বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি, সাথে বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া- এ সময়ে বাঙালীর ঘুমোতে যাওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির কথা মনে পড়বে সেটি কাঁথা। হতে পারে বাহারি নকশাদার কিংবা নকশা ছাড়াই। বাংলার লোকসংস্কৃতি আর গ্রামীণ কুটির শিল্পের একটি বড় জায়গা দখল করে আছে কাঁথা।
বাড়িতে সন্তান জন্ম নেওয়ার সময়ে তার জন্য নতুন কাঁথা তৈরির রেওয়াজ টিকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। বাড়িতে বিয়ে কিংবা পার্বণের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথিদের নতুন কাঁথা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার চিরাচরিত রেওয়াজ পাওয়া যায় বাংলার কোনো কোনো গ্রামে। বিয়ের পরে মেয়েকে শ্বশুরালয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় উপহারের তালিকায় থাকে নকশী কাঁথা।
বাংলায় দীর্ঘসময় ধরে চলে বর্ষাকাল। মাঠ ঘাট থৈ থৈ বর্ষায় ঘরের বাইরের কাজ কমে আসে নারীদের, একটুখানি অবসরের সন্ধান পায় তারা। বাঙালী নারীদের এই অবসর সময়ে পান আর সুপারির আড্ডায় সুঁই সুতো হাতে কাঁথা সেলাই এক চিরাচরিত অভ্যাস। গ্রামীণ সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আসার সাথে সাথে এ ধরনের সামাজিকতায়ও পরিবর্তন আসছে।
তবে এখনো গল্পে গল্পে গ্রামীণ নারীরা দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নকশী কাঁথার কাজ করে যান। অনুপম দক্ষতায় কাঁথার জমিনে ফুটে উঠে গাছ, পাখি কিংবা লতাপাতার ছবি। কোনোসময় কাঁথায় উঠে এসেছে দুঃখ আর সুখের কাহিনী, কখনো লন্ঠনের নিভু আলোয় শোনা পুঁথির গল্পই সূচ দিয়ে কাঁথায় ফুটিয়ে তুলেছেন নারীরা।
কাঁটাতারে বাংলা এফোঁড় ওফোঁড় হলেও দুই বাংলাতেই কাঁথা সেলাইয়ের ধরন আর নকশাও মিল পাওয়া যায়, কারণ বাংলা ভাগ হওয়ার অনেক আগেই এই শিল্পের জন্ম। তাই বাংলার প্রবাদে, গল্প, গানে কিংবা কবিতায় অমর হয়ে আছে নকশী কাঁথা। ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’র মতো বাগধারা যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে পল্লীকবি জসীম উদদীনের আখ্যানকাব্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’। এই আখ্যানকাব্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে উঠে এসেছে কীভাবে কাঁথায় সূচের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠতে পারে ভালোবাসা আর বেদনার কাহিনী। প্রেমিক রুপাই আর প্রেমিকা সাজুর ভালোবাসার অমর আখ্যান এই কাব্য।
অমর এক আখ্যানের নাম ‘নকশী কাঁথার মাঠ’
বিয়ের পরে রুপাই আর সাজুর ভালোবাসায় আখ্যান বেশি দূর যেতে পারেনি। ফেরারি হয়ে যায় রুপাই। স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী সাজু বাকি জীবন নকশী কাঁথা বুনতে শুরু করে, দিন-মাস-বছর যায়। সাজু নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের আচড় দিয়ে যায়, কাঁথায় লেখে কত গল্প, রুপাই ফিরে আসে না। সারা জীবন সাজুর এভাবেই কেটে যায়। সাজুর নকশী কাঁথা বোনা যেদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন সে মাকে অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পর যেন তার কবরের উপরে নকশী কাঁথাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। বহুদিন পরে নকশী কাঁথার নিচে শুয়ে থাকা সাজুর কবরের পাশে ভিনদেশী বংশীবাদকের মরদেহ পাওয়া যায়।
“কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।”(‘নকশী কাঁথার মাঠ’; জসীম উদদীন)
এভাবেই বাংলার নারীরা স্বামী কিংবা প্রেমিকের বিরহেও নকশী কাঁথা বুনেছে, প্রবাসে কিংবা বিদেশ বিভূঁইয়ে আত্মীয় স্বজন কিংবা পরিবার পরিজনের স্মৃতি কাঁথার জমিনে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে। কেউ হয়তো স্বজনের কাছে নতুন কাঁথা তুলে দিতে পেরেছে, কেউ রুপাই-সাজুর মতো পারেনি।
কাঁথার ভেতরে বাইরে
কাঁথার প্রচলন দুই বাংলা জুড়েই আছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনাসহ সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জেই ছিটিয়ে আছে কাঁথা বানানোর সংস্কৃতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহারেও দেখা যায় বৈচিত্রপূর্ণ কাঁথার সমাহার। বিহারের ‘সুজনী’ কাঁথার আছে আন্তর্জাতিক মহলে ‘ভৌগলিক স্বীকৃতি’। যদিও একই নামে এবং প্রায় একই ধরনের কাঁথা বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলেও প্রচলিত আছে।
খানিকটা ছিড়ে যাওয়া, পুরাতন হয়ে যাওয়া শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি কিংবা চাদরকেই সাধারণত কাঁথা বানানোতে কাজে লাগানো হয়, তবে কাঁথা বানাতে শাড়ির আছে আলাদা কদর। প্রথমে পুরাতন কাপড়কে ধুয়ে, এতে মাড় (ভাত রান্নার সময় অবশিষ্ট তরল) দেওয়া হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। পুরুত্বের দিক থেকে ক্ষেত্রবিশেষে একটি কাঁথায় তিনটি থেকে সাতটি শাড়িও ব্যবহার করা হয়।
নকশী কাঁথা ছাড়াও গ্রামে গঞ্জে সাধারণ সেলাই করা কাঁথা দেখা যায়। সেখানে নকশার বাহাদুরী নেই, প্রয়োজনটাই মুখ্য সেখানে। সেলাইয়ের পর সেলাই করে সেখানে পুরাতন কাপড়গুলোকে একত্র করে কাঁথা বানানো হয়। কাঁথার চারদিক ঘিরে মজবুত সেলাই দেওয়া হয় যাতে সহজে ছিড়ে না যায়। শীত নিবারণের জন্য সেলাই করা কাঁথা বেশ পুরো আর মোটা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী এবং চাপাই নবাবগঞ্জ এলাকায় তৈরিকৃত কাঁথা বেশ মোটা হয়। শীত নিবারণের জন্য আমাদের দেশীয় লেপ কিংবা কম্বলের পাশাপাশি কাঁথার আলাদা সমাদর আছে।
নকশী কাঁথার নকশা
তবে কাঁথায় হরহামেশা নকশা দেখা যায়, অনেকেই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ফুল, পাখি, লতাপাতা আঁকেন। পারিবারিকভাবে মা কিংবা দাদীর করা নকশার অনুকরণ করেন অনেকেই। গল্প, লোককথা, গ্রামীণ পুঁথির চরিত্র কিংবা ধর্মীয় চরিত্র আর অনুশাসন কাঁথার নকশায় আনে বৈচিত্র্য। কাঁথার পাশাপাশি নামাজের জন্য নির্মিত নকশী জায়নামাজ কিংবা কোরআন রাখার গিলাফে দেখা যায় চাঁদ তারা, ধর্মীয় গ্রন্থের লাইন, মসজিদ কিংবা মিনারের ছবি।
তবে এমন অনেক নকশাই আছে যা বাংলার মাঠে প্রান্তরে ঘরে ঘরে হাজার বছর ধরে জড়িয়ে আছে। এর দার্শনিক উৎস ভারতীয় হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা ইসলাম ধর্মে পাওয়া যায়। তবে সব ক্ষেত্রে নকশাকাররা সেই দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা চিহ্নের গুরুত্বের দিকে নজর দিয়েই নকশা আঁকেন ব্যাপারটি মোটেও এমন নয়। অনেকক্ষেত্রেই নকশাটি সুন্দর বলে পারিবারিকভাবে ছড়িয়ে যায়, আবার নকশা সংরক্ষণে ছোট রুমালের আকারের কাপড়ে সেই নকশার ছাঁচটি তুলে রাখা হয়। ফলশ্রুতিতে পরবর্তী প্রজন্ম সেই নকশা দেখে সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে, কখনো পরের প্রজন্ম থেকে নতুন করে উপাদান যুক্ত হয়ে সমৃদ্ধও হয় সেই নকশা।
এমনই একটি বিখ্যাত নকশা হচ্ছে একটি বৃত্তকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা পদ্ম কিংবা চাকা। বৃত্তকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে থাকা এই নকশা শুধু কাঁথা কিংবা রুমালেই নয় সারা ভারতের স্থাপত্যকলাতেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নকশী কাঁথাও একটি বৃত্তকে কেন্দ্র করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া নকশা দেখা যায় হরহামেশাই। এছাড়া পদ্মফুল এবং চাকার নকশাও চোখে পড়ে কাঁথায়।
লতাপাতা
ভারতীয় হস্তশিল্প এবং কুটিরশিল্পগুলোতে গাছ আর লতাপাতার নকশা এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। কাঁথা, রুমাল আর শীতল পাটিতে এই গাছের নকশা ঘুরেফিরে বিভিন্নভাবে এসেছে। কোনো কাঁথায় আবার ফুটে উঠেছে মানুষের পাশাপাশি ঘোড়া, ময়ুর কিংবা অন্যান্য প্রাণীর ছবি। কিছু কাঁথায় দেখা যায় নকশার সাথে নকশাকারী তার কিংবা তার প্রিয়জনের নাম কিংবা আদ্যক্ষর যুক্ত করে দেওয়ার মতো ঘটনাও দেখা যায়।
কাঁথার নকশার এই বৈচিত্র্যের কারণে একে ধরাবাধা ছকে ফেলা কিংবা সেই নকশার দার্শনিক উৎস খোঁজাও দুঃসাধ্য ব্যাপার। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই শিল্পে যত দিন গিয়েছে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। নকশী কাঁথার নকশা শুধু কাঁথার মধ্যেই থেমে থাকেনি, গাছ-লতা-পাতা কিংবা ফুল-পাখি সম্বলিত যে নকশা কাঁথায় দেখা যায় প্রায় একই ধরনের নকশা দেখা যায় টেবিলক্লথ, রুমাল, টুপি , বালিশ কিংবা বিছানার চাঁদরে।
কতদিন সময় লাগে?
নকশী কাঁথা সাধারণত একদিনে তৈরি হয় না, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এতে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এটি একসময়ে বাংলার নারীদের অবসরের অনুষঙ্গ ছিল। পূজা, পার্বণ কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়ার নজিরও পাওয়া যায়। মাঝারি আকারের কাঁথা তৈরিতে সাত থেকে পনের দিন সময় লেগে যায়। বড় কাঁথা এবং জটিল নকশা করতে এক মাসেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্য
পুরাতন কাপড়কে জোড়া দিয়ে এর জমিনে কারুকার্য করে নতু্নের মতোই করে তোলা যায় বলে মধ্যবিত্ত থেকে গরীব সবার কাছেই ছিল এর কদর। তবে আধুনিক সমাজে উচ্চবিত্তের কাছে এর অর্থনৈতিক মূল্য নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়েছে।
দীর্ঘসময় ধনীর চোখে কাঁথা ছিল গরীব আর মধ্যবিত্তের শীত নিবারণের বস্তু। বাংলার উচ্চবিত্ত সমাজে প্রয়োজনের খাতিরে ফরমায়েশে নকশী কাঁথা বানিয়ে নেওয়ার প্রচলন ছিল।
তবে সময়ের সাথে নকশী কাঁথার জমিনে যে নিপুণ কারুকার্য করা হয় তার একটি সাংস্কৃতিক আবেদন তৈরি হয়েছে, ফলে এর অর্থমূল্য বেড়েছে। এই আবেদন থেকেই নকশী কাঁথাকে কুটির শিল্প হিসেবে দাঁড় করানোর প্রবল সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। নকশী কাঁথার পেশাদার কারিগর বলতে এক সময়ে কাউকে পাওয়া যেত না, কারণ এই শিল্পটি নিতান্তই শখের বশে আর প্রয়োজনের খাতিরে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে কাঁথাও হারিয়ে যেতে বসেছিল। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নকশী কাঁথার মহামূল্যবান নকশাও ছিল ঝুঁকিতে। তবে বর্তমান বাংলাদেশ আর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এই নকশী কাঁথার বুননকে কুটির শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
নকশী কাঁথার নকশা শুধু কাঁথার জমিনে সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তোলা নকশাই নয়, একেকটি নকশী কাঁথার জমিনে লুকিয়ে থাকে গল্প, কখনো ভালোবাসার, কখনো দুঃখের। বাংলার পথে প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া গল্পকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একেকটি নকশী কাঁথা।