বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মসজিদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে এদের মধ্যে অল্পসংখ্যক মসজিদই আছে, যেগুলো ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি তাদের নির্মাণ এবং স্থাপত্যশেলীর মাধ্যমে নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর। এদের কোনোটি ঐতিহাসিক কারণেই বিখ্যাত, আবার কোনোটি অত্যাধুনিক নকশা এবং নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে আলোচিত। গত বছর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পক্ষ থেকে অসাধারণ সুন্দর মসজিদগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। চলুন দেখে নিই সেই তালিকায় স্থান পাওয়া মসজিদগুলোর ছবি এবং সেই সাথে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
সুলতান আহমেদ মসজিদ, ইস্তাম্বুল
সুলতান আহমেদ মসজিদ তুরস্কের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। উসমানীয় সুলতান প্রথম আহমেদ ১৬১৬ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির অভ্যন্তরের দেয়ালগুলোতে নীল রঙের টাইলস থাকায় এটি ব্লু মস্ক নামেও পরিচিত। মসজিদটিতে পাঁচটি প্রধান গম্বুজ, ছয়টি মিনার এবং আটটি মধ্যম আকৃতির গম্বুজ আছে। মসজিদটির অবস্থান ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া গির্জার ঠিক পাশেই। হাজিয়া সোফিয়ার মতোই এটিও পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। মসজিদটিতে একসাথে ১০,০০০ মুসল্লী নামায আদায় করতে পারে। ইউনেস্কো মসজিদটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
নাসির আল মুলক মসজিদ, ইরান
১৮৮৮ সালে নির্মিত নাসির আল মুলক মসজিদটির অবস্থান ইরানের পঞ্চম বৃহত্তম শহর শিরাজে। ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি এর রঙিন কাঁচের জানালাগুলোর জন্য বিখ্যাত। বাইরে থেকে মসজিদটিকে দেখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও এর ভেতরের কারুকার্য মানুষকে মুগ্ধ করে। রঙ্গিন জানালা দিয়ে আলো এসে মসজিদের ভেতরে অবস্থিত দেয়াল পার্সিয়ান কার্পেটগুলোর উপর বিচিত্র বর্ণিল নকশা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারনা করে। মেঝেতে গোলাপী রঙের টাইলস থাকার কারণে মসজিদটি স্থানীয়ভাবে পিঙ্ক মসজিদ নামেও পরিচিত।
ইসতিকলাল মসজিদ, জাকার্তা
আরবি ইসতিকলাল শব্দটির অর্থ স্বাধীনতা। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অবস্থিত ইসতিকলাল মসজিদটি নির্মিত হয়েছে দেশটির স্বাধীনতার স্মরণে। ১৯৭৮ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া মসজিদটি দেশটির জাতীয় মসজিদ। ২ লাখ মুসল্লী ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট মসজিদটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। নির্মাণকালীন সময়ে এটি ছিল ধারণ ক্ষমতার দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম এবং মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সুন্নী মসজিদ। এর মিনারটির উচ্চতা ১০০ মিটার। ইন্দোনেশিয়ার মসজিদগুলো সাধারণত তিন স্তরের ছাদ বিশিষ্ট হলেও এই মসজিদটির নকশা করা হয়েছে আরবের স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে।
জামে মসজিদ, দিল্লী
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সময় নির্মিত দিল্লীর জামে মসজিদটি ভারতের সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোর একটি। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি ভারতবর্ষের রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় রাজধানীর প্রধান মসজিদ হিসেবে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় ১৬৫৬ সালে। ২৫ হাজার মুসল্লী ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করতে তৎকালীন সময়ে খরচ হয়েছিল প্রায় ১০ লাখ রুপি। লাল বেলেপাথর এবং মার্বেল পাথরে তৈরি মসজিদটি মুঘল সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকলার নিদর্শন বহন করছে।
শেখ জায়েদ মসজিদ, আবুধাবি
আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে অবস্থিত শেখ জায়েদ মসজিদটি দেশটির সবেচয়ে বড় মসজিদ। ১২ হেক্টর জমির উপর অবস্থিত এ মসজিদ কমপ্লেক্সটিতে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও আছে। ৫৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে নির্মিত মসজিদটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা মূল্যবান পাথর, ঝাড়বাতি এবং কার্পেট ব্যবহার করা হয়েছে। এর ৫,৬২৭ বর্গ মিটার ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কার্পেটটিকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্পেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৪০,০০০ মুসল্লী ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট মসজিদটির উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে পরপর দুবার মসজিদটি ট্রিপ অ্যাডভাইজর ভ্রমণকারীদের দ্বিতীয় পছন্দের স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
সুলতান হাসান মসজিদ, কায়রো
মামলুক সুলতানদের সময়ে ১৩৫৯ সালে নির্মিত সুলতান হাসান মসজিদটিতে একই সাথে মাদ্রাসাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। মিসরের কায়রোর ওল্ড সিটিতে অবস্থিত এ মসজিদটি নির্মাণকালীন সময়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদগুলোর একটি ছিল। মসজিদটির চার কোণে অবস্থিত চারটি মাদ্রাসায় ইসলামের চারটি মাযহাবের উপর শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মসজিদটির দেয়ালগুলোর উচ্চতা ৩২ মিটার।
শাহ মসজিদ, ইসফাহান
ইরানের ইসফাহানে অবস্থিত শাহ মসজিদ বা ইমাম মসজিদ ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। সাফাভিদ সাম্রাজ্যের শাহ আব্বাসের শাসনামলে ১৬২৯ সালে নির্মিত এ মসজিদটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসবে মর্যাদা পেয়েছে। মসজিদটি এর সাতরঙা মোজাইক টাইলস এবং দেয়ালে খচিত ক্যালিগ্রাফিক নকশার জন্য সুপরিচিত। একে পারস্যের ইসলামিক স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ন্যাশনাল মসজিদ, কুয়ালালামপুর
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অবস্থিত নেগারা মসজিদ বা ন্যাশনাল মসজিদ হচ্ছে দেশটির জাতীয় মসজিদ। ১৯৬৫ সালে নির্মিত মসজিদটির অবস্থান প্রায় ১৩ একর আয়তনের বাগানের মধ্যে। এর মুসল্লী ধারণক্ষমতা ১৫,০০০। মসজিদটির গম্বুজ তারকাকৃতির, যার ১৮টি চূড়া রয়েছে। ১৮ সংখ্যাটি দ্বারা মালয়েশিয়ার ১৩টি অঙ্গরাজ্য এবং ইসলামের ৫টি খুঁটির প্রতিনিধিত্ব করা হয়। এর মিনারটির উচ্চতা ৭৩ মিটার।
এডুকেশন সিটি মসজিদ, দোহা
কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত এডুকেশন সিটি মসজিদকে বলা হয় সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক স্থাপত্যের তৈরি মসজিদ। ২০১৫ সালে নির্মিত মসজিদটিতে একসাথে ১,৮০০ মুসল্লী নামায আদায় করতে পারে। সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী নকশায় তৈরি মসজিদটি পাঁচটি কলামের উপর অবস্থিত, যা ইসলামের পাঁচটি ভিত্তিকে নির্দেশ করে। এছাড়াও মসজিদটির চারপাশে অবস্থিত বাগানের মধ্য দিয়ে চারটি ঝর্ণা প্রবাহিত হয়, যা পানি, মধু, দুধ এবং শরাবকে প্রতিনিধিত্ব করে। মসজিদটির মিনার দুটি ৯০ মিটার উঁচু এবং কাবা শরিফের দিকে হেলে আছে। মসজিদটির বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে কুরআন শরিফের আয়াত খোদাই করা আছে।
হাসান আল-থানি মসজিদ, ক্যাসাব্লাঙ্কা
মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় অবস্থিত হাসান আল-থানি বা দ্বিতীয় হাসান মসজিদ হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার বিশিষ্ট ধর্মীয় স্থাপনা। এর মিনারটির উচ্চতা ২১০ মিটার। ১৯৯৩ সালে নির্মিত মসজিদটির মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার। এর মিনারের চূড়ায় একটি লেজার বিম অবস্থিত, যা থেকে কাবা ঘরের দিক বরাবর সর্বদা একগুচ্ছ আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। মসজিদটির অবস্থান মুসলিম বিশ্বের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে, ঠিক আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে। মসজিদটির অংশবিশেষ সমুদ্রের পানিতে ভাসমান। এই মসজিদটি নিয়ে আমাদের একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ আছে, পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।
ফিচার ইমেজ- islamicity.org