সারা বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন সময়ে নানা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এসব উৎসবের কিছু আছে যেমন শুধুই মজার, নির্মল আনন্দে ভরপুর, তেমনি কিছু বীভৎস উৎসবেরও খোঁজ পাওয়া যায় নানা দেশে। সেসব উৎসবে শরিক হন ভিনদেশের অনেক পর্যটকও। নানা দেশের, নানা সময়ের, নানা আশ্চর্যের, মজাদার সব উৎসবের খুঁটিনাটি নিয়ে সাজানো আজকের এই লেখা।
রানিং অফ দ্য বুলস: স্পেন
প্রতি বছর স্পেনের পাম্পলোনা শহরে পালিত হয় ‘সান ফেরমিন’ উৎসব। সাধু ফেরমিনের উদ্দেশ্যে পালিত হয় এই উৎসব। সেই উৎসবেরই অঙ্গ ‘রানিং অফ দ্য বুলস’। একসময় পাম্পলোনায় ‘বুল ফাইট’ বা ষাঁড়ের লড়াই খুব জনপ্রিয় ছিল। এই খেলার জন্য কয়েকটি মাঠকে ঘেরা দিয়ে রাখা হতো, যাকে বলা হতো ‘বুল রিং’। খোঁয়াড় থেকে ষাঁড়েদের ছেড়ে দেয়া হতো। রাস্তা পেরিয়ে ষাঁড়গুলো পৌঁছে যেতো বুল রিংয়ে। একসময় সেখানকার মানুষ ঠিক করলো যে, তারাও ষাঁড়দের সঙ্গে দৌড়াবে। সেই থেকে শুরু রানিং অফ দ্য বুলসের।
প্রতি বছর ৬-১৪ জুলাই উৎসবের একটি অঙ্গ হিসেবে এই লড়াইয়ের আয়োজন করা হয়। ভয়ানক ষাঁড়েদের তাড়া খেয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি করে প্রতিযোগীরা। এই খেলায় অংশগ্রহণের জন্য আঠারো বছর হওয়া বাধ্যতামূলক। তা না হলে এই খেলায় অংশগ্রহণের অনুমতি মেলে না। পাম্পলোনায় প্রত্যেকবার দু’শো থেকে তিনশো লোক ষাঁড়ের গুঁতোয় আহত হয়। কম-বেশি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
নাইট অফ দ্য র্যাডিমেজ: মেক্সিকো
মেক্সিকোর ওয়াক্সাকা রাজ্যে প্রতি বছর ২৩ ডিসেম্বরে এই অদ্ভুত উৎসবের আয়োজন করা হয়। আনুমানিক ১৮৯৭ সালের দিকে মেক্সিকোয় যখন স্পেনের উপনিবেশ ছিল, সেসময় থেকে এই উৎসবের সূত্রপাত বলে স্থানীয়রা মনে করেন। কথিত রয়েছে, দু’জন ভিক্ষু সন্নাসী নাকি এই উৎসবের প্রণেতা ছিলেন। উৎসবমুখর পরিবেশে নানা আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবটি পালিত হয়। বড়দিনকে উপলক্ষ করে কৃষকদের জমিতে ফলানো শাকসবজি, ফলমূল, কাঠের তৈরি নানা কারুকার্যময় আসবাবপত্র, সামগ্রী বিক্রির উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
উৎসবে কৃষকরা তাদের জমিতে ফলানো বড় বড় মুলো, মিষ্টি কুমড়ো এবং নানা শাকসবজি দিয়ে তৈরি করে কুমির, পরী, পোকা, রাজকন্যা বা কোনো মানুষের আকৃতি। বৈচিত্র্যময় এসব উপকরণের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় মেলায়। সবজি দিয়ে বানানো সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্মকে পুরস্কৃতও করা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, নানা সবজি দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে বিক্রেতাদের আকর্ষণ করা যায়। এতে নাকি সবজির ভালো দাম পাওয়া যায়, বিক্রিবাট্টাও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়।
চেউং চাউ বান উৎসব: হংকং
হংকং এর ‘বান ফেস্টিভ্যাল’ খুব জনপ্রিয় এক উৎসব। লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, নবম মাসের নবম দিনে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসব চলে প্রায় সপ্তাহব্যাপী। সাধারণত পূর্বপুরুষদের স্মৃতির সম্মানার্থে হংকংবাসীরা এই উৎসব পালন করে থাকে। পরিবাবরের মৃত ব্যক্তিদের সমাধিতে উপাসনার মধ্য দিয়ে উৎসবের শুরু হয়।
কিংবদন্তী রয়েছে যে, হান রাজবংশের আমলে এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা গ্রামের এক ব্যক্তিকে গ্রামের আসন্ন এক বিপদের কথা জানিয়ে উঁচু কোনো স্থানে চলে যেতে বলেন। ঐ ব্যক্তিটি গ্রামের অন্যদেরকে বললে তারা বিষয়টি বিশ্বাস করেনি। কিন্তু জ্যোতিষীর কথামতোে ঐ ব্যক্তিটি তার পরিবার নিয়ে উঁচু এক জায়গায় চলে যায়। পরদিন সে গ্রামে এসে দেখে কে বা কারা গ্রামের সব মানুষকে হত্যা করেছে। সেই থেকে দিনটিকে চেউং চাউ বান উৎসব হিসেবে গ্রামের লোকেরা পালন করে থাকে।
তবে আরেকটি তথ্যমতে, এই উৎসবের শুরু নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। অনুমান করা হয়, গত শতাব্দীতে কিং রাজবংশের সময় চেউং চাউ দ্বীপে প্লেগ রোগে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। অনেক মানুষ মারা যায়। পরে গ্রামের বয়স্ক লোকরা দেবতার প্রার্থনায় বসে, যাতে রোগ থেকে তিনি গ্রামবাসীদের রক্ষা করেন। একসময় গ্রামটিতে প্লেগ রোগের অবসান ঘটে। গ্রামবাসীরা ঠিক করে, প্রতি বছর উৎসবের মধ্য এই দিনটি পালন করবে আর রুটি দিয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করবে। সেই থেকে শুরু এই উৎসবের।
এই উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হলো কয়েকশ’ রুটি দিয়ে ঢাকা একটি মিনার থেকে রুটি পেড়ে আনার প্রতিযোগিতা। তার পাশাপাশি থাকে ড্রাগন নাচ, যাত্রা, মার্শাল আর্টসহ বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন। রুটি দিয়ে ঢাকা মিনারে ওঠার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা ৩ মিনিটের মধ্যে ৬০ ফুট উঁচু মিনারের চূড়া থেকে যে বেশি রুটি নিয়ে আসতে পারবে, তাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এটি উৎসবের সব থেকে বিপজ্জনক খেলার তকমা পেয়েছে। মানুষের ভারে ১৯৭৮ সালে একবার ভেঙে পড়েছিল মিনারটি। ৩০ জন প্রতিযোগী আহত হয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল চেউং চাউ বান। উৎসবটি ফের চালু হয় ২০০৫ সালে।
উৎসবের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘পিউ সিক‘ নামের মঙ্গল শোভাযাত্রা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই হংকংয়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়।
সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে: আয়ারল্যান্ড
১৭ মার্চ আয়ারল্যান্ডে উদযাপিত হয় সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে। মহানুভব প্যাট্রিকের মৃত্যুদিবস উপলক্ষে প্রতি বছর এই দিনটি মহা আড়ম্বরে পালিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, চতুর্থ শতকে এক সম্ভ্রান্ত রোমানো-ব্রিটিশ পরিবারে প্যাট্রিকের জন্ম। তার পিতা ছিলেন ধর্মপ্রচারক এবং পিতামহ গির্জার একজন যাজক। ১৬ বছর বয়সে কিশোর প্যাট্রিক আইরিশ জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত হন এবং তাকে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
অনেকদিন ক্রীতদাস হিসেবে থাকার পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসে এক খ্রিস্টান মিশনারীতে আশ্রয় নেন। পরবর্ততীতে তিনি খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারে আত্মনিবেদন করেন এবং একসময় তিনি সেইন্ট প্যাট্রিক নামে প্রসিদ্ধ হন। এই মহান সন্তই সারা আয়াল্যান্ডে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার ঐকান্তিক চেষ্ঠায় আয়ারল্যান্ড থেকে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। দেশটির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অগ্রদূতও ছিলেন তিনি।
এদিন আয়ারল্যান্ডে সাধারণ ছুটি থাকে। দেশের মানুষ নানা উৎসাহ উদ্দীপনায় উৎসবটি পালন করে থাকে। সেদিন জাতীয় পতাকার রংকে প্রাধান্য দিয়ে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে নাচ-গানে মেতে উঠে আইরিশরা। পাবলিক প্যারেড গ্রাউন্ড সবুজে ছেয়ে যায়। পুরো দেশটাই যেন এদিন সবুজের আবিরে ঢেকে থাকে।
আয়ারল্যান্ডের ধর্ম আর সংস্কৃতিতে এই সবুজ রঙ অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। দলে দলে লোক প্যারেডে উপস্থিত হয়ে আনন্দ মিছিল করতে থাকে। নাচগান, আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে থাকে সারা দেশের মানুষ।
বার্নিং ম্যান ফেস্টিভ্যাল: নেভাদা, যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা রাজ্যের ব্ল্যাক রক মরুভূমিতে আগস্ট মাসের সপ্তাহের শেষ সোমবার থেকে সপ্তাহব্যাপী বার্নিং ম্যান নামের এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ উৎসবের লক্ষ্য আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্য, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। মনের কূপমন্ডুকতা, অন্ধকারত্ব সরিয়ে দিয়ে পরষ্পরের মধ্যকার সাহায্য ও সহযোগিতার বন্ধন দৃঢ় করা।
যুক্তরাষ্ট্রের খুবই জনপ্রিয় উৎসব এটি। প্রতি বছর পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ এই অনুষ্ঠানের অংশ নিতে একত্রিত হন। উৎসব উপলক্ষে মরুভূমির দেড় বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে নানা বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। এতে থাকে বিশাল আকৃতির বালুময় ভাস্কর্য, নানারকম প্রতিযোগিতা, ভিন্ন সরঞ্জামের স্টল। এ যেন রুক্ষ বালুময় প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন জাগানোর চেষ্টা।
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো এক বিশাল কাঠের মূর্তি। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মানুষের আদলে তৈরি করা বিশাল কাঠের মূর্তিতে আগুন দেওয়া হয় এ উৎসবে। এ দৃশ্য দেখে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে আগত দেশ-বিদেশের ভ্রমণার্থীরা। সারা দিন-রাত চলে হই-হুল্লোড়, নাচ-গান। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরেও প্রায় ৭০ হাজারের মতো দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এই উৎসবে।
ফিচার ছবি: EDM Magazine