তারা মনে করে আমি সুরিয়ালিস্ট, কিন্তু কখনোই না। ঘুণাক্ষরেও আমি স্বপ্ন আঁকিনি। আমি শুধু আমার একান্ত বাস্তবতাকে এঁকে গেলাম।
ফ্রিদা কাহলো নিজেকে নিয়ে এমন মন্তব্য করলেও কথাটা আরো তীব্রভাবে সত্য রব গনজালভেসের জন্য। শিল্পকে যিনি নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়। দিয়েছেন স্বতন্ত্র পৃথিবী, যেখানে মিলেমিশে একাকার বাস্তবতা আর শিল্পীর নিজস্ব কল্পনা। ঝর্ণা রূপ নিয়েছে নৃত্যরত নারীর। সিঁড়ি উঠে গেছে মহাবিশ্বকে ছাপিয়ে। দোলনায় দুলতে থাকা শিশু যেন গোটা পৃথিবীকেই নিচে ফেলে দুলছে।
তাঁর প্রত্যেকটি চিত্রের দিকে তাকালে প্রথম দফায় চোখ আটকে যায় বিস্ময়ে। কখনও বোঝা যায় অন্তর্গত তাৎপর্য, না বুঝতে পারলেও ক্ষতি নেই। রব গনজালভেসের পৃথিবীতে ভ্রমণ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সঞ্চার করবে যে কারো। নিজের সম্পর্কে তার মত,
স্বপ্নবিলাস ও আঁকাআঁকিতে ভরা একটা শৈশব বিবর্তিত হয়েছে চিত্র তৈরির পেশায়। এ যেন নিজের কল্পনাগুলোকে উদযাপন করা।
সুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ
১৯২৪ সালের দিকে প্যারিস থেকে আন্দ্রে ব্রেতোঁ শিল্পে এক নতুন আন্দোলনের ডাক দিলেন। দাবি জানালেন, আঠারো ও উনিশ শতকে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আধিপত্য করেছে, তা ছিলো অতিমাত্রায় যুক্তি নির্ভর। সেখানে তীব্রভাবে অবহেলিত হয়েছে মানুষের ভেতরের অবচেতন সত্তা। মানুষের মন, চিন্তা, ভাষা এবং অভিজ্ঞতাকে যুক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করাই পরম বাস্তবতা বা সুপার রিয়ালিটি। সুরিয়ালিজম মূলত এখান থেকেই উৎসারিত।
ব্রেতোঁ চিকিৎসা ও মনোবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের রচনার মাধ্যমে। বিশেষ করে স্বপ্নের উৎপত্তি নিয়ে ফ্রয়েড অবচেতন মনের যে ধারণার উত্থাপন করেছেন তা। আর খাটি মার্ক্সবাদীর মতো সামাজিক যৌক্তিক বেড়াজাল থেকে মনকে মুক্ত করার আন্দোলন শুরু করলেন সুরিয়ালিজমের মাধ্যমে। আস্তে আস্তে সাহিত্য, চিত্র, সিনেমা, গান, রাজনীতি, দর্শন এমনকি সমাজবিজ্ঞানেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো। আন্দোলনে ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী আন্দ্রে ব্রেতো, জোয়ান মিরো, সালভেদর ডালি, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ। রব গনজালভেস সমসাময়িক যুগের সুরিয়ালিস্ট, যার শৈল্পিক আঁচড়ে রূপ পেয়েছে এক অনন্য জগৎ।
রব গনজালভেস
রবার্ট গনজালভেস ১৯৫৯ সালের ২৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন; কানাডার টরোন্টোতে। বাবা এলেন গনজালভেস এবং মা রুথ গনজালভেস। দুই সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় রব। শৈশব থেকেই শিল্পের প্রতি তার টান মা রুথের ভাষাতেই প্রমাণ মেলে।
যদি রবকে প্রয়োজন হতো, তবে তাকে পাওয়া যেত নিজের রুমেই কিংব বাসার কোনো এককোণে। দেখা যেত চুপচাপ আঁকছে। তার ছিল প্রখর কল্পনাশক্তি এবং পৃথিবীকে দেখার ভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গি।
মাত্র বারো বছর বয়স থেকেই স্থাপত্যের প্রতি তার আগ্রহের প্রমাণ মেলে। পেইন্টিংগুলোতে সেই স্থাপত্যকে সজ্জিত করা হয় কল্পনার ইট দিয়ে। রবের নিজের কথা অনেকটা এমন,
স্থাপত্যের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালে টরোন্টোতে চিত্র প্রদর্শনীতে আমার চিত্রকর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহী প্রতিক্রিয়ায় ভাবিত হলাম। পুরোদমে শুরু করলাম আঁকার কাজ।
পড়াশোনা ও পেশাজীবন
অন্টারিও কলেজ অফ আর্ট এন্ড ডিজাইনে রব পড়াশোনা করেন। তারপর সেখান থেকে চলে যান রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অধ্যয়নের জন্য। দুই বছর স্থপতি হিসেবে কাজ করার পরেই মূলত টরোন্টোতে সেই প্রদর্শনী হয়, যা তার জীবনে মাইলফলক হয়ে আছে।
নিউ ইয়র্ক এবং লস এঞ্জেলসে তার চিত্র প্রদর্শনী হয়। শিল্পামোদীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেরি হয়নি। দ্রুত প্রদর্শনী হয় ডেকোর আটলান্টা, লাস ভেগাস এবং ফাইন আর্ট ফোরামসহ অন্যান্য অনেক স্থানে ও প্রতিষ্ঠানে। হাকলবেরি ফাইন আর্ট তাকে নিয়ে প্রকাশনাও বের করে।
অনন্য সৃষ্টিকর্ম
তাকে প্রথম সামনে এনে দিয়েছিলো একটি বইয়ের প্রচ্ছদ; নাম- Masters of Deception: Escher, Dali and the Artists of Optical Illusion। ২০০৩ সালের জুন মাসে তার ১৬টি চিত্র নিয়ে প্রথম বই বের হয় “Imagine a Night” নামে। পরের বছর বের হয় Imagine a Day, যা শিশুসাহিত্য বিভাগে ‘Governor General’s Award’ লাভ করে ২০০৫ সালে। তার অপর দুটি বই যথাক্রমে Imagine a Place (2008) এবং Imagine a World (2015)।
সুরিয়ালিস্টদের প্রভাব
বয়স তখন ত্রিশের দিকে। পরিচয় ঘটলো জনপ্রিয় সুরিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদর দালি, ম্যাগ্রিটে এবং এশ্চারের সৃষ্টিকর্মের সাথে। পরবর্তী জীবনে তাকেও আচ্ছন্ন করে রাখে আঁকার এই নতুন ধারা। বিশেষ করে এশ্চারের প্রভাব ছিলো অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত।
তার আঁকাআঁকিকে সুরিয়ালিস্ট হিসাবে আখ্যা দেয়া হলেও ম্যাজিক রিয়ালিজম বা যাদু বাস্তবতা কথাটা সম্ভবত বেশি খাপ খায়। তিনি অবচেতন মনকে বিমুক্ত করার চেয়ে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে যাদু এবং বাস্তবকে একত্রিত করাতে দৃঢ় ছিলেন। তার কাজ ছিলো মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে উপস্থাপন করার জন্য। অসম্ভবকে সম্ভাবনার সীমানায় নামিয়ে আনার জন্য।
সূক্ষ্মতা ও দীর্ঘসূত্রিতা
রবের মতে, শিল্পে মায়া মানে প্রতারণা না। বরং যাদুময় পৃথিবী তৈরি করার একটা অস্ত্র। অনেকের কাছে দুটি ভিন্ন পৃথিবীকে সংযোগ করার চিন্তা পাগলামীর মতো মনে হলেও রব তা সম্ভব করেছেন অনায়াসে। চিত্রে ত্রিমাত্রিকতা আনার মধ্যেই স্থির থাকেননি। বিষয়বস্তু ও চিন্তার পটভূমির জন্য নিজে নির্ধারণ করেছেন, তার কী প্রয়োজন। এজন্য প্রচুর খসড়া স্কেচ আঁকতে হয়েছে। রবের দাবি অনুযায়ী, তিনি তার ষাট শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন কেবল প্রস্তুতিপর্বে।
উপভোগ করার মতো করে দিনের পর দিন একই ক্যানভাস সামনে নিয়ে বসতেন। সত্যিকার প্রকৃতির সাথে মানবমনের সৃষ্ট প্রকৃতির মিলন ঘটতো যেখানে, মূলত সেখান থেকেই বিস্ময়ের শুরু। বৃক্ষ আচ্ছাদিত শান্ত লেক চিত্রের নিচের দিকে। চোখ যখন আস্তে আস্তে উপরের দিকে যাবে, দেখা যাবে তারার আলো পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ছে। যদি আরো কাছ থেকে গভীরভাবে তাকানো যায়, দেখা যাবে তারকাখচিত ইউরোপকে।
গণিত ও স্থাপত্যের প্রভাব
কৈশোর থেকেই প্রতীক, রূপক এবং শিল্পে সুরিয়ালিজম নিয়ে তার আগ্রহ সৃজনশীলতাকে ব্যতিক্রমী করে তোলে। অবচেতন মনকে স্বাধীন করে চিত্রাঙ্কন করলেও সাহসের অভাবে পেশা হিসাবে নেননি। কিন্তু টরন্টোতে প্রদর্শনীর পর তার ভয় কেটে যায়।
তিনি তার শিখে আসা গণিত এবং স্থাপত্য জ্ঞান এখানে প্রয়োগ করতে থাকেন। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করে রেনে ম্যাগ্রিটের সৃষ্টিকর্ম। সেই সাথে গুরুত্ব দেন প্রেক্ষাপট তৈরির প্রতি। মাঝে মাঝে রব জীবনের দ্বৈততা থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আঁকার। মানুষ বনাম প্রকৃতি, গ্রাম বনাম শহর, আধ্যাত্মিক বনাম জাগতিক, আলো বনাম অন্ধকার ইত্যাদি। কিন্তু একটি থেকে আরেকটি রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে তার সৃজনশীলতা ছিলো বিস্ময়কর উচ্চতায়।
জাদুকে মেনে নেয়া
রব গনজালভেসের মতে, জাদু জীবনের আবশ্যকীয় অংশ। আমাদেরকে তা মেনে নেবার মতো হয়ে উঠতে হবে। শুধুমাত্র তখনই কেউ চিত্রগুলো তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে। বাস্তবিকভাবেই রব তাই করছিলেন। জীবনের বাঁক থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানা অভিজ্ঞতার সাথে অত্যন্ত যত্নের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন জাদুময় পৃথিবীকে।
শেষের আগে
সঙ্গীতের সাথে জীবনের লম্বা একটা সময় যোগাযোগ ছিলো তার। সাজ-বাজানোর প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা দেখা যায়। তার সর্বশেষ চিত্রকর্মটি এক যুবকের, যে একটি সরু ডাল বেয়ে গাছে উঠছে। গাছটি একটা পুকুরের উপর। পুকুরের পানি অনেকটা বাইরে থেকে দেখা পৃথিবীর মতো। পৃথিবীর দিকে তরুণের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখ সোজা অজস্র তারা এবং মহাশূন্যের বিশালতার প্রতি।
রব গনজালভেস হয়তো আরো অনেকদিন বাঁচতে পারতেন। উপহার দিতে পারতেন আরো অজস্র সৃষ্টিকর্ম। কিন্তু তা হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেন ২০১৭ সালের ১৪ই জুন।