Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বেলুনবালিকা: ব্যাঙ্কসির আত্মহত্যাকারী চিত্রকর্ম

কল্পনা করুন, আপনি বসে আছেন সদবির কোনো এক নিলাম অনুষ্ঠানে। একের পর এক আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে চমৎকার সব ছবি, প্রত্নবস্তু, পুরনো বই। হঠাৎ যে-ই ক্রমিক নাম্বারটি ঘোষণা করা হলো, সেই আপনার মনোযোগ দেয়ালের অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকর্মটি থেকে নিলামের মঞ্চের দিকে গেল। কারণ ‘বেলুনবালিকা’ নামে যে অপূর্ব সৃষ্টিটির দিকে আপনি তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ, তার নিলাম শুরু হবে এখন। হয়তো বা ঘণ্টাখানেক পরে এর স্থান হবে কোনো কোটিপতির ড্রয়িং রুমে। একের পর এক অবিশ্বাস্য দাম হেঁকে যাচ্ছেন উপস্থিত লোকজন, শেষ হাতুড়ির বাড়িটি পড়ে ১৪ লক্ষ ডলারে, বিক্রি হয়ে যাবে এক্ষুণি।

হঠাৎ শোনা গেল ফড়ফড় ফড়ফড় শব্দ, চমকে উঠে সবাই তাকালেন শব্দের উৎসের দিকে। খানিকটা আতঙ্ক, খানিকটা বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেলেন, ‘বেলুনবালিকা’ ছবিটি ফ্রেমের নিচ থেকে বের হয়ে আসছে, সুন্দর ছবিটির একেবারে ছিঁড়েফুঁড়ে একাকার অবস্থা।

ঠিক এমনটিই ঘটেছে কিছুদিন আগে, অক্টোবরের ৫ তারিখ সদবি’র নিলামে। চিত্রকর্মটি ছিল রহস্যময় শিল্পী ব্যাঙ্কসির আঁকা।

কে এই ব্যাঙ্কসি?

নব্বইয়ের দশকে ব্রিস্টলের কুখ্যাত বার্টন হিল এলাকার দেয়ালগুলো ভরে যাচ্ছিল অদ্ভুত সব গ্রাফিটি দিয়ে। যেমন রঙের ব্যবহার, তেমনই অভিনব বিষয়। অন্যসব গ্রাফিতি থেকে একে সহজেই আলাদা করা যেতো; স্প্রের বদলে স্টেনসিলের ব্যবহার দেখে। কেউ জানতো না, এই গ্রাফিতিগুলো কার আঁকা, তবে একটি ছদ্মনাম ব্রিস্টলের কালোজগতে সবাই জানতেন, রবিন ব্যাঙ্ক’স

নামটি দ্ব্যর্থক; ইংরেজি শব্দ রবিং যার অর্থ দাঁড়ায় ডাকাতি, আর ব্যাঙ্ক বলতে আমাদের চিরপরিচিত লেনদেনের ব্যাঙ্ককেই বুঝাচ্ছে। এই রবিন ব্যাঙ্ক’স নামটিই পরে বদলাতে বদলাতে ব্যাঙ্কসিতে পরিণত হয়।

the mild mild west
ব্যাঙ্কসির দ্য মাইল্ড মাইল্ড ওয়েস্ট; Image Source: icanvas.com

ব্যাঙ্কসির আসল পরিচয় এখনও কেউ জানেন না। তবে কিছু সাক্ষাৎকার ও সামাজিক মাধ্যমে তার উপস্থিতির ফলে তার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানা যায়। তিনি শুরু করেছিলেন ডেব্রিড’য ক্রুর গ্রাফিটি শিল্পীদের অংশ হিসেবে, নব্বইয়ের দশকে। তিনি তখন কিশোর, জীবনের অনেক অন্ধকার পর্ব দেখা হয়ে গেছে তার সেই বয়সেই। তার জন্মস্থান বার্টন হিল এলাকায় মারামারি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লেগেই থাকতো। এরই মাঝে তিনি তার কাজ করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তার দেখা হয় ব্রিস্টলের বিখ্যাত আলোকচিত্রী ও চিত্রপ্রদর্শনী উদ্যোক্তা স্টিভ ল্যাযারিডসের সঙ্গে।

তিনি ব্যাঙ্কসির কাজের ব্যবসায়িক দিকটি প্রথম দেখতে পান। তার কাজ বিক্রি করতে শুরু করেন। তিনি পরে লন্ডনেও কাজ শুরু করেন এবং অচিরেই পুরো ব্রিটেনে তার কাজের তুলনা হতে থাকে জ্যঁ মিশেল বাস্কিয়াৎ এবং কিথ হ্যারিংয়ের মতো তারকা শিল্পীদের সাথে। তার প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ১৯৯৭ সালে আকা একটি বড় পরিসরের দেয়াল অঙ্কন, নাম ‘দ্য মাইল্ড মাইল্ড ওয়েস্ট’। এঁকেছিলেন ব্রিস্টলের স্টোক্স ক্রফটে। এই ছবির উদ্দেশ্য ছিল এক আইনজীবীর বিজ্ঞাপন ঢেকে দেয়া। বিষয় ছিল একটি টেডি বিয়ার তিনজন দাঙ্গা পুলিশের দিকে মোলোটভ ককটেল ছুঁড়ে মারছে।

ব্যাঙ্কসির কাজে এরকম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সবসময়ই লক্ষ্য করা গিয়েছে, তবে আশ্চর্যজনকভাবে অর্থ আর যশ উপার্জনেও তার আগ্রহ সীমাহীন। তার কাজে বিচিত্র রকমের আবেগ ও বাস্তবতা উঠে আসে। তিনি বরাবর তার কাজে উসকানি দেন বুর্জোয়া সমাজকে, কিন্তু তাদের কাছেই তিনি উচ্চমূল্যে নিজের শিল্প বিক্রিও করেন। এর জন্য অবশ্য তার নিজের যুক্তিই আছে।

এখন শিল্পের একগাদা নতুন দর্শক আছে এবং নিজের কাজ বিক্রি করার সুযোগ আর সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি। প্রথমবারের মতো বুর্জোয়া শিল্পের দখল এখন জনগণের হাতে (ইন্টারনেটের ফলে)। আমাদের এই সুযোগের ফায়দা নিতে হবে।

তিনি এখনও পর্দার আড়ালেই থাকেন, তার দেয়ালচিত্র এখন ইংল্যান্ডের বাইরে ভিয়েনা, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের দেয়ালে আলোড়ন তুললেও তাঁর গোপনীয়তা রক্ষা করে ‘পেস্ট কন্ট্রোল’ নামে এক সংগঠন। যারা তার কাজের সত্যতাও নিশ্চিত করে। তিনি নিজে অনেক জায়গায় ছবি দিয়েছেন, তবে চেহারা কাগজের ব্যাগের আড়ালে রেখে। তিনি যোগাযোগ করেন ইমেইলে বা সামাজিক মাধ্যমে। তাই তার ব্যাপারে যা জানা যায়, তার সবই তার নিজের বরাতে। এর সত্যতা নিশ্চিত করার আপাতত কোনো উপায় নেই।

তবে কিছু মানুষ তার সরাসরি সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন, শেষ ২০০৩ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকার সাইমন হ্যাটেনস্টোন তার সাক্ষাৎকার নেন। তার বর্ণনায়, ব্যাঙ্কসি দেখতে ২৮ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ, পরনে রংচটা জিন্স আর টি-শার্ট, রুপার দাঁত, রুপার চেইন আর কানে রুপার দুল। তিনি দেখতে নাকি দ্য স্ট্রিটসের জিমি নেইলমাইক স্কিনারের মাঝামাঝি।

banksy artwork in bristol
ব্রিস্টল শহরে ব্যাঙ্কসির ম্যুরাল; Image Source: visitbristol.co.uk

 বেলুনবালিকা কথা

যে চিত্রকর্মটির আত্মহত্যার ঘটনা বলতে গিয়ে এত কথার অবতারণা, সেটি আসলে ২০০২ সালে আঁকা একটি ম্যুরাল। এই ছবিটিতে দেখা যায় কালো স্টেন্সিলে কালো রঙে আঁকা একটি বালিকা হাত থেকে একটি লাল রঙের বেলুন ছেড়ে দিচ্ছে। ছবিটির কোনো কোনো সংস্করণে একটি হালকা, প্রায় অস্পষ্ট লেখাও থাকে,

There is always hope.

অর্থাৎ, জীবনে সবসময় আশা আছে। মেয়েটিকে তেমন কোনো বিশেষ বর্ণনা ছাড়াই আঁকা হয়, যার কারণে মেয়েটিকে যেকোনো কিছুর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু তার হৃদয়াকৃতির টকটকে লাল বেলুনটি আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এই অভাবনীয় ঘটনার আগেও ছবিটি ব্যাঙ্কসির সবচেয়ে পরিচিত ও বহুল আলোচিত কাজগুলোর একটি ছিল।  

balloon girl there is always hope
বেলুনবালিকা; Image Source: etsy.com

ব্যাঙ্কসির এই কাজটি অনেকটাই মেটাফোরিক, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মানুষের কষ্ট ও সংগ্রামের কথা বলে এই ছবিটি। মেয়েটির ভঙ্গিমার বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে; দেখলে ভ্রম হতে পারে, মেয়েটি বেলুনটি ছেড়ে দিচ্ছে, না বেলুনটি ধরতে যাচ্ছে? যদি ধরতে যাওয়ার ব্যাখ্যাটি নেয়া হয় তবে অনুবাদ দাঁড়ায় আশাবাদী; যখন আশেপাশের সবকিছুই সাদা আর কালোর হতাশায় ভরা, তখন কোথাও না কোথাও আশার ক্ষীণ আলো জ্বলতে থাকেই।

বাচ্চাদের নির্দোষ আশা ভরা মানসিকতা ধারণাই হয়তো বর্তমান নিষ্ঠুর পৃথিবীতে জীবন্মৃত না হয়ে সত্যিকারের বেঁচে থাকার উপায়। তবে বেলুন ছেড়ে দেয়ার ব্যাখ্যাটি হয়তো খানিকটা হতাশাবাদী অথবা বাস্তববাদীও ধরা যায়। মেয়েটি তার শিশুসুলভ সরলতাকে ছেড়ে দিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে শিখছে পৃথিবীর কঠোরতা। কাজটি প্রথম দেখা যায় লন্ডনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে, এমন এক জায়গায় যেখানে পথচারীরা একে সহজেই দেখতে পায়।

ছবিটি আরও কয়েকবার ব্যবহার করেন ব্যাঙ্কসি, ২০১৪ সালে সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের পক্ষে একটি প্রকল্পে তিনি এই ছবির একটি রুপান্তর ব্যবহার করেন। আবার ২০১৭তে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনেও তিনি রক্ষণশীলদের বিরোধী প্রগতিশীল কিছু ভোটারের জন্য ছবিটি বিনামূল্যে ব্যবহারের অনুমতি দেন। ফলে বেশ বিতর্কের সম্মুখীনও হতে হয় ব্যাঙ্কসিকে। একই বছরে স্যামসাং আয়োজিত পোলে যুক্তরাজ্যের এক নম্বর জনপ্রিয় চিত্রকর্ম নির্বাচিত হয় এটি। 

বেলুনবালিকার আত্মহত্যা: বুর্জোয়া ভোগবাদীতার বিরুদ্ধে অবস্থান নাকি শুধুই একটি পাব্লিসিটি স্টান্ট?

ব্যাঙ্কসির শিল্প অনেকাংশেই রাজনৈতিক, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তিনি নিজেই তার শিল্পের বিজ্ঞাপন করার জন্য এমন অনেক কাজ করেছেন আগে, যাতে তাকে অনেক সমালোচক শুধুমাত্র একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্টান্টবাজ মার্কেটারও ভাবেন। তার এই কাজের পর বেলুনবালিকার দাম তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। একইসাথে ব্যাঙ্কসি পরিণত হয়েছেন একটি ইন্টারনেট মিমে, এবং কে না জানে, প্রচারেই প্রসার? তার ইন্সটাগ্রামে তিনি মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য একটি ভিডিও দিয়েছিলেন। ভিডিওটির ক্যাপশন ছিল-

In case it ever sold at auction.

অর্থাৎ, যদি কখনো এটিও নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। তবে দেখানো হয়নি কোন ছবির ফ্রেমে এটা করা হয়েছে।

banksy one original thought
ব্যাঙ্কসির ‘ওয়ান অরিজিনাল থট’; Image Source: canvasartrocks.com

এ ধরনের মশকরা ব্যাঙ্কসির জন্য নতুন নয়। তার অনেক শিল্পের সাথেই মজাদার কিন্তু অর্থবহ স্টান্টবাজি ফ্রিতে আসে। তবে এটা ঠিক যে, অর্থটার পেছনে ব্যাঙ্কসির নিজের ভাবাদর্শের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত না হতে পারলেও, তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন এই কাজ দিয়ে সেটা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়। তার কাজের কো-মডিফিকেশন বা পণ্যায়নের মাধ্যমে একটি আপাত বুর্জোয়া বিরোধী শিল্পও যে শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া বিনোদনেই কাজে লাগছে, তার একটি বিশেষ রূপ দেখানো। এবং এই স্টান্টের পরও যে কাজটির মূল্য আরো বেড়েছে তা প্রমাণ করে যে, এখনকার সমাজে আমরা চটক আর প্রচারকে অনেক বেশি দাম দেই আসল শিল্প থেকে। হয়তো ব্যাঙ্কসি নিজেও এটাই দেখাতে চেয়েছিলেন।

This article is in Bangla language. It's about the ballon girl and Banksys self destructing work.

Featured Image: dailysabah.com

Related Articles