২৩ মার্চ, ১৯৭১। শহীদ মিনারে ইয়াহিয়া খানের বিকৃত ১০টি ছবি ঝুলছে। ছবিগুলোর নিচে লেখা ছিল “এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে”। তারপর এ দেশের ইতিহাসের বর্বরতম ভয়াল ২৫শে মার্চের কালরাত কেটে গেছে। পরেরদিন ছবিটা আবারও ফিরে এসেছে, তবে এবার নিচের লেখাটা বদলে গেছে। আগে লেখা ছিল “এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে”, পরে সেটা হয়েছে “এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে”। একজন প্রকৃত শিল্পী, যিনি আগেই বুঝতে পারেন কী ঘটতে যাচ্ছে এবং যিনি বলতে পারেন কী করতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে যিনি জানোয়ারদের আসল রূপ উন্মোচন করতে পারেন, তিনিই তো প্রকৃত শিল্পী। মানুষ হয়ে জন্মালেও প্রকৃত অর্থে ইয়াহিয়া খান অন্তরে তো এমনই ছিলেন? আর এই রূপটাই বের করে আনতে পারেন, যারা মানুষের ভেতরটা পড়তে পারেন। বলছিলাম চিত্রকর কামরুল হাসানের কথা।
পটুয়া কামরুল হাসান একাত্তরে ইয়াহিয়া খানের ছবি উল্লেখ করে তাকে হত্যা করতে চেয়েছেন। কেন চেয়েছেন, সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলছেন,
“আমার নিজের স্মৃতিতে খুব উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তাঁর আঁকা একটি ছবি, অনেক আগে আঁকা, সেই ১৯৪৮-এ, পাকিস্তান যখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছবির নাম ‘উঁকি’। একটা মেয়ে, অল্প বয়স তার, কিশোরী, মাটির ঘরের বাঁশের জানালাটা খুলে উঁকি দিচ্ছে বাইরে। বাইরের জগৎ দেখতে চাইছে। চোখে তার রাজ্যের কৌতূহল; কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও। সেটা বোঝা যায় মাথার ওপর আঁচল টেনে দেওয়া দেখে। কথা ছিল এ মেয়ে মাঠে গিয়ে খেলবে, অন্যদের সঙ্গে মিলে নাচবে, গাইবে। তালে তালে দেবে তালি। কিন্তু সে বন্দী হয়ে আছে, ঘরে। ঘরের ভেতরে পানির কলস আছে একটা, রয়েছে ধানের মটকিও। তারা নিশ্চিন্তে রয়েছে। মেয়েটি নেই। মেয়েটি চঞ্চল, সেজন্য জীবন্ত এবং সে জন্যই এই ঘর তার জন্য কারাগারবিশেষ। বাইরে যেতে নিষেধ। কার নিষেধ? অবশ্যই শত্রুদের। এই শুত্রুরা পশুবিশেষ।”
সে কারণেই এই পশু তথা জানোয়ারকে হত্যা করতে চেয়েছেন কামরুল হাসান। হত্যার আনন্দ নেয়ার জন্য নয়, চেয়েছেন কিশোরীকে মুক্ত করতে। যে মুক্তির আশা মানুষ দেখেছিল ১৯৪৭ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তবে সে মুক্তি ঘটেনি এখনও। আরও বিস্তারিত জানা যাবে কামরুল হাসানের শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প জানার মাধ্যমে।
ব্রতচারী কামরুল হাসান
১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন কামরুল হাসান। পিতা মোহাম্মদ হাসিম ছিলেন গোরস্থানের সুপারিনটেন্ডেন্ট। কলকাতা সাধারণত ছিল হিন্দুবেষ্টিত এলাকা, এর মধ্যে তিনি জন্ম নিয়েছেন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। একদিকে নিজেকে মেলে ধরবার হাতছানি, অন্যদিকে সংস্কার ধরে রাখবার চেষ্টায় লিপ্ত মুসলমান পরিবার। দুয়ে মিলে কামরুল হাসানকে বেগ পেতে হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই।
শিল্পচর্চায় কামরুল হাসানের হাতেখড়ি হয় ব্রতচারী আন্দোলনের মাধ্যমে। সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৩২ সালে উৎপত্তি লাভ করা এ আন্দোলনে কামরুল হাসান যোগ দেন খুব অল্প বয়সে। মূলত দেশপ্রেম সৃষ্টিই ছিল এ আন্দোলনের লক্ষ্য। তাই ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকেও এ আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার কোনো বাধা প্রধান করেনি বরং সমর্থন জানিয়েছে ব্রতচারীদের। এই ব্রতচারী আন্দোলনের সাথে থেকে লোকনৃত্য ও লোকসঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি দেশের প্রতি একধরনের টান অনুভব করতে শুরু করেন কামরুল হাসান। ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখাও শুরু হয় সেখান থেকেই। একসময় ব্রতচারী আন্দোলন থেমে গেলেও থামেননি কামরুল হাসান।
ছোটবেলা থেকেই বিদ্রোহী স্বভাব ও ছবি আঁকার প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে বড় হতে হয়েছে কামরুল হাসানকে। তাই পরিবারের সাথে বিদ্রোহ করেই ১৯৮৩ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি হয়ে উঠছিলেন সংগঠকও। সেসময়েই হাতে লেখা দেয়ালিকা বের করতেন তিনি। সেখানে গল্প, কবিতা, ছবি সবই থাকতো। হাতে লিখে লিখে বের করেছেন ঈদ সংখ্যাও। কাজ করেছেন বয়েজ স্কাউটে, ছিলেন শরীরচর্চা বিশারদও। ১৯৪৫ সালে শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘মিস্টার বেঙ্গল’ উপাধিও লাভ করেন।
বাংলাদেশে আগমন ও জীবন যাত্রা
দেশভাগের সময় পিতাকে হারিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। ভেবেছিলেন, এবার মুক্তি মিলেছে। কিন্তু তখন দেখা গেল একজন এপিডিআই সরকারি নথিতে লিখেছেন, ইসলামী একটি দেশে ছবি আঁকার স্কুল থাকতে পারে না। এই বক্তব্য সে সময়ে ছবি আঁকার প্রতিকূল পরিবেশের চিত্র স্পষ্ট করে তুলে আমাদের সামনে। ছবি একে উপার্জন তো কল্পনার অতীত। তবে হাল ছাড়েননি কামরুল হাসান। জয়নুল আবেদীনের সাথে মিলে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট স্কুল, যা বর্তমানে চারুকলা অনুষদ হিসেবে পরিচিত। সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক সচেতন এক ব্যক্তিত্ব। যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে তার সরব উপস্থিতির কথা শুনতে পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার একটি চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবার কথা ছিল। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি তা স্থগিত করেছিলেন। ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন সক্রিয়। ৭১ এ ২৫শে মার্চের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। যুদ্ধকালীন তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন।
তারপর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো, কিন্তু মানুষ মুক্তি পেলো না। বন্ধ হলো না কামরুল হাসানের সংগ্রামও। ১৯৮৮ সালে জাতীয় কবিতা উৎসবে সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি। সে সভাতে আবারও তার বিদ্রোহের ছাপ রাখেন তিনি। ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শীর্ষক ব্যঙ্গচিত্রটি আঁকেন সেখানে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে ব্যঙ্গ করেই জনসম্মুখে এই স্কেচটি সম্পন্ন করেন। বিদ্রোহ ছিল তার মননে, মগজে। তাই বিদ্রোহী অবস্থাতেই সেদিন সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তবে মরে গিয়েও বিদ্রোহ ছাড়েননি তিনি। তার সৃষ্টি আজও মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে। আজও মানুষ চেষ্টা করে সেi কিশোরীটিকে মুক্ত করতে যে উঁকি দিয়ে দেখছে, দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা।
কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম ও অবদান
কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম বাংলাদেশের লোকশিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। মৌলিক রঙ ব্যবহার করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন কামরুল হাসান। রেখার ব্যবহারে দেখা গেলো, তিনি ছবি যতটা আঁকছেন, তার চেয়ে পার্শ্বচিত্র বেশি ফুটে উঠছে। এতে ছবি ত্রিমাত্রিকতার পাশাপাশি নতুন পটে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। তার রঙ লেপন এবং তৈল রঙের ব্যবহার ছবিকে আরও জীবন্ত করে আমাদের সামনে হাজির করে।
কামরুল হাসানের বেশিরভাগ ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে নারী। কখনো একলা নারী, কখনো দলবদ্ধ। সেখানে নারীকে আমরা পেয়েছি খুবই বাস্তবিকভাবেই। নারীর অবয়ব, কোমলতা, কৌতূহল, ভয় সবকিছুই ফুটে উঠেছে সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সঙ্গতি রেখে। চিত্রগুলো ঠিক যেন আমাদের গ্রাম-বাংলারই প্রকৃত চিত্র। দেখতে গেলে এক ধরনের ঘোর তৈরি হয় নিজের মধ্যে। আবার বেশিক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকাও যায় না। মায়াময় অপূর্ব এক মিশ্রণ তৈরি করে রেখে দিয়ে গেছেন তরুণ প্রজন্মের জন্যে। চিত্রকলায় লৌকিকতার সাথে ঘটিয়েছেন আধুনিকতার মিশ্রণ, তাই তাকে মানুষ ডাকে ‘পটুয়া’ নামে। তিনি নিজেও এ পরিচয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকতেন।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার বর্তমান যে ডিজাইন, তা কামরুল হাসানের হাতেই করা হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, বিমান বাংলাদেশের লোগোসহ প্রায় চার হাজারের মতো কাজ নিজ হাতে করেছেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাস যতদিন থাকবে, ততদিনই এদেশের মানুষের স্মরণ করতে হবে কামরুল হাসানের মতো সময়ের আগে হাঁটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে।