বছর সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে। ছবিটি তুলেছেন মিয়ানমারের ছবি সাংবাদিক সোই জেয়া তুন।
ফিচার ইমেজ- মোহাম্মদ পনির হোসেনের তোলা