বাংলার হারিয়ে যাওয়া মেয়েলি ব্রতানুষ্ঠান: মাঘব্রত ও সূর্যব্রত

এপার বাংলা-ওপার বাংলার বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে যে বঙ্গীয় সংস্কৃতি ব্যাপৃত হয়ে আছে, কোনো কাঁটাতারের বেড়া কিংবা ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে যাকে দ্বিখণ্ডিত করা যায়নি আজও, সেই বাংলার কোল জুড়ে ছেয়ে আছে হাজার হাজার মেয়েলি ব্রতানুষ্ঠান, উৎসব-পার্বণ আর মেলার ইতিহাস। ইতিহাস এ কারণে, বারবার বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর ওপর সুপরিকল্পিত ঐতিহাসিক টানাহ্যাঁচড়ায় যেভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে গোটা বাঙালি সমাজ; সে বিভাজনের ফলস্বরূপ আমরা হারিয়েছি সমাজজীবনে প্রতিপালিত এমন হাজারো ব্রত-অনুষ্ঠান, যার অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনা আজও আমাদের সম্প্রীতির নতুন পাঠ শেখায়। কালক্রমে সমাজজীবন থেকে দ্রুত বিলুপ্ত হতে হতে আজ বিচ্ছিন্নতার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া সেরকমই দুটি মেয়েলি ব্রত– মাঘমণ্ডলব্রত এবং সূর্যব্রত।  

একদিন নিজের অজ্ঞাতেই আদিম নারীরা যখন আবিষ্কার করেছিলেন ফসল উৎপাদনের গোপন কৌশল, কৃষিসভ্যতার পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল সেই প্রথম। শস্যের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ক্রমেই এখতিয়ারভুক্ত হয়েছিল কিছু ঐন্দ্রজালিক ধর্মাচার, যেখানে নারীর ভূমিকা ছিল মুখ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন আদিম জাতির মধ্যেই নানারকম জাদুভিত্তিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সূর্য-উপাসনা লক্ষ্য করা যায়। আদিম সমাজ যথার্থই মনে করত, নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতা ও শস্য উৎপাদনের ক্ষমতা আসলে একই ধরনের গুণের বহিঃপ্রকাশ। আর তাই আদিম সূর্যদেবতার সঙ্গে কুমারী নারীর সম্পর্কই লক্ষ্য করা যায় বেশি। একসময় শ্রীহট্ট-কাছাড়ে বাঙালি হিন্দু-কুমারী মেয়েদের অবশ্য পালনীয় ব্রত ছিল মাঘব্রত বা মাঘমণ্ডল ব্রত। সিলেট-কাছাড় ছাড়াও ঢাকা, কুমিল্লা, বিক্রমপুর অঞ্চলেও ব্রতটির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। ব্রতটি যে সময়ে উদযাপিত হত, সেই সময়টিও বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তখন থেকেই সূর্যের উত্তরায়ণ আরম্ভ হয় এবং তা মূলত পৃথিবীর বহু আদিমজাতির সূর্যোৎসবের অন্যতম সময় ।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মাঘমণ্ডল ব্রতের দুই ব্রতিনী; Image Source: Author’s Personal Collection 

পাঁচ বছর বয়স থেকে শুরু করে ঋতুমতী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নানা কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ব্রতটি সম্পন্ন করেন একজন বালিকা। স্বাভাবিকভাবে মনে হতেই পারে, মাঘমাসের প্রচণ্ড শীতে ভোরের অন্ধকার কুয়াশায় একাটি দুগ্ধপোষ্য বালিকাকে দিয়ে এমন একটি ব্রত উদযাপনের আড়ালে কোন সামাজিক কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে! কিন্তু আজ যখন দেখি দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিশুর দৈহিক-মানসিক বিকাশের জন্য শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার, ছড়া মুখস্থ বলা কিংবা রঙ্গোলি প্রতিযোগিতা প্রভৃতি আধুনিক পাঠ্যক্রমের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তখন কেবলই মনে হয় কত যুগ ধরে আমাদের গ্রামীণ সমাজ লৌকিক ব্রতগুলোর ভেতর দিয়ে এভাবেই একজন মানুষকে ভবিষ্যতের সুশৃঙ্খল, কঠোর পরিশ্রমী, স্বাবলম্বী পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পাঠ শিখিয়ে এসেছে, যা এক সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

ব্রতটির নামকরণ থেকেই বোঝা যায়, এর সঙ্গে এক অদ্ভুত শিল্পক্রিয়া জড়িত। মণ্ডল শিল্পকলা। মুক্ত আঙিনায় যেখানে ব্রতটি করা হবে, সেখানে মাটি দিয়ে একটি স্বতন্ত্র মাটির ভিটি বা ভিত্তি তৈরি করা হয়। এ ভিটিতেই রঙিন ইটের গুঁড়ো, নানা রঙের বালি, হলুদ গুঁড়ো, শুকনো পাতার গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে প্রাচীন কোনো বয়স্কা নারীর নেতৃত্বে ব্রতিনী মণ্ডলক্রিয়া করে থাকেন। এই সংগৃহীত বস্তুগুলো দিয়ে কীভাবে রঙের গুঁড়ি তৈরি করে মণ্ডল দেওয়া হবে স্বভাবতই সে নিয়ে শিশুর মনে কাজ করে একরকম রোমাঞ্চ ও আনন্দ।

মাঘমণ্ডল ব্রতে মণ্ডলক্রিয়ায় ব্রতিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার ঠাকুমা; Image Source: Author’s Personal Collection 

শ্রীহট্ট-কাছাড়ে আল্পনা থেকে বেশি জনপ্রিয় ছিল এ মণ্ডলক্রিয়া। এ জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ হলো, প্রাচীন জাদুবিশ্বাসজনিত আদিম ধর্মীয় সংস্কার। কিছু বিশেষ বিশেষ চিহ্ন বা প্রতীক অঙ্কন করলে তারই অনুরূপ বিশেষ ধরনের কামনা-বাসনা পরিপূর্ণ হবে- এ ধারণা থেকেই মণ্ডলকর্মের উদ্ভব। ‘মাঘমণ্ডল ব্রত’টিও তার ব্যতিক্রম নয়। রঙের গুঁড়ি দিয়ে নানারকম লতাপাতার নকশা তৈরি করতে করতে সূক্ষ্ণ শিল্পকর্মের সঙ্গে শিশুর মনোজগতের এক যোগসূত্র তৈরি হয়ে ওঠে সেই প্রথম।

তাছাড়া, এত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কুলীন-অকুলীন ফুল-লতা-পাতা সংগ্রহ করতে হয় ব্রতিনীকে যে, অনুষ্ঠানের গোটা  প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে শিখে নেয় প্রকৃতির নাম না জানা অসংখ্য ফুল-পাতার নাম ও তার ব্যবহার। এ ব্রতক্রিয়ায় কোনো পুরোহিতের প্রয়োজন পড়ে না, কিছু মন্ত্র আওড়াতে হয়; তবে তা বৈদিক শাস্ত্রীয় মন্ত্র নয়- দেশীয় ভাষার মিশ্রণে একধরনের ছড়া। ঘরের বয়স্কা নারী, যার সঞ্চালনায় ব্রতক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়, প্রয়োজনে তিনিই আবার তাৎক্ষণিক মন্ত্ররচনা করে দেবারও অধিকারিণী।  

মাটির ভিটিতে সাতাশ রকম প্রতীক চিহ্নে এঁকে ছড়া কেটে কেটে ফুল ধরে দেবার রীতি পালন করেন ব্রতধারিণী। সাধারণত দেখা যায়, একটি অনন্তনাগ এঁকে সুকৌশলে তার মধ্যে সাতাশটি কোঠা তৈরি করা হয় এবং সাপের লেজভাগ ও ফণাভাগ একত্রে এনে উত্তরমুখী করে গড়ে ওঠে এক বিশাল মণ্ডল। বলাই বাহুল্য, একাধিক নারীর যৌথ প্রচেষ্টাতে এই অদ্ভুত শিল্পকর্ম নান্দনিক রূপ পায়। মাটির ভিটির ওপরেই দুটি গর্ত তৈরি করে পুকুর কাটা হয়, একটি চৌকোনো, আর একটি গোলাকৃতি। দূর্বাগুচ্ছ হাতে নিয়ে কল্পিত পুকুরে জল নাড়তে নাড়তে ব্রতিনী মন্ত্রোচ্চারণ করেন।

এরপর সাতাশ রকম অঙ্কিত মণ্ডলচিহ্নের ওপর তিনি ফুল নিবেদন করেন সূর্যদেবতার উদ্দেশে। এই সাতাশ রকম অঙ্কিত  চিহ্নগুলো হলো চাঁদ, সূর্য, পৃথিবী, সিংহাসন, কবলীর গোবর, থালা-ভাত, ভিঙ্গার পানি, তিনকোণ, সমকোণ, মাঘমণ্ডল, সোনার কুণ্ডল, বাপ রাজা, ভাই প্রজা, দোলা, আইঙ্গন-বাইঙ্গন, আটপুজি, আটেশ্বর, তিনকুণ্ডলী, তিনরাজ, সিন্দুর, শাঁখা, চিরুনি, কাজল-আলতা, শাড়ি, কলা-জিয়ারী, দেউ-দুয়ার ও স্বর্গ-দুয়ার।

                               কাঠের পিঁড়িতে অঙ্কিত অনন্তশয্যা; Image Source: Personal Collection 

অঙ্কিত এসব মণ্ডলচিহ্নের সঙ্গে মুখে বলা ছড়ার একটা অর্থ দাঁড় করানো যেতে পারে এরকম, “চন্দ্র-সূর্যের মিলনে পৃথিবী আনন্দে ভেসে উঠল, সেই আনন্দের অংশীদার হয়ে আমি সিংহাসনে বসে ব্রত করছি। কবলীর পদচিহ্ন, কবলী গোবর, থালা ভাত, ভিঙ্গার পানি চতুর্দিকে সব মাঙ্গলিক চিহ্ন, জন্মে জন্মে এয়ো থাকার প্রার্থনা। ত্রিকোণাকৃতি পৃথিবী আর সমকোণাকৃতি রাজ্য পুজে স্বামী পাব, স্বামী যেন রাজ্যেশ্বর হয়, বাবা যেন রাজা হয়, ভাই হয় প্রজা, তাদের কাছে দোলায় চড়ে আসব যাব, দুধভাত খাব, সংসারে কোনো অভাব হবে না। গুঁড়ির সিঁদুর পুজো করছি– পাই যেন চীনা সিঁদুর, গুঁড়ির চিরুণীর বদলে পাই যেন হাতির দাঁতের চিরুনি, গুঁড়ির গয়নাগাটির বদলে যেন জীবনে আসে সোনা-হিরার গয়নাগাটি।“

বাস্তবজীবনে প্রত্যেকটি দ্রব্যসামগ্রীর অনুকরণে কামনা করে এভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করেন ব্রতিনী। একটি পালকি অংকন করা হয়; তাতে একটি কলাগাছ বাঁধা আর তার ভেতরে বসা নববধূ। ছয়জন বেহারা পালকি বহন করে নিয়ে চলেছে, যারা আসলে ষড়রিপুর ছয় প্রতীক আর ভেতরে বসা নববধূ নবজীবনের– চরৈবেতি, অর্থাৎ এগিয়ে চলাই এর মূলমন্ত্র। সবশেষে দেউদুয়ার মানে- দেবতাদের দ্বার আর স্বর্গদ্বার পুজো করছি, আমার পরিবার, গোটা সমাজজীবন যেন সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে। ব্রতের সর্বশেষ অনুষ্ঠান ছাতাঘুরানী বা ছাতাফিরানী পর্ব। মণ্ডলক্রিয়ার উপর পূর্বমুখী হয়ে বসে একটি ছাতা অনবরত ঘোরাতে থাকেন ব্রতিনী। সেই ঘূর্ণায়মান ছাতার উপর তিল, তিসি, চিড়া-মুড়ির নাড়ু ইত্যাদি নানা ভোজ্যদ্রব্য ফেলা হয় আর সেগুলো সংগ্রহের জন্য দর্শকদের মধ্যে চলে আনন্দ-উল্লাসের ধুম।

এসব ক্রিয়া চলাকালীন সমবেত নৃত্য-গীতে বিরতি পড়ে না একেবারেই। বরং অনেকক্ষেত্রেই পেশাদার বাদ্যযন্ত্র-নৃত্যদলকে এনে উৎসবকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। ধনী-দরিদ্র, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রবেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের মাঘব্রত একসময় হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন আনন্দ উৎসবের এক অনন্য নজির।   

মাটির ভিটিতে অংকিত মাঘমণ্ডল ব্রতের অপূর্ব শিল্পকর্ম; Image Source: Personal Collection 

আসলে দেখতে গেলে সমগ্র ব্রতটি শীতের কুয়াশা ভেঙে সুর্যের অভ্যুদয়ের নাট্যরূপান্তর। অন্ধকার কেটে আলোর প্রকাশ হোক সমাজজীবনে, সমস্ত বিশ্বচরাচরে– এর জন্যেই তো এত আয়োজন! এই যে সূর্যের কাছে ঐহিক বর প্রার্থনার ভেতর দিয়ে নারীর মাতৃত্বের একটা সলজ্জ প্রকাশ প্রচ্ছন্ন হয়ে  উঠতে দেখি আমরা, তাতে মনে হতেই পারে ব্রতগুলো যেন ধরে ধরে বাচ্চা মেয়েদের পাকামো শেখানোর জন্যই উদযাপিত। কিন্তু এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে, সেসময়ের পুরুষশাসিত সমাজে গৌরীদান প্রথা ছিল অনিবার্য, অপরিপক্ব বয়স থেকে শিশুমনে গেঁথে দেওয়া হতো স্বামীর সুযোগ্যা ঘরণী হয়ে উঠতে না পারলে বিকল্প কোনো জীবনভাবনা নেই– সেখানে এক কাল্পনিক সুন্দর জীবন লাভের আকুলতাই যে উপাস্য দেবতার কাছে প্রার্থনার আকারে ফুটে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!

তবে সবটাই কাল্পনিক সুন্দর দিয়ে গড়া নয়, এর মধ্যে রয়েছে খানিকটা প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ভাষাও। যে পুরুষশাসিত সমাজে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত হয়নি কোনোকালেই, সেখানে এই মেয়েলি ব্রতগুলো কি সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বঘোষিত প্রতিবাদ নয়? যে নারীকে আমরা পরভর্তৃকারূপে দেখতে অভ্যস্ত, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যাকে পদে পদে পুরুষের ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো গতি নেই, সেই নারী ব্রতানুষ্ঠানে পুরুষের অধিকারকে করেছে নিষিদ্ধ। এমনকি কোনো পৌরোহিত্যের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি ব্রতে, নেই কোনো সংস্কৃত মন্ত্র। মন্ত্রের স্থান নিয়েছে কতগুলো ছড়া আর কথা, যেগুলো নারীদের দ্বারাই রচিত, তাদের দ্বারাই উচ্চারিত।

কিন্তু, পুরুষের ভূমিকাকে একেবারে নাকচ করে দিয়ে যে মেয়েলি ব্রতগুলোর উদ্ভব, বিশেষ করে মাঘব্রত, তা কোনোভাবেই আত্মকেন্দ্রিকতায় পরিসমাপ্ত নয়, বরং নিজের বিচিত্র সব কামনা সফল করতে গিয়ে সে পুরুষবেষ্টিত নিজের বাপ, ভাই, স্বামী এমনকি প্রতিবেশী, গোটা সমাজের মঙ্গল, সুখ, সমৃদ্ধিই বারবার চেয়েছে তার উপাস্য দেবতার কাছে।

                              বিভিন্ন প্রতীকচিহ্নে ফুল ধরে ধরে মন্ত্র পড়ছেন ব্রতিনী; Image Source: Personal Collection 

মাঘমণ্ডল ব্রতের মতোই শ্রীহট্ট-কাছাড়ে মহিলাদের দ্বারা পালিত আরেকটি ব্রতানুষ্ঠান সূর্যব্রত বা কালাঠাকুরের ব্রত। কালাঠাকুর বা ঠাকুরব্রত নামে পরিচিত এ ব্রত হতে পারে কোনো অনার্য সমাজের ধর্মঠাকুরের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। যেকোনো বয়সের মহিলারাই এই ব্রতটি করতে পারেন। মাঘমাসের কোনো এক রবিবার উপবাস করে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গোটা দিন দাঁড়িয়ে থেকে ব্রতিনীরা এ অনুষ্ঠান পালন করেন। প্রহরে প্রহরে জ্বলন্ত ঘিয়ের প্রদীপ হাতে নিয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করেন ব্রতিনীরা। মাঘব্রতের মতো এখানেও একটি মাটির ভিটি প্রস্তুত করে মণ্ডলক্রিয়ার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয় নানারকম বিষয়বস্তু; যেমন- কদমগাছ, গাছের নিচে রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি, চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবী, নানারকম নকশা, রাধার বিভিন্ন অলংকার ইত্যাদি। তবে মাঘব্রতের মতো এই ব্রতটিকে খাঁটি মেয়েলি ব্রত বলা যাবে না। তার কারণ, এখানে দেখা যায় বিভিন্ন লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কিছু বৈদিক শাস্ত্রীয় আচার পালনের রীতি। নারীদের দ্বারা পালিত এ ব্রতে পুরোহিত এসে পুজো করেন বিষ্ণু শালগ্রাম শিলা, উচ্চারিত হয় পুরোহিত কণ্ঠে সংস্কৃত মন্ত্র।

সাধারণত মেয়েলি ব্রতের পুরোহিত হন মেয়েরা নিজেরাই, কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কোনো প্রয়োজন এতে হয় না। কিন্তু সূর্যব্রত এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। বাংলাদেশে একসময় আর্যসভ্যতা বিস্তৃত হওয়ার আগে যে লৌকিক সূর্যপূজার অস্তিত্ব বর্তমান ছিল কৃষিসমাজে, পরবর্তীকালে ব্যাপক আর্যীকরণের ফলে সে ধারাই কতকটা বদলে গিয়ে বর্তমান আকার ধারণ করেছে। তবু বদল হতে হতে সবটাই যে হারিয়ে যায়নি তার প্রমাণ, ঘ্রাণ নিলে ভেতরে এখনও পাওয়া যায় তার আদিম সুবাস।

সূর্যব্রতে ঘিয়ের প্রদীপ হাতে নিয়ে ব্রতিনীরা। পাশে বড় করতাল বাজিয়ে কৃষ্ণলীলার গীত গাইছেন নারীরা; Image Source: Personal Collection 

সূর্যব্রতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো নারীদের দ্বারা বৃত্তাকারে অনুষ্ঠিত ধামাইল গান ও নৃত্য। পরিবার-প্রতিবেশীর বিভিন্ন বয়সের মহিলারা একত্র হয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা থেকে গোষ্ঠলীলার বিভিন্ন কাহিনী নৃত্য-গীত সহকারে বড় করতাল বাজিয়ে পরিবেশন করেন। শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার এই কাহিনি-গীতগুলোও বেশ মজাদার। গোপবালকদের সঙ্গে কৃষ্ণ গোচারণে যাবেন, কিন্তু মা যশোদার ছোট্ট কৃষ্ণকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই, পথে কত ভয়! মায়ের মন কিছুতেই প্রবোধ মানে না। তাই বারবার তিনি সতর্ক করে দিচ্ছেন অগ্রজ বলরাম ও দলের অন্যান্য বালকদের, তারা যেন কৃষ্ণকে চোখে না হারায়।

খুব গভীরভাবে বিষয়টা চিন্তা করলে সমাজের দুটো স্রোতধারাকে আমরা এখানে একসাথে পাশাপাশি দেখতে পাই, একটি পুরোহিত ব্রাহ্মণ্যশাসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, আরেকটি শাস্ত্রধর্ম বহির্ভূত নারীসমাজ। যে নারীসমাজ মনে করেন, ধর্মীয় সাধনায় আরাধ্য দেবতার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির জন্য কোনো মধ্যপন্থা, কোনো বৈদিক মন্ত্র, কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত ব্যক্তিবিশেষের উপর তারা নির্ভরশীল নন। ঘন ঘন করতাল ধ্বনির সঙ্গে মহিলাদের দ্রুত পদচারণা আর তার সঙ্গে একাধিক নারীকণ্ঠে আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কৃষ্ণকীর্তন– সব মিলে কোথাও যেন মনে হয় পুরোহিততন্ত্রকে ছাপিয়ে ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত’ মুখ্য হয়ে ওঠে চারপাশে। শাস্ত্রের চেয়ে গানই এখানে বড়, যে গান দিয়েই তারা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন আনুষ্ঠানিক মন্ত্র-তন্ত্রকে। শাস্ত্রের ভগবানকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক শ্লোক চলে, কিন্তু শাস্ত্র বহির্ভূত যে ভগবান, সমস্ত উপাসনালয় ছাড়িয়ে ভক্ত হৃদয়ে যার অধিষ্ঠান– একমাত্র তার কাছেই এভাবে আনন্দ-উল্লাসে আত্মনিবেদন করা যায়। সেই গানের ভাষাও হয় একান্তই নিজস্ব, তা নাহলে সেই আহবান তার কাছে গিয়ে পৌঁছবে কী করে!  

সংস্কৃতের আবরণ ভেদ করে আত্মকণ্ঠে এভাবেই গান গেয়েছিলেন রাজস্থানের মীরাবাঈ, গেয়েছিলেন আসামের শ্রীমন্ত শংকরদেব, পাঞ্জাবের গুরুনানক আবার কখনো বাংলাদেশের চৈতন্য মহাপ্রভু। ভক্তি আন্দোলনের এটা একটা মস্ত বড় দিক। আত্মকণ্ঠের এই মগ্নতাই যদি বলি আমরা দেখতে পাই এসব গ্রামীণ ব্রতাচারে পালিত নারীদের ধর্ম সাধনায়, তাহলে খুব ভুল বলা হয় কি? বোধহয় না, ভগবানের সঙ্গে ভক্তহৃদয়ের মিলনের জন্য কোনো মন্ত্রের আড়াল এরা রাখেননি, তেমনি রাখেননি কোনো শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিক আড়ম্বর।

মাঘব্রত হোক কিংবা সূর্যব্রত, সেদিক থেকে বিচার করলে এই লোকাচারকেন্দ্রিক ব্রতানুষ্ঠানগুলো যেন সামন্ততন্ত্র সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ। তবে সমাজ ইতিহাসের ধারায় এগুলোর গুরুত্ব এতটাই যে, অবক্ষয়গ্রস্ত হয়েও আজ সংহত জীবনভাবনার রূপায়ণে সেগুলো আমাদের নতুন করে পথ দেখায়।

This article is in Bangla. It is about a lost cultural and religious ritual- Brata. 

Reference Books: 

1. গ্রামীণ নৃত্যকলা- মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য (কাছাড়-শ্রীহট্টের মাঘব্রত, পৃষ্ঠা- ১১৩)

2. লোকসংস্কৃতির সুলুক সন্ধানে- বরুনকুমার চক্রবর্তী

3. গান হতে গানে- সুধীর চক্রবর্তী (শাস্ত্র থেকে গান বড়, পৃঃ- ৩৫)

Featured Image: Bharat Barta

 

Related Articles

Exit mobile version