পপ সঙ্গীতের সাড়া জাগানো শিল্পীগোষ্ঠী ‘অ্যাবা’

“Chiquitita, tell me what’s wrong
You’re enchained by your own sorrow
In your eyes there is no hope for tomorrow
How I hate to see you like this
There is no way you can deny it
I can see that you’re oh so sad, so quie”

সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো এই গানটি শোনেননি, এমন সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতা খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুস্কর। শুধু কি এই গান? ‘মাম্মা মিয়া’, ‘ওয়াটার লু’, ‘চিকিচিতা’, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, ‘টেক ইট ইজি’, ‘এসওএস’- কোনটা রেখে কোনটা বলবেন! প্রতিটি গানই আজও সারা বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমীদের মাতিয়ে রাখে। এই গানগুলো দিয়ে যে চার তরুণ-তরুণী সেসময় মাতিয়েছিলেন গোটা বিশ্ব, তারা আর কেউ নয়, সুইডেনের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল ‘অ্যাবা’। ‘অ্যাবা’ শুধু একটা গানের দল নয়, একটা স্বপ্নীল সময়। তাদের সুর মূর্চ্ছনায় ​​বিশ্ব হয়েছে মাতাল। ষাটের দশকে বিটলসের ছোকরা চতুষ্টয়ের পর সত্তরে এসে এরাই সবচেয়ে নাম করেছিলেন বিশ্বব্যাপী, এ কথা কে না জানে।

সুইডেনের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল ‘অ্যাবা’

১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল নাগাদ মাত্র এক দশকের পথচলায় অ্যাবা’র বিলিয়ন ডলারের উপরে ব্যবসায়িক সফলতা বিশ্বের আর কোনো পপ সঙ্গীত দলের নেই। তেমনি আজও দলটির ইংরেজি অ্যালবাম ‘অ্যাবা গোল্ড’ কিংবা ইউরোপের স্পেন থেকে দক্ষিণ আমেরিকার সকল স্প্যানিশভাষীদের জন্য ‘অ্যাবা ওরো’ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের কাছে এখনো অমলিন। কিভাবে তৈরি হলো অ্যাবা শিল্পীগোষ্ঠী? কেনই বা বিরাশির পর এই দল হারিয়ে গেল? তাদের সেই উত্থান-পতনের কাহিনী নিয়ে আজকের এই লেখা।

ইংরেজি অ্যালবাম ‘অ্যাবা গোল্ড’ এর সেসব গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের কাছে এখনো অমলিন

অ্যাবা (ইংরেজি ভাষায়: ABBA) একটি সুইডিশ পপ সঙ্গীত ব্যান্ড। ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এই ব্যান্ডের যাত্রা শুরু। ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা ছিলেন আনি-ফ্রিদ ‘ফ্রিদা’ লিংস্তা, বিয়ন উলভ্যাস, বেনি অ্যান্ডারসন এবং আগনেথা ফেলৎসকোগ। ৫০ বছর আগে শুরু হওয়া এই ব্যান্ডে বিয়ন উলভ্যাস ছিলেন অসাধারণ ইংরেজি সঙ্গীত রচয়িতা আর বেনি অ্যান্ডারসন ছিলেন সেই সময়কার প্রতিভাবান একজন সুরকার। আর কণ্ঠের দিক দিয়ে অ্যাগনেথা আর অ্যানাফ্রিড দুজনেই ছিলেন অপূর্ব। ওদের চারজনের কণ্ঠের মিশেলে তৈরি হয়েছিল একটা যাদু- যা নিঃসন্দেহে সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত।

অ্যাবা’র দুই কন্ঠশিল্পী আনি-ফ্রিদ ও আগনেথা ফেলৎসকোগ

শুরুতে শ্রোতাদের মধ্যে খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেনি এই ব্যন্ড দল। হঠাৎই একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ এলো অ্যাবা‘র, যা তাদের শিল্পী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

ব্যান্ডের গানগুলোর রচয়িতা বিয়ন উলভ্যাস এবং সুরকার বেনি অ্যান্ডারসন

১৯৭৪ সালের ১৯তম ইউরোভিশন সঙ্গীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের সৈকত শহর ব্রাইটনে। ওই অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি দেখেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩০ কোটি মানুষ। প্রতিযোগিতার ভেন্যু ছিল সমুদ্রতীরে গ্র্যান্ড হোটেল।

১৯তম ইউরোভিশন সঙ্গীত প্রতিযোগিতা অ্যাবা’র অংশগ্রহণ দর্শকশ্রোতাকে মুগ্ধ করে

প্রতিযোগিতার মঞ্চে ওঠার আগে শ্রোতাদের নজর কেড়েছিলেন অ্যাবা’র দুই সুন্দরী প্রতিযোগী। শ্রোতাদের সঙ্গে ভাব জমানোর পর তারা যখন গাইতে মঞ্চে উঠলেন, তাদের সঙ্গীত প্রতিভার দ্যুতি দেখে চমকে গিয়েছিলেন সকল শ্রোতা। চারজনের কন্ঠের মিশেলে তৈরি হয়েছিল একটা যাদু। চটকদার আর ঝকমকে হলেও কিছুটা বিচিত্র ধরনের পোশাকে মঞ্চে ওঠা চারজন শিল্পী দর্শক শ্রোতাকে আকর্ষণ করেছিল তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। ওই প্রতিযোগিতার ফেভারিট গানগুলোকে পেছনে ফেলে সবাইকে মুগ্ধ করেছিল নতুন এই শিল্পীগোষ্ঠীর গান ‘ওয়াটারলু’।

‘ওয়াটারলু’ গানটি অ্যাবা’র দ্বিতীয় অ্যালবামে স্থান পায়

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংগীত তারকাদের মধ্যে সেরা হয়ে অ্যাবা ছিনিয়ে নিল শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা। সেদিনই মানুষ বুঝে গেল এই তারকা দল তাদের আরও আরও অভিনব গান দিয়ে জিতে নেবে শ্রোতাদের হৃদয়। কী অসাধারণ অনায়াস নৃত্যভঙ্গিমায় পুরো গান গাইল দলটি! যখন জিতে নিল পুরস্কার, তখন সুইডেনের সাংস্কৃতিক জীবনে প্রাপ্তির খাতায় ঢুকে গেল সবচেয়ে আকর্ষণীয় পালকটি! ‘ওয়াটারলু’ গানটির মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় পপ সঙ্গীতের জগতে নতুন একটি ধারা।

‘ওয়াটারলু’ গানটি অ্যাবা’র দ্বিতীয় অ্যালবামে স্থান পায়

‘ওয়াটারলু’ গানটি হয়ে ওঠে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া একক গান। এর রেকর্ড বিক্রি হয় ৬০ লক্ষ কপি। এছাড়াও এই গানটি একইসঙ্গে জার্মানি, সুইডেন ও ফ্রান্সের বাজার মাত করে। ১৯৭২ সাল থেকে ‘অ্যাবা’ ব্যান্ডের গানগুলো বিশ্বের জনপ্রিয় সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম সফল গান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাত্রা শুরুর পর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ টপচার্ট তালিকায় ‘অ্যাবা’র অবস্থান ছিল শীর্ষে।

অ্যাবা’র প্রথম অ্যালবাম ‘রিং রিং’

২০০৮ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে অ্যাবা’র বিক্রিত অ্যালবামের সংখ্যা ৩৭৮ মিলিয়নেরও বেশি। আর এর কারণেই ‘অ্যাবা’ বিশ্ব-সংগীতের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ বিক্রিত অ্যালবামের জনপ্রিয় ব্যান্ডে পরিণত হয়েছিল। ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ‘অ্যাবা’র অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ৩০ লাখ কপি করে। ইংরেজি ছাড়া স্প্যানিশ ভাষায়ও ‘অ্যাবা’ তাদের গানের সংস্করণ বের করেছিল। ‘গ্রাসিয়াস পার লা মিউসিকা’ নামের এই অ্যালবামটি ছিল ‘অ্যাবা’ ব্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর স্প্যানিশ সংস্করণ। ম্যুরিয়েল’স ওয়েডিং, অ্যাডভেঞ্চারস অব প্রিসিলা, কুইন অব দ্য ডেজার্ট ইত্যাদি জনপ্রিয় হলিউডি ছবিতেও অ্যাবার গান ব্যবহার করা হয়েছে।

‘অ্যাবা’ ব্যান্ডের গানগুলো নিয়ে ২০০৮ সালে নির্মাণ করা হয় ‘মামা মিয়া’ চলচ্চিত্রটি। ছবি মুক্তির পর সে বছর যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য হয়েছিল ‘মামা মিয়া’। ‘অ্যাবা’ ব্যান্ড ২০১০ সালে ১৫ মার্চ ‘দ্য রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম’-এ স্থান পায়।

অ্যাবা’ ব্যান্ডের গানগুলো নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মামা মিয়া’

১৯৭৯ সালে  ‘মিউজিক ফর ইউনিসেফ’ কনসার্টে ‘অ্যাবা’ পারফর্ম করে ‘চিকিচিতা’ গানটি। তাদের এই গানটি যে ভীষণ জনপ্রিয় ও সফল হয়েছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এই গান থেকে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেকটাই ইউনিসেফকে দান করে দেয় অ্যাবা। অ্যাবার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তৈরি করা হয় ‘অ্যাবা মিউজিয়াম’।

ব্যন্ড দল অ্যাবা-কে নিয়ে তৈরি ‍মিউজিয়াম

সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তৈরি হয়েছে এই জাদুঘর। জাদুঘরের বিভিন্ন রুমে স্থান পেয়েছে অ্যাবা’র কনসার্টে পরা পোশাক, কিছু ইন্সট্রুমেন্ট, তাদের রেকর্ডিং স্টুডিও ও ড্রেসিং রুমের রেপ্লিকা, অ্যাবা শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের ভিডিও ইত্যাদি।

কনসার্টে পরা অ্যাবা’র পোশাকগুলো

বিটলস ভেঙে যাক, তা যেমন চায়নি দলটির অগণিত ভক্ত, তেমনি অ্যাবার ভাঙনও চায়নি কেউ। কিন্তু ১৯৭২ সালে একসঙ্গে যে পথচলা শুরু হয়েছিল অ্যাবা’র, সে পথযাত্রা থেমেছিল দশ বছরের মাথায় এসে। সেই যে তারা একসঙ্গে গান করা ছাড়লেন, আর কখনো শোনা গেল না তাদের মোহিনী কোরাস। মাঝে কয়েকবার কোনো অনুষ্ঠানে এসেছেন হয়তো, কিন্তু পারফরম্যান্স? একেবারেই না।

কেন ভেঙে গেল দল? অ্যালবাম বিক্রি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। একের পর এক অ্যালবাম হিট হয়েছে। যা গেয়েছেন, তা-ই লুফে নিয়েছে মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা, অ্যাবা কাউকে কপি করেনি। তাদের কোনো আইডল ছিল না। এমনকি অ্যাবা অ্যাবাকেও কপি করেনি। প্রতিটি গানের সময় নতুন লুক, নতুন পোশাক, নতুন নৃত্য ভঙ্গিমায় শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থাপিত হয়ে তারা জয় করে নিয়েছেন কোটি ভক্তের মন।

বিচ্ছেদের পর ব্যান্ডের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে সর্বশেষ পারফর্ম করেন এই ব্যান্ডের চার সদস্য

বিয়র্ন বিয়ে করেছিলেন অ্যাগনেথকে, বেনি করেছিলেন ফ্রিদাকে। কিন্তু আশির দশকে এসে তাদের সম্পর্কে ছেদ ঘটে। যে উচ্ছ্বল উদ্দীপনা ছিল তাদের গানে, তাতে ভাটা পড়ে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে দল ভেঙে যাওয়ার একটা বড় সম্পর্ক আছে। তবে আর কখনো তাদের এক হওয়া সম্ভব নয় বলে ২০০৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন উলবেওস। “আমরা চাই শ্রোতারা আমাদের সেই সময়কার অ্যাবা’র সদস্য হিসেবেই মনে রাখুক”। ১৯৮২ সাল তাই সংগীতপ্রেমীদের জন্য ছিল তাই  বিষন্ন এক বছর।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/ABBA

২) rateyourmusic.com/artist/abba

৩) news.com.au/entertainment/music/abba-have-finally-reunited-in-sweden-for-the-opening-of-a-mamma-miathemed-restaurant/

৪) lifetimetv.co.uk/people/abba

৫) telegraph.co.uk/comment/columnists/craigbrown/3560590/9-Things-You-Didnt-Know-About-Abba.html

৬) bettylou.zzruss.com/abbabiography.htm

৭) abba-intermezzo.de/estory.htm

Related Articles

Exit mobile version