“এটি কি আপনার কাজ?”
মুগ্ধতা ও বিস্ময়মাখা চাহনিতে দেয়ালে আঁকা গুয়ের্নিকার দিকে তাকিয়ে পাবলো পিকাসোকে প্রশ্ন করলেন এক গেস্টাপো কর্মকর্তা। এই প্রশ্ন যখন করা হয়েছিল, তখন ফ্রান্সের বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপ বিরাজ করছিল। ইতোমধ্যে হিটলারের কুখ্যাত নাৎসি সেনারা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস দখলে নিয়েছে। নাৎসি আতঙ্কে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে গেছেন সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীগণ। কিন্তু থেকে গেলেন শুধু পিকাসো।
নাৎসিদের পুলিশ গেস্টাপোর কর্মকর্তারা ক্ষণে ক্ষণে লোকের বাসভবনে প্রবেশ করে খবরদারি করতো। এই খবরদারি থেকে বাদ যাননি তিনিও। বলতে গেলে, গেস্টাপোরা তাকে একটু বেশি জ্বালাতন করতে থাকে। নিয়মিত তার বাড়িতে হানা দিতো গেস্টাপো। একবার তল্লাশির সময় তারা পিকাসোর স্টুডিওতে ঢুকে পড়ে। আর তখনই গুয়ের্নিকার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে সেই কর্মকর্তার। এই প্রশ্ন করার পর পাবলো পিকাসো সেই সশস্ত্র গেস্টাপোর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় জবাব দিলেন,
“না। এটি আমার কাজ নয়। এটি আপনাদের কাজ।”
পিকাসোর উত্তরে সেদিনের সেই কর্মকর্তা একদমই অবাক হননি। কারণ, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যার হাতে এই গুয়ের্নিকা অঙ্কিত হয়েছে, একমাত্র তার মুখ থেকেই এমন শক্ত উত্তর আশা করা যায়।
গুয়ের্নিকাকে এখন পর্যন্ত চিত্রকর্মের জগতে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ভয়াল যুদ্ধবিরোধী চিত্রকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রায় ৮ মিটার চওড়া ক্যানভাসের প্রতিটি বিন্দুতে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। সোজা কথায়, গুয়ের্নিকা ছিল তুলি হাতে যুদ্ধের নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে এক বিপ্লবী আহ্বান। সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের আজকের প্রবন্ধে থাকছে সেই ভয়াল গুয়ের্নিকার উপাখ্যান।
গুয়ের্নিকার দিকে যখন কারো প্রথম নজর পড়বে, তখন মনে হবে, খাপছাড়া অনেকগুলো বস্তু যেন একসাথে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন চিত্রকর। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধকে ঘিরে অঙ্কিত গুয়ের্নিকা যখন প্রথম উন্মোচিত হয়েছিল, তখন অনেকেই এই মর্মার্থ উদঘাটনে ব্যর্থ হয়। কেউ কেউ তো মন্তব্য করেছিলো, চার বছরের বাচ্চা যখন অনেকগুলো মানব অঙ্গ এঁকে খাতা ভরিয়ে জগাখিচুড়ি বাঁধিয়ে দেয়, সেটা দেখতে গুয়ের্নিকার মতো হয়। কিন্তু যারা শৈল্পিক দৃষ্টিতে গুয়ের্নিকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, তারা মুহূর্তের মধ্যে এর নৃশংসতায় ভয় পেয়েছিলেন, কেঁপে উঠেছিল তাদের অন্তর।
গুয়ের্নিকা মূলত স্পেনের একটি শহর। জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিবাদ বাহিনী যখন স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রের সাথে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন ফ্র্যাঙ্কো বাহিনীর যুদ্ধ বিমান এই ছোট শহরের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ করে বসে। ঠিক তখন প্রজাতন্ত্রের অনুরোধে পাবলো পিকাসো এক যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ হিসেবে সেই ঘটনাকে চিত্রিত করে তোলেন ৮ মিটার প্রশস্ত এবং ৩ মিটার দীর্ঘ এক সাদাকালো তৈলচিত্রের মাধ্যমে। যুদ্ধ বলতে আমরা বুঝি সেনায় সেনায় লড়াই। কিন্তু সেই গৃহযুদ্ধে তুলি আর রঙ নিয়ে পাবলো পিকাসো এক চিত্রসেনা রূপে ফ্যাসিবাদ ফ্র্যাঙ্কোর ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে ধূলিস্যাৎ করেছিলেন।
তবে গুয়ের্নিকার মতো প্রভাবশালী চিত্রকর্ম সহসা তৈরি হয়ে যায়নি। হুট করেই পাবলো পিকাসো রং-তুলি হাতে এই মহান চিত্র এঁকে ফেলেননি। গুয়ের্নিকার সূক্ষ্ম প্রতীকীবাদের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বছর ধরে আয়ত্ত করা পিকাসোর অনন্য চিত্রদর্শন। ১৯২০ সালের দিকে পাবলো পিকাসো অধিবাস্তববাদী চিত্রকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। অধিবাস্তববাদ বা সুররিয়েলিজম ছিল বিংশ শতাব্দীর চিত্রকর্ম এবং দর্শনের জগতে এক নব্য বিপ্লব। একগাদা শব্দ দিয়ে একে সংজ্ঞায়িত করা বেশ দুরূহ কাজ।
অধিবাস্তববাদ এর সমসাময়িক অন্যান্য সৃজনশীল বিপ্লবের চেয়ে বেশ আলাদা এবং অনন্য। অধিবাস্তববাদী চিত্রকর্মগুলো মানুষের অচেতন মনোজগতকে ক্যানভাসের সফেদ জমিনে জীবন্ত করে তুলে। এর প্রধান উদ্দেশ্য মনের নিগূঢ় চিন্তাভাবনাকে সবার সামনে তুলে ধরা। এর ফলে চিত্রকর্মে অঙ্কিত বস্তুগুলো এমনভাবে অবস্থান করে, যা আমরা শুধু স্বপ্নেই দেখে থাকি। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে সালভাদর ডালির বিখ্যাত ‘দ্য পারসিস্টেন্স অভ মেমোরি’ চিত্রকর্মটি এখানে দেওয়া হলো।
পিকাসোর অধিবাস্তববাদী চিত্রকর্মগুলো দ্রুত চিত্রজগতে সাড়া ফেলে দিতে সক্ষম হয়। প্রথমদিকে তিনি এধরনের ছবি এঁকে মনের আনন্দ ফুটিয়ে তুলতে থাকেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তা এক অসীম শূন্যতায় পরিণত হয়। তার চিত্রকর্মের উপাদানগুলো নাটকীয়ভাবে মনোজগতের ভয়াবহতাকে চিত্রায়িত করতে থাকে। এই পরিবর্তনের পেছনে গবেষকগণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই সময়ে অধিবাস্তববাদী চিত্রশিল্পীরা সংঘর্ষ, ভীতি, ট্র্যাজেডি এবং ব্যর্থতার চাপে মানুষের মনের ভেতর যে শূন্যতা এবং আঁধারের সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।
এছাড়া পাবলো পিকাসোর জীবনে বহু নারীর আগমন ঘটে। তাদের সবার সাথে পিকাসোর সম্পর্ক একরকম ছিল না। অনেকের সাথে তার সম্পর্কের তিক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই তিক্ততাকেও তিনি তার বিভিন্ন চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন। এজন্য পিকাসোর বহু অধিবাস্তব চিত্রে নারী অভিব্যক্তির বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। নারীদেহের বিভিন্ন অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তিনি ভিন্ন বাস্তবতাকে বন্দি করতে পারতেন। ধ্বংসাত্মক ভাবকে প্রকাশ করতে তিনি নারীকে সুনিপুণ হস্তে ব্যবহার করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার এক দশক পর পুনরায় স্পেনের মাটিতে যুদ্ধের দামাম বেজে উঠল। ফ্যাসিবাদী জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর নেতৃত্বে ১৯৩৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ফ্র্যাঙ্কোকে এই যুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য করে ইতালি এবং জার্মানি। এরূপ ধ্বংসাত্মক বাহিনীর সাথে আর যা-ই হোক, অস্ত্র দিয়ে পেরে ওঠা অসম্ভব। তাই ফ্র্যাঙ্কোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পেন প্রজাতন্ত্রের দরকার ছিল আন্তর্জাতিক জনমতের। এই জনমত গড়ে তুলতে তারা ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে পাবলো পিকাসোর দ্বারস্থ হন। তাকে অনুরোধ করা হয়, সামনের আন্তর্জাতিক মেলায় প্রদর্শনের জন্য একটি যুদ্ধবিরোধী ম্যুরাল এঁকে দেওয়ার জন্য।
পিকাসো নিজেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। তাই প্রজাতন্ত্রের অনুরোধে তিনি ছবি এঁকে দেয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু, এর পরই শুরু হলো আসল ঝামেলা। পিকাসো বুঝতে পারছিলেন না, তিনি কী আঁকবেন! যুদ্ধের বিরুদ্ধে যখন তুলি হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন সেটি দিয়ে মোক্ষম আঘাত হানাই ছিল পিকাসোর উদ্দেশ্য। এভাবে তিনমাস পার হয়ে গেলো। ঠিক তখন ফ্র্যাঙ্কো সেনাদের নেতৃত্বে এপ্রিল মাসে বাস্ক অঞ্চলের গুয়ের্নিকা শহরে পরিচালিত হয় এক সাঁড়াশি আগ্রাসন।
তিন ঘণ্টাব্যাপী সে আগ্রাসনে পুরো শহর এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। এই আক্রমণের সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল, শহরের বাইরের দিকে অবস্থিত যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরির কারখানাগুলো একদম অক্ষত ছিল। যেন পুরো আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল- সাধারণ মানুষকে নির্বিচার হত্যা করা।
পরদিন পত্রিকার পাতায় বর্ণিত হলো গুয়ের্নিকার ভয়ঙ্কর আক্রমণের খবর। পিকাসো তখন প্যারিসের এক রেস্তোরাঁয় বসে নাস্তা করছিলেন। এই তিনমাসে তিনি কী আঁকবেন, তা মনস্থির করতে পারেননি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি এমন একটি ম্যুরাল আঁকবেন, যেখানে এক চিত্রকরের সামনের সোফায় শুয়ে আছে এক উলঙ্গ নারী। কিন্তু এখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা কতটা ফুটে উঠবে, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তিনি। সেদিন রেস্তোরাঁর পত্রিকায় গুয়ের্নিকার বীভৎস বর্ণনা এবং ছবি দেখে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো।
ব্যথিত মনে পিকাসো সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি গুয়ের্নিকাকে উপজীব্য করে চিত্রায়িত করবেন এযাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী ম্যুরাল। তিনি দ্রুত স্টুডিওতে ফিরে কাজে লেগে পড়লেন। আর এভাবেই চিত্রায়িত হলো এক ভয়ঙ্কর চিত্রকর্ম ‘গুয়ের্নিকা’, যা যুদ্ধবাজ হায়েনাদের বিরুদ্ধে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করল।
গুয়ের্নিকা ম্যুরালটির দিকে একপলক তাকিয়ে থাকা বিমুগ্ধ দর্শকরা পিকাসোকে প্রশ্ন করলো,
“এই ম্যুরালের মর্মার্থ কী?”
এর বর্বর অভিব্যক্তি এবং প্রতিটি নারীর ভীত চাহনি মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে আলোচনার সৃষ্টি করে। সবাই নিজের মতো একে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা সবার মনঃপূত হয় না। তাই সবাই পিকাসোকে প্রশ্ন করলেন এর ব্যাপারে। পিকাসো স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব দিলেন,
“আপনি যদি নিজে আমার চিত্রের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড়া করান, সেটি হয়তো সঠিক হবে। কিন্তু ব্যাখ্যা দেওয়া আমার দায়িত্ব নয়। আপনারা যা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, সেগুলো আমার মাথায় এসেছিল। আমিও সেগুলো অনুভব করেছি, অবচেতনভাবে বা সচেতনভাবে। আমি চিত্রাঙ্কন করি চিত্রাঙ্কনের জন্য। আমি চিত্রাঙ্কন করে বস্তুকে তার আসল রূপে চিত্রায়িত করি।”
পিকাসো ব্যাখ্যা দিতে নারাজ হলেও চিত্র বিশেষজ্ঞরা থেমে থাকেননি। এই ছবির বহু ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যাখ্যা থেকে এই ছবিকে সংক্ষিপ্তাকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরা যাক।
গুয়ের্নিকার দীর্ঘ ক্যানভাস যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিমণ্ডলে হাজারো মানুষের দিগ্বিদিক ছুটোছুটি, আর্তচিৎকার এবং মৃত্যুর খসড়া। এখানে মোট ছয়টি মানুষের দেহাঙ্গ পরিলক্ষিত হয়, যার চারটি নারী, একটি পুরুষ এবং একটি শিশু। এছাড়া একটি ঘোড়া, ষাঁড়, মাথার ওপর আলোকিত বিজলী বাতি এবং আবছা আঁধারে চিৎকার করে উঠা একটি পাখিও ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে। পুরো ছবিটি সাদাকালো রঙে আঁকা। এর মাধ্যমে এক অদ্ভুত আবহের সৃষ্টি হয়েছে, যা শান্তিপ্রিয় দর্শকের মনে ভয়ের সঞ্চার করতে সক্ষম। পুরো ছবিটি জুড়ে প্রকাশিত হয়েছে বহু প্রতীকী উপাদান।
প্রথমেই বাঁদিকে আঁকা ষাঁড়ের দিকে লক্ষ করা যাক। এখানে ষাঁড়ের মাধ্যমে পাবলো পিকাসো স্পেনের বিখ্যাত ষাঁড়ের লড়াইকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর ছবির এই ষাঁড়টি তাই সমগ্র স্পেনের সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি। ছবিতে দেখা যায়, আক্রমণে আহত ষাঁড়টি এক সন্তানহারা নারীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই নারী সমগ্র স্পেনের সন্তানহারা, যুদ্ধ নির্যাতিতাদের প্রতিচ্ছবি। মাঝখানে পিকাসো অঙ্কন করেছেন জখমে চিৎকার করতে থাকা এক ঘোড়াকে। এই ঘোড়ার প্রতীকী অর্থ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। অনেকের কাছে, ঘোড়া এবং ষাঁড় দু’টোই ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিবাদের প্রতিচ্ছবি।
আবার অনেকে এই ঘোড়াকে যুদ্ধাহত নিরীহ মানুষের দুর্গতির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ঘোড়ার পদদলিত হয়ে ছিন্নদেহে শায়িত এক মৃত সৈনিক। তার হাতের ভগ্ন তরবারির মুখে জন্ম নিচ্ছে এক মলিন ফুল। তার অপর হাতে যিশুখ্রিস্টের ক্রুশের চিহ্ন স্পষ্ট ইঙ্গিত করে সৈনিক যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এই সৈনিক প্রজাতন্ত্রের আশা-ভরসার প্রতীক। ছবির মাঝখানে উজ্জ্বল বিজলী বাতি দিয়ে হয়তো চিত্রকর যুদ্ধে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তি এবং সমরাস্ত্রের কথা বুঝিয়েছেন। আবার এই বাতি কারাগারের টর্চার সেলের বাতির প্রতীক হিসেবেও ব্যাখ্যায়িত হয়েছে।
আর এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে ঘোড়ার পাশে ঘরের জানালা দিয়ে এক নারী প্রদীপ হাতে উঁকি দেয়ার দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এর নিচে আরেক নারীর অবয়ব ফুটে উঠেছে। তার এক পা মাটিতে স্থায়ীভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালানোর চেষ্টা করেও যেন ব্যর্থ হচ্ছেন বারবার। একদম ডানদিকে হাত-পা ছুঁড়ে পলায়নরত এক আতঙ্কিত নারীকে দেখা যাবে। তার চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, মানব সভ্যতার পাশবিক রূপ দেখে তিনি চমকে উঠেছেন। তাছাড়া পুরো ছবিটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দর্শকের উৎসাহী চোখে আরো বহু প্রতীকী বিষয় ধরা দেবে, যা ছবিটিকে আরো মর্মান্তিক করে তুলবে।
ম্যুরালটি সর্বপ্রথম প্যারিসে প্রদর্শিত হয়। এরপর এর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত ইউরোপের বড় বড় স্টুডিওগুলোতে প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রিত হয়। প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থ প্রজাতন্ত্রের উদ্বাস্তুদের ত্রাণ অর্থায়নে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময়ে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো স্পেনের মসনদে বসলে পিকাসোর অনুরোধে গুয়ের্নিকাকে আর স্পেনে ফেরত পাঠানো হয়নি। তার নির্দেশ ছিল, একমাত্র প্রজাতন্ত্র স্পেনেই যেন গুয়ের্নিকা ফেরত যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ম্যুরালটি সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টুডিওতে প্রদর্শিত হতে থাকে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণে থাকার ফলে ছবিটির ফ্রেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি শুধু নিউ ইয়র্কে প্রদর্শনের জন্য রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কেই ছিল চিত্রকর্মটি। পিকাসোর মৃত্যুর প্রায় ৬ বছর পর এটি স্পেনে ফেরত পাঠানো হয়। তার কথামতো, ফ্র্যাঙ্কোর মৃত্যুর ৮ বছর পর প্রজাতন্ত্র স্পেনের বুকেই ফেরত যায় বিখ্যাত গুয়ের্নিকা।
১৯৩৭ এর ম্যুরাল গুয়ের্নিকা ততদিনে শুধু তার ক্যানভাসে আবদ্ধ নেই। ড্রেসডেন, বার্লিন, হিরোশিমাসহ স্মরণকালের যুদ্ধের ভয়াবহতম উদাহরণগুলো, যেখানে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে- সেখানেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে গুয়ের্নিকা। গুয়ের্নিকা যেন শতাব্দী জুড়ে আর্ত মানবতার ম্যুরালে পরিণত হয়েছে। এমনকি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে মানুষ গুয়ের্নিকার চরিত্রগুলোর ছিন্ন প্রতিচ্ছবি নিয়ে বারবার রাজপথে নেমেছে।
পৃথিবীর অন্য কোনো চিত্রকর্ম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে এত বড় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আর এখানেই গুয়ের্নিকার অমরত্ব। গবেষক হার্বার্ট রিডের মতে, গুয়ের্নিকা হচ্ছে আধুনিক প্লাটুন, যা আর্ত মানবতার প্রতিনিধিত্ব করছে। তার মতে, গুয়ের্নিকা হচ্ছে ‘সর্বশেষ মহৎ ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম’। তার কথায় নড়েচড়ে বসবেন হয়তো আপনারা। কিন্তু একবার শৈল্পিক দৃষ্টিতে গুয়ের্নিকার দিকে তাকিয়ে দেখুন। সকল সংশয় দূর হয়ে যাবে, একথা জোর দিয়ে বলতে পারি।