পাখি হতে চাওয়ার শখ মানুষের বহু পুরনো। ডানা মেলতে না পারলেও বিশ্বে খুব অল্প কিছু মানুষ কিন্তু এই পাখির ভাষাতেই কথা বলে! কথ্য বা লেখ্য ভাষার সাংকেতিক সংস্করণ হিসেবে শিস দিয়ে যোগাযোগ করেন এরা। এই শিসভাষা আবার শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু আওয়াজ নয়, বরং অনেক বেশি কাঠামোবদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত। পৃথিবীতে প্রায় ৭০টি স্বীকৃত শিসভাষা নথিভূক্ত আছে, যাদের অধিকাংশই বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির পথে। কম্পাঙ্কের তীক্ষ্ণতার দরুন শিসের আওয়াজ সহজেই আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় ধরতে পারে। এমনকি ৪ কিলোমিটার অবধি পৌঁছাতে পারে এই আওয়াজ। তাই বিস্তীর্ণ ক্ষেতসমৃদ্ধ কৃষিজীবী জনপদের অন্তঃযোগাযোগে (Intra-communication) এ ভাষা বেশি প্রচলিত। মরক্কোর অ্যাটলাস বা হিমালয়ের পার্বত্য জনপদ, লাওসের মালভূমি, ব্রাজিলের আমাজন, এমনকি খরা-বিদীর্ণ ইথিওপিয়াতেও মানুষ শিসের সাহায্যে যোগাযোগ করত। গ্রিক পরিব্রাজক হেরোডটাস স্বয়ং ইথিওপিয়ান শিসভাষার সাক্ষী। তাঁর কাছে এ ভাষা ছিলো ‘বাদুড়ের কিচিরমিচির’ এর মতো। তুরস্ক, স্পেন, গ্রিসের প্রত্যন্ত কিছু অঞ্চলে আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে পাখির ভাষা। সেসব ভাষার কথাই বলবো আজকের লেখায়।
একদিকে পন্টিক পর্বত, আরেকদিকে কৃষ্ণসাগর। এর মাঝে সানাকসি জেলার এক অনিন্দ্য সুন্দর গ্রাম, নাম কুস্কয়। প্রায় ১০,০০০ মানুষের বাস এখানে। চা আর হ্যাজলনাটের বাগানে ছাওয়া গ্রামের কেন্দ্রে সাদা একটা মিনার আর ছোট্ট গম্বুজওয়ালা একটা মসজিদ। আজানের সুমিষ্ট সুরের সাথে ঘন ঘন আপনার কানে ভেসে আসবে পাখির আওয়াজ। কী দিন, কী রাত! সবটা অবশ্য পাখির আওয়াজ নয়। লেখাটির শিরোনাম পড়ে ঠিকই বুঝে নিয়েছেন, সেখানকার মানুষেরাই পাখির ভাষা তথা শিসের সাহায্যে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে। সেখানকার মানুষের কাছে আদুরে এ ভাষাটির নাম ‘কুসদিলি’, যার অর্থও পাখির ভাষা।
কুসদিলি কি একদম স্বতন্ত্র কোনো ভাষা? না। এটি মূলত তুর্কি ভাষাই। সব ভাষারই যেমন কথ্য ও লেখ্য রূপ আছে, তুর্কির কেবল অতিরিক্ত একটা শিস বা সাংকেতিক রূপ আছে, এই আর কি। প্রতিটি বর্ণকে শিসধ্বনির সাহায্যে উচ্চারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় যখন পুরো একটি শব্দ উচ্চারণ করা হয়, তখন শব্দটি তুর্কি থাকে বটে, কিন্তু কুস্কয়ের লোকেরা ছাড়া কেউই তা বোঝে না। তখন শব্দমালাকে পাখির কিচিরমিচির ভাষার মতো সুমধুর কিছুই মনে হয়।
“আপনার কাছে তাজা রুটি হবে?”- ঠোঁটে বিশেষ কায়দায় আঙুল ঢুকিয়ে জিভ-দাঁতের কারিকুরিতে ৬ বার শিস। ব্যস, বোঝানো হয়ে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে কাছের বা দূরের পড়শিকে কুশল জানাতে, ডাকতে কিংবা ঘোষণা দিতে ব্যবহৃত হয় এই ভাষা। এই কুসদিলি শোনাও যায় প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দূরত্ব অবধি। ১৯৮৬ সালের আগে এখানে বিদ্যুতও ছিলো না, যোগাযোগে কুসদিলিই ছিলো ভরসা। কিন্তু মোবাইলের যুগে কে আর এত কষ্ট করে! ব্যস, প্রযুক্তি এনে দিয়েছে গতি, কেড়ে নিয়েছে অনুভূতি। প্রযুক্তির কল্যাণে বিলুপ্তির পথে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা এই ভাষা। ইউনেস্কোর List of Intangible Cultural Heritage in Need of Urgent শাফেগুয়ারদিং এ গত বছর যুক্ত হয়েছে কুসদিলি। শুধু কুস্কয়তেই নয়, এই ভাষা মাত্র ৫০টি বছর আগেও প্রচলিত ছিলো উত্তর তুরস্কের কৃষ্ণসাগর ঘেঁষা ত্রাবজোন, রাইজ, ওর্দু, আর্তভিন, বেবুর্ত অঞ্চলে। বর্তমানে সেখানকার মেষপালকদের মুখে মুখে কেবল খুচরো কিছু আওয়াজ বেঁচে আছে।
২০১৪ সাল থেকে গ্রামটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভাষাটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেখানো শুরু হয়। এর আগে ১৯৬৪ সালে টাইমসের একটি প্রতিবেদনে গ্রামটির কথা বলা হয়েছিলো। সেই প্রতিবেদন মতে, গ্রামটির শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাবার আগেই শিখে নিত এ ভাষা। প্রতি বছর গ্রামটিতে ‘কুসদিলি উৎসব‘ আয়োজন করা হয়। উৎসবে শিস বাজানোর প্রতিযোগিতারও একটি পর্ব থাকে।
এই ‘পাখির ভাষা’ নিয়ে বেরিয়েছে একটি আলোচিত গবেষণা প্রতিবেদন। সমীক্ষাভিত্তিক গবেষণাটি করেছিলেন জার্মানির বোকমের ইনস্টিটিউট অব কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের বায়োসাইকোলজিস্ট ওনার গুনতুর্কুন। আমাদের মস্তিষ্কের বামপাশ ভাষার অর্থদ্যোতকতা অনুধাবন করে। অন্যদিকে আমাদের মস্তিষ্কের ডানপাশ আওয়াজ, সুরের মূর্চ্ছনা, তাল, লয় ইত্যাদি প্রক্রিয়াক্ররণ করে। তাই ব্রেইন স্ট্রোকে কারো মস্তিষ্কের বামপাশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে ও মৌখিক যোগাযোগে অক্ষমতা তৈরি হলে তার জন্য ভালো সমাধান হতে পারে এই ‘পাখির ভাষা’। এমনটিই বলছে উক্ত গবেষণা।
স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লা গোমেরোতে প্রচলিত রয়েছে বিখ্যাত আরেক শিসভাষা। নাম সিলবো গামেরো। সংক্ষেপে সিলবো। সিলবোভাষীদের বলা হয় সিলবাদর। কুসদিলি যে ইউনেস্কো স্বীকৃতি পেয়েছে গত বছর, সিলবো গামেরো সেটি পেয়েছে ২০০৯ সালেই।
উত্তর আফ্রিকা থেকে যখন গুয়াঞ্চেসরা এই দ্বীপে পা রাখলো, তখন স্থানীয় আদিবাসী ভাষা থেকে নিজেদের যোগাযোগ উপযোগী একটা সংস্করণ দাঁড় করিয়ে নিলো তারা। বিশাল দ্বীপে গলা ফাটিয়ে শব্দ উচ্চারণ করবার থেকে শিস দিয়ে যোগাযোগ করা সহজ কি না। প্রায় তিন কিলোমিটার অবধি সিলবাদরদের আওয়াজ পৌঁছাত। ষোড়শ শতকে স্প্যানিশ কাস্তিলিয়ান সাম্রাজ্যের অধিভূক্ত হয় গোমেরো। সেই থেকে স্প্যানিশও মিশে গেছে এই সিলবো ভাষার সাথে।
১৯৭০-৮০ এর দিকে খুব অল্পসংখ্যক সিলবাদর অবশিষ্ট ছিলেন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে এখানকার বিদ্যালয়গুলোতে ভাষাটি অবশ্যপাঠ্য করা হলো। ফলাফল পাওয়া গেলো হাতেনাতে, বর্তমানে প্রায় ২২,০০০ লোক এই ভাষায় যোগাযোগ করে থাকেন। সেখানে গেলে দেখবেন- বিদ্যালয়ে, রেস্তোরাঁয় সমানে মানুষ সিলবোতে কথা বলছে, ওদিকে পর্যটকেরা মুগ্ধচোখে দেখছে আর শিখছে। লা গোমেরোর পর্যটনমন্ত্রী ফার্নান্দো মেন্ডেজ বলেন,
“যেভাবে যুক্তরাজ্য তার পর্যটনের সাথে ইংরেজি শিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়েছে, যেভাবে ভারত তাদের যোগব্যায়ামকে পর্যটনক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে, আমরাও সিলবোকে নিয়ে সেরকম কিছুই করবো।”
তবে এমনটি করতে গিয়ে সিলবো না আবার ‘ক্লিশে’ হয়ে যায়, বা আবেদন হারায়, এমন ভয়টাও আছে। দ্বীপ বিশেষজ্ঞ হার্নান্দেজ মেরেরোও মনে করিয়ে দিলেন, হাওয়াইয়ের এককালের ট্রেডমার্ক ফুলের মালা এখন কেউ পুছে না! কেননা ওটা ক্লিশে হয়ে গেছে।
গ্রিসেও শিস ভাষা জীবিত আছে। মধ্য গ্রিসের ইউবিয়ার আন্তিয়া গ্রামের বাসিন্দারা এখনো এ ভাষায় কথা বলে থাকেন। এটির আঞ্চলিক নাম স্ফিরিয়া, যার উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘স্ফিরিজো’ (অর্থ: শিস দেওয়া) থেকে।
এটিও মূলত গ্রিক ভাষারই সাংকেতিক রূপ। অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আন্তিয়াবাসী এটি ব্যবহার করেন, যেমন- কুশল বিনিময়, নিমন্ত্রণ প্রদান, বাজার-সদাইয়ের বিষয়আশয় ইত্যাদি। সিলবোর মতো কম্পাঙ্কের ওঠা-নামা দিয়ে আবেগের প্রকাশ এ ভাষায় নেই, মোটামুটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ বর্জিত একটি যোগাযোগপদ্ধতি এটি। বিশ্বের অনেক স্থানের শিসভাষীরা প্রেমের আহবান, ঘনিষ্ঠতা বা গোপন মুহূর্তের কথাবার্তা ইত্যাদি সময়ে শিসভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু আন্তিয়ার মানুষ খুবই রক্ষণশীল। প্রেম জাতীয় বিষয়কে তারা স্ফিরিয়া থেকে দূরে রাখেন। তীক্ষ্ম শিস বাজাতে দরকার মজবুত দাঁত। তাই শিস দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন আন্তিয়ার বৃদ্ধরা। ফোকলা দাঁতে হাসিকার্য চালানো গেলেও শিস যে বড্ড দুরূহ!
গ্রামটি খুবই অল্পবসতির। তরুণরা ধীরে ধীরে পাড়ি জমাচ্ছে পাশের এভিয়া বা রাজধানী এথেন্স শহরে। ওদিকে বুড়োরা পাড়ি জমাচ্ছে গ্রামের ছোট্ট চার্চের গোরস্থানে। হতাশ হবেন জেনে যে, বর্তমানে মাত্র ৩৭ জন বাসিন্দা অবশিষ্ট আছেন গ্রামটিতে। এদের মধ্যেও মাত্র ২০-২২ জনের এ ভাষা সম্পূর্ণ আয়ত্বে আছে। হ্যাঁ, এটিও ভাষাবিদদের মতে বিলুপ্তপ্রায় একটি ভাষাই বটে। তুরস্ক ও সাইবোর ইউনেস্কো স্বীকৃতি মিললেও মিলেনি স্ফিরিয়ার। গ্রিক সরকার নাকি আবেদনই করেনি ইউনেস্কোর কাছে! বিলুপ্ত হতে যে বেশিদিন বাকি নেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
Featured Image from: bbc.com