প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নানারকম উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু উৎসব রয়েছে তা শুধু ব্যতিক্রমই নয়, বেশ আকর্ষণীয় এবং মজাদারও। এসব মজার উৎসবে স্থানীয় লোকজন ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের উচ্ছ্বাসমুখর অংশগ্রহণ থাকে। পৃথিবী জুড়ে এমনই কিছু মজাদার উৎসবের গল্প দিয়ে সাজানো এই লেখাটি।
এল কোলাচো উৎসব: স্পেন
অন্যরকম উৎসবের জন্য এমনিতেই স্পেনের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তবে এর মধ্যে এল কোলাচো যেন অন্য সব উৎসবকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি বছর স্পেনের বুরগোজের কাছে কাস্তিলিও দেল মুরফিয়াতে হওয়া এ উৎসবের আরেক নাম ‘বেবি জাম্পিং ফেস্টিভ্যাল‘। সাধারণত জুনের প্রথম সপ্তাহে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য শিশুদেরকে শয়তানের আত্মা থেকে দূরে রাখা এবং শিশুরা যাতে পাপমুক্ত থাকে।
এই উৎসবে শয়তানের ছদ্মবেশে কয়েকজন লোক এক লাফে ছুটে এসে টপকে যায় মাদুরে শোয়ানো ফুটফুটে শিশুদের, এতেই নাকি পাপমুক্ত হয় শিশুরা। ১৬২০ সাল থেকে প্রতি বছর ‘করপাস খ্রিস্তি’র (এই লাতিন কথাটির অর্থ ‘যিশু খ্রিস্টের দেহ’) উদ্দেশ্যে ‘এল কোলাচো’ উৎসবটি পালিত হয়। এ উপলক্ষে স্পেনের সব শহরে নানা আনন্দ মিছিল বের করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বিচিত্র সব পেশাক পরিধান করে, গান-বাজনা করে মিছিলকে মাতিয়ে রাখে। সন্ধ্যায় শুরু হয় উৎসবের মূল পর্ব। পরিবারের বয়স্করা তাদের ছোট বাচ্চা নিয়ে উৎসবে হাজির হন।
উৎসবটিকে এককথায় ভয়ঙ্করও বলা যেতে পারে। লাফানোর সময় কোনো কারণে যদি কোনো লোক শিশুদের উপর পড়ে, তবে কী কেলেঙ্কারিটাই না হবে, ভাবা যায়! আর এই কারণে অন্যতম বিপজ্জনক উৎসবের তালিকায় স্থান পেয়েছে এল কোলাচো। বিপদের গুরুত্ব বুঝে উৎসবটিকে নিষিদ্ধ করার উপদেশ দিয়েছিলেন পোপ বেনেডিক্ট। ক্যাথলিক পন্থায় শুধু জল ছিটিয়ে শিশুদের পাপমুক্ত করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
সঙ্গক্র্যান উৎসব: থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ নববর্ষ উদযাপনের উৎসবটি সঙ্গক্র্যান হিসেবে পরিচিত। থাইল্যান্ডের প্রাচীন রাজধানী আয়ুত্থায়ায় এই উৎসব উপলক্ষে চলে সাজসাজ রব। উৎসবকে কেন্দ্র করে পুরো নগর সজ্জিত হতে থাকে। রঙ-বেরঙের আলোয় সারা শহর আলোকিত হয়ে থাকে। উৎসবে হাতির কুচকাওয়াজ, ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা এবং জলকেলির মাধ্যমে উৎসবটি আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করে থাকে থাইল্যান্ডবাসীরা।
জলকেলি উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। এই খেলায় মেতে ওঠে বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ ও শিশুর দল। জলের আনন্দোৎসবে পর্যটকদের আনন্দ দিতে যোগ দেয় হাতিরাও। এই খেলা উপলক্ষে বিভিন্ন সাজে হাজির থাকে হাতির দল। হাতিগুলো শুঁড় দিয়ে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয় উৎসবে আগত সকলকে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই জলোৎসবে নানা বয়সী মানুষ জলবন্দুক, বড়-বড় পানির গামলার সাহায্যে এক অপরকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। এই আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে ভিড় করে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকও। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই পানি ছিটানোর মাধ্য দিয়ে তাদের মনের সমস্ত কালিমা ধুয়ে দিয়ে বয়ে আনবে সৌভাগ্য, সুস্বাস্থ্য ও আনন্দের বারতা।
সবাই পানিতে আপাদমস্তক ভিজে নতুন বছরকে অভিনন্দন জানায়। সঙ্গক্র্যান উৎসবে পরিববারে সদস্যরা একত্র হয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন, চলে উপাদেয় ভোজন পর্বও। উপহার দেয়া-নেয়ার রীতিও প্রচলিত রয়েছে এই উৎসবে। অনেকদিন পর যেন পারিবারিক মিলনমেলার আসর বসেছে। এদিন অনেকেই পরিবারের প্রয়াত স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করেন, সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ১১ই এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে এই উৎসব চলে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত চলে।
পুষ্করের উট মেলা: ভারত
রাজস্থানের পুষ্কর উট মেলাটি খুবই মজার। বছরের বেশিরভাগ সময়টা নিঃসঙ্গ একাকিত্বে আচ্ছন্ন থাকে রাজস্থানের পুষ্কর। শুধু বছরের একটিমাত্র সময়ে জমজমাট হয়ে ওঠে পুষ্কর। মেলা বসে সেখানে।
এই বিখ্যাত মেলা বসে কার্তিকী একাদশী থেকে কার্তিকী পূর্ণিমায়। ইংরেজি ক্যালেন্ডার মতে ৮-১৪ নভেম্বরে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। কথিত রয়েছে, এই পাঁচদিনের পরিধিতেই পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয়েছিল পুষ্কর ক্ষেত্র। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ব্রহ্মা তার হাতে থাকা পদ্মের আঘাতে বজ্রনাভ নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন। সেই সময় পদ্ম থেকে কিছু পাঁপড়ি এই মর্ত্যে ঝরে পড়ে। যে স্থানে এই পাঁপড়িগুলো পড়েছিল, সেই স্থানে সৃষ্টি হয় এই হ্রদ। এভাবেই জন্ম নেয় পুষ্কর তীর্থের। এই ঘটনাকে স্মরণ রেখে পাঁচ দিনের মেলা বসে পুষ্করে, চলে পুণ্যস্নান।
এই উৎসবের অন্যতম আরেক আকর্ষণ উটের প্রদর্শনী। প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ হাজার উটের মেলা বসে এখানে। সারা বছরের উট কেনা-বেচা হয় এই মেলাতেই। মেলায় আনা উটদের সাজিয়ে-গুছিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। সুসজ্জিত উটেরা ফ্যাশন শো-তে অংশ নেয়, কুচকাওয়াজে যোগ দেয়, দৌড় প্রতিযোগিতায় দৌড়োয়। এমনকি উটদের মালিকানাও বদল হয় এই মেলায়।
শুধু উটের নানা সাজে পুষ্কর ক্ষেত্র যেন বর্ণিল হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে মিশে থাকে মেলায় আসা মানুষদের বৈচিত্র্যময় পোশাক। মহিলাদের গয়নার রিনিঝিনি ঝংকার, কুমকুম, মেহেদী ফুলের রংয়ে পুষ্কর হয়ে ওঠে রঙের মেলা। পুষ্করের রুক্ষ, সোনালি বালুকাবেলায় এই রং যেন সকলের চোখকে ঝলসে দেয়।
তানাবাতা উৎসব: জাপান
প্রতিবছর ৭ জুলাই জাপানের বিভিন্ন শহরে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় তানাবাতা উৎসব। ‘তানাবাতা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘সপ্তমী সন্ধ্যা’। এই উৎসবের আয়োজনের পেছনে রয়েছে এক প্রেমিক যুগলের বিচ্ছেদের কাহিনী। রাজার রোষানলে পড়ে এক প্রেমিকযুগল আলাদা হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র বছরের একটি মাত্র দিনে তাদের দেখা করার অনুমতি মেলে। সেই দিনটি হলো বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে। আর এই দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজিত হয় এই উৎসব। তবে উৎসবটি জাপানের বিভিন্ন শহরে একই সময়ে পালিত হয় না। কোনো কোনো শহরে আগস্ট মাসেও পালিত হয় এই উৎসব।
তরুণ-তরুণীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এই উৎসব। জাপানি প্রেমিক-প্রেমিকেরা ভালোবাসা দিবস হিসেবেও একে পালন করে থাকে। আনুমানিক ৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের সম্রাজ্ঞী কোওকেন এই উৎসবের প্রচলন করেন। জাপানের সেন্দাই শহর তানাবাতা উৎসবের জন্য বিখ্যাত। সেখানে সপ্তাহব্যাপী চলে নানা উৎসব।
স্থানীয়রা এই উৎসবকে তারার উৎসবও বলে থাকে। পুরো শহরেই নানা বাহারি রঙের কারুকাজ করা কাগজে মোড়া নানান শিল্পকর্মের প্রদর্শনী থাকে। থাকে আলোক-সজ্জার ব্যবস্থা, রাস্তায় রাস্তায় ভোজন রসিকদের জন্য অস্থায়ী খাবারের দোকানের বসে। এসব দোকানে সুলভ মূল্যে নানা উপাদেয় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। উৎসবের শুরু হয় প্রার্থনা দিয়ে, এরপর চলে নাচ-গান। আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ে উৎসবটিকে পালন করে থাকে জাপানীরা।
উৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আতশবাজি পোড়ানো। উৎসবের কোনো একটি সন্ধ্যায় প্রায় দু’ঘন্টা ধরে চলে এই আতশবাজির খেলা। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে উৎসব প্রাঙ্গন।
নিয়ার ডেথ উৎসব: স্পেন
স্পেনের ছোট্ট শহর লাস নিয়েভেসে প্রতি বছর ২৯ জুলাই এই আজব উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবে অংশ নেন বিগত বারো মাসে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ ফিরে পাওয়া মানুষেরা।
মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে যারা বেঁচে ফিরেছেন, নিয়ার ডেথ উৎসব শুধুমাত্র তাদেরই জন্য। স্প্যানিশ ভাষায় এর নাম ‘ফিয়েস্তা দে সান্তা মার্তা দে রিবারটেমে’। দুর্ঘটনায় রক্ষা পাওয়া ব্যক্তিদের কফিনে করে নিয়ে যাওয়া হয় রক্ষাকর্তা সাধু মার্তা দে রিবারটেমের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। রক্ষাকর্তার কাছে তারা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নানা উপহার সামগ্রী প্রদান করে থাকে। এই কফিনের মিছিলে তাদের সঙ্গে থাকে তাদের আত্মীয় পরিজন ও বন্ধুবান্ধবরা। মিছিল শেষে কফিন ত্যাগ করে মৃত্যুঞ্জয়ীরা তাদের দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
ফিচার ছবি: YouTube