অলস বিকেলে, পারিবারিক কোনো সঙ্গীত-সন্ধ্যায়, কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় গিটার না হলে অনেকেরই চলে না। সুর ও সঙ্গীতের সমঝদার-ভক্ত যারা, তাদের কাছে তো বটেই, যারা সুর-সঙ্গীত নিয়ে ধারণা কম রাখেন, তাদের কাছেও অবসরের অন্যতম প্রধান বিনোদন গিটার।
সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় সবারই প্রিয় বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় খুব সহজেই ছয় তারের গিটারের নাম এসে পড়ে। এই গিটার বাজাতে হয়তো অনেকেই পারে, কিন্তু গিটারের পেছনের কথা কয়জনই বা জানে? আজ আমরা জেনে নেব গিটারের বিশদ ইতিহাস, গিটারের ধরন, তৈরির কলাকৌশল ও গিটারের বিভিন্ন অংশের নাম।
বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গিটারের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এর বুৎপত্তি নিয়েও প্রচলিত আছে নানা মত। পৌরাণিক গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর হাতে যে বর্গাকার তারের যন্ত্রটি দেখা যেত, তা থেকেই মূলত গিটারের ধারণাটি এসেছে বলে অনেকের ধারণা। তবে লেখক মরিস জে. সামারফিল্ড এর মতে, স্পেনে ৪০০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম প্রাচীন রোমানরা ‘সিথারা’ নামক একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসেন, যা থেকেই পরবর্তীতে গিটারের উদ্ভব। আবার রোমানদের এই সিথারার অনুপ্রেরণা এসেছে গ্রিকদেরই প্রাচীন একটি বাদ্যযন্ত্র হতে।
কারো কারো মতে, প্রাচীনকালে আরবরা ‘উদ’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত, যেটির বিবর্তিত রূপ হচ্ছে বর্তমান গিটার। আবার অনেকের মতে, চার তার সম্বলিত ‘তানবুর’ নামক বাদ্যযন্ত্র থেকেই পরবর্তীকালে গিটারের উদ্ভব।
খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ শতকে বর্তমান সিরিয়ায় ‘হিটরাইট’ নামক এক জাতি বাস করত, তারা এই ‘তানবুর’ বাজাত, যেটিকে আমরা বর্তমানে তানপুরা হিসেবে চিনি। ফলে দেখা যাচ্ছে, আকস্মিকভাবে নয়, বরং বিবর্তনের পথ ধরেই নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিটার পেয়েছে তার আজকের রূপটি।
১২০০ সালের দিকে চার তার বিশিষ্ট গিটারের দুটি রূপ বের হয়, যার একটি হচ্ছে ‘মুরিশ গিটার‘। মুরিশ গিটারের পেছনের দিকটা হতো গোলাকার আর ফ্রেটবোর্ড হতো কিছুটা কম প্রশ্বস্ত, সেই সঙ্গে থাকতো বেশ কয়েকটি সাউন্ড হোল।
চার তার বিশিষ্ট প্রাচীন গিটারের অপর প্রকরণটি হচ্ছে ল্যাটিন গিটার। ল্যাটিন গিটারে মাত্র একটি সাউন্ড হোল ও প্রশস্ত একটি ফ্রেটবোর্ড থাকতো।
১৭৮৮ সালের দিকে এসে জ্যাকব অটো নামে একজন প্রখ্যাত জার্মান বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা পাঁচ তার বিশিষ্ট গিটারে ৬ষ্ঠ তার সংযোজিত করেন, যা পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত সে সময় থেকেই ছয় তারের গিটারের আনুষ্ঠানিক প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীকালে ১৯ শতকের শুরুতে স্পেনের অগাস্টিন কারো, ম্যানুয়াল গিটারেজ এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান গিটার প্রস্তুতকারক গিটারকে আরো পরিমার্জিত করে সেই রূপটিই প্রদান করেন, যেটি বর্তমানে আমরা দেখে থাকি।
স্ট্রিং বা তারের ধরনের ওপর ভিত্তি করে গিটার প্রধানত ২ প্রকার- ১) স্টিল স্ট্রিং গিটার; ও ২) নাইলন স্ট্রিং গিটার।
স্টিল স্ট্রিং গিটার মূলত সচরাচর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিকতর দেখা যায়। এই গিটারের তারগুলি সাধারণত ধাতব হয়ে থাকে। মূলত ইলেক্ট্রিক গিটার ও বেজ গিটারের ক্ষেত্রে সবসময়ই স্টিল স্ট্রিং হয়ে থাকে।
স্প্যানিশ গিটারে নাইনল বা স্টিল স্ট্রিং দুই ধরনের তারের ব্যবহারই দেখা যায়। নাইনল স্ট্রিং এর গিটারকে সাধারণভাবে ক্লাসিক্যাল গিটার হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। বাজাতে আরামদায়ক ও সুন্দর শব্দের জন্যে সলো পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে সবার প্রথম পছন্দ থাকে নাইনল স্ট্রিংয়ের গিটার। তবে ব্যান্ড শোয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত নাইনল স্ট্রিংয়ের গিটারের ব্যবহার কম দেখা যায়।
আবার স্ট্রিং বা তারের সংখ্যা এবং গিটারের আকৃতির উপর ভিত্তি করে গিটার মূলত তিন প্রকার- ১) স্প্যানিশ গিটার; ২) হাওয়াইয়ান গিটার; এবং ৩) বেজ গিটার।
স্প্যানিশ গিটার মূলত পাশ্চাত্য ঘরানার সঙ্গীতের একটি অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যখন ৭০-এর দশকে ব্যান্ড-সঙ্গীতের চর্চা শুরু হয়, গুরু আজম খান ও ফকির আলমগীরদের হাত ধরে পপ গান বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনে নিয়ে আসে নতুন ধারা। মূলত সে সময় থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে স্প্যানিশ গিটারের প্রভাব জোরেশোরে শুরু হয়।
স্প্যানিশ গিটার বলতে প্রধানত ছয় তারের গিটারকে বোঝায়। অর্থাৎ প্রচলিত যে গিটারের সাথে আমরা পরিচিত, সেগুলোর বেশিরভাগই স্প্যানিশ গিটারের অন্তর্ভুক্ত। যেসকল স্প্যানিশ গিটারের বৈদ্যুতিক আউটপুট থাকে না, সেগুলোকে পিওর অ্যাকুয়িস্টিক গিটার বলা হয়ে থাকে। এই স্প্যানিশ গিটারও কয়েকরকম। ১) অ্যাকুয়িস্টিক; ২) ক্লাসিক্যাল; ৩) ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক ইত্যাদি।
অ্যাকুয়িস্টিক বা ক্লাসিক্যাল গিটার বলতে মূলত উপরে আলোচিত সাধারণত গিটারগুলোকেই বোঝায়। মোটামুটি বড় সাইজের বডি থাকে এসব গিটারে।
গিটারের স্ট্রিংয়ের কম্পন গিটারের ভেতরের বাতাসকে আন্দোলিত করার কারণে এ ধরনের গিটারের শব্দ উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে ইলেকট্রিক গিটারের ক্ষেত্রে (রিফ, লিড, বেজ) মূলত বিদ্যুৎ তরঙ্গকে শব্দে রূপান্তর করা হয়ে থাকে। এ কারণে এ ধরনের গিটারের টিউন পরিবর্তন করে গিটারিস্ট নিজের পছন্দমতো বিভিন্ন ভ্যারিয়েশনের সাউন্ড উৎপন্ন করতে পারেন। তবে এ ধরনের গিটারের সীমাবদ্ধতা হলো, বৈদ্যুতিক সংযোগ ব্যতীত এদের ব্যবহার করা যায় না।
আবার ফ্ল্যামেনকো গিটার নামের এক জাতের গিটার আছে, যাকে এক ধরনের স্প্যানিশ গিটারই ধরা হয়ে থাকে। স্পেনের বিখ্যাত ফ্ল্যামেনকো মিউজিকে এ ধরনের গিটার ব্যবহার হয় বলেই এই গিটারের এমন নামকরণ।
এর বাইরেও নানা নামে নানানরকম গিটার আছে। তবে সেগুলো গিটারের প্রধান শ্রেণিবিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং অনেকটা উপশ্রেণি হিসেবেই পরিচিত। যেমন স্টিল স্ট্রিং গিটারকে যদি আমরা প্রধান শ্রেণি ধরে নিই, সেক্ষেত্রে কিছু গিটার যেমন, রিফ গিটার, লিড গিটার, বেজ গিটার, হাওয়াইন গিটার ইত্যাদিকে আমরা উপশ্রেণি হিসেবে ধরে নিতে পারি।
তো এই থেকে বোঝা যায়, রেস্তোরাঁয় মূল মেন্যুর পাশাপাশি যেমন বিভিন্ন সাব মেন্যু থাকে, তেমনি এক এক শ্রেণির গিটারের মাঝে সাব মেন্যুর মতো বিভিন্ন উপশ্রেণির গিটার আছে।
একটি গিটারের বেশ কিছু অংশ রয়েছে। গিটারের একদম উপরের দিকে যে চারকোনা একটি অংশ থাকে, তাকে হেডস্টক (Headstock) বলা হয়। হেডস্টকে গিটারভেদে চারটি, পাঁচটি, ছয়টি এমনকি আটটি পর্যন্ত টিউনিং কি থাকে। এগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুরিয়ে গিটারের টিউন ঠিক করা হয়।
গিটারের যে লম্বা অংশটিতে স্ট্রিংগুলো বিন্যস্ত থাকে, তাকে ফিংগারবোর্ড বা ফ্রেটবোর্ড বলে। ফ্রেটবোর্ডে ছোট ছোট উচুঁ ধাতব রেখার মতো অংশগুলোকে বলা হয় ফ্রেট। গিটারভেদে বিভিন্ন সংখ্যায় ফ্রেট থেকে থাকে। তবে সাধারণত ২১ বা ২৩ ফ্রেটবিশিষ্ট গিটারই বর্তমানে বেশি প্রচলিত।
গিটারের মূল বডি বলতে নিচের দিকের চওড়া অংশটিকে বোঝায়। অ্যাকুয়িস্টিক গিটারের বডি দেখতে অনেকটা ফাঁপা বাক্সের মত হয়ে থাকে। বডিতে একটি গোলাকার ছিদ্র থাকে, যেটাকে হোল বলে। স্ট্রিংয়ের কম্পন হোলের ভেতরের বাতাসকে আন্দোলিত করে, যার ফলে আমরা শব্দ শুনতে পাই।
ভলিউম ও টোন কন্ট্রোলারের মাধ্যমে গিটারের সাউন্ড বাড়ানো কমানো যায় এবং অনেক সময় টিউন পরিবর্তনও করা যায়। গিটারের নিচের দিকের যে অংশে স্ট্রিংগুলির শেষপ্রান্ত আটকানো থাকে তাকে ব্রিজ বলে। বিভিন্ন আকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও শব্দের পার্থক্যভেদে বিভিন্ন ধরনের গিটার দেখতে পাওয়া যায়।
গিটার শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এটি এক একটি সংস্কৃতির পরিচায়কও বটে। ভিন্নধারার বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির গিটারের মাধ্যমে।