তিন বন্ধু তেহরানের পাহাড়ী রাস্তায় অলস গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে শিরিন নামের একজনের বেশ মন খারাপ। কারণ তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বাকি দুজনের শত সান্ত্বনা ও আশ্বাসের বাণী তার চিন্তা বা মনের কষ্ট কমাতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে একসময় তারা অচেনা এক রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ ব্যক্তির সম্মুখীন হয়। তার হাতে ছিল ছোট্ট একটি খাঁচা, যেখানে একটি ক্যানারি পাখি (একধরনের ছোট এবং হলদে রঙের গায়ক পাখি ) এবং সাথে একটি বক্সে কিছু রঙিন কার্ড ছিল।
আসলে লোকটিকে অচেনা বলা ঠিক হবে না। তার এ ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সাথে থাকা জিনিসগুলোই তার প্রকৃত পরিচয় বর্ণনা করছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, তিনি হলেন একজন ভবিষ্যদ্বক্তা। তেহরানের পথে-ঘাটে তাদের দেখা পাওয়া খুব সাধারণ একটি বিষয়।
শিরিন এই ভবিষ্যদ্বক্তাকে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নিজের ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে তার দিকে দ্রুত অগ্রসর হয় সে। নোটটা তার হাতে দিয়ে শিরিন চোখ বন্ধ করে এবং হাত জোড় করে প্রার্থনা করা শুরু করে। এর মধ্যেই ক্যানারি তার খাঁচা থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ছাড়া পায়, কারণ, তাকে এলোমেলোভাবে একটি কার্ড বাছাই করে দিতে হবে। শিরিনের জন্য ক্যানারি যে কার্ডটি বাছাই করে তা পড়ে সে খুব খুশি হয়। কার্ডটিতে ফারসি ভাষায় লেখা ছিল, “হারিয়ে যাওয়া জোসেফ ক্যানানের কাছে ফিরে আসবে, দুঃখ করো না”। শিরিনের মতে, এর অর্থ হলো, তার বন্ধু সুস্থ হয়ে উঠবে।
এই কার্ডগুলোর প্রত্যেকটিতেই কোনো না কোনো কবিতার পঙক্তি আছে। আর এসকল কবিতা ১৪ শতকের বিখ্যাত কবি হাফিজের। ইরানের জনসাধারণের এই কার্ড দেখে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার ইচ্ছা যেমন প্রখর, তেমনি এগুলোর উপর তাদের বিশ্বাসও অগাধ। শুধু ইরানেই নয়, ফারসি ভাষাভাষীদের মধ্যে এই ধরনের সংস্কৃতি দেখা যায়, যেমন- আফগানিস্তান।
কবি হাফিজের কবিতার পঙক্তি দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত জানার এই আজব সংস্কৃতির নাম ‘ফাল-এ-হাফিজ’। একে ‘লিসান ওল ঘাব’ও বলা হয়ে থাকে, যার অর্থ অদৃশ্যের ভাষা বা কথা। ফারসি ভাষীদের বিশ্বাস মতে, এই ফাল-এ-হাফিজের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের কোনো প্রশ্নের জবাব পেতে পারে, কোনো বিপদ বা সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করার পথ খুঁজে পেতে পারে কিংবা ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। এই সংস্কৃতিতে শুধু হাফিজের কবিতাই নয়, বরং এর প্রচলনের জন্যও দায়ী এই খ্যাতনামা কবি।
কীভাবে ফাল-এ-হাফিজের শুরু হয় তা বোঝার জন্য আগে তার জীবন এবং কবিতা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন। ১৪ শতকের প্রখ্যাত কবি শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ হাফিজ তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ইরানের শহর সিরাজে, যা বর্তমানে ‘সিটি অব পোয়েটস’ বা ‘কবিদের শহর’ নামে পরিচিত।
হাফিজ গজল বা প্রেমের কবিতার জন্য বিখ্যাত। তাকে বিশ্বের সাত সাহিত্য আশ্চর্যের একজন হিসেবে ধরা হয়। আমেরিকার প্রখ্যাত প্রবন্ধকার রালফ ওয়াল্ডো ইমারসন হাফিজ সম্পর্কে বলেন,
তিনি কোনো কিছুকে ভয় করেন না। তিনি দূরদর্শী। সবকিছু ভালোমতো বিবেচনা করতে জানেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যাকে আমি দেখতে চাই বা যার মতো আমি হতে চাই।
রালফ হাফিজকে ‘কবিদের কবি’ বলে অভিহিত করেন। ইরানের সংস্কৃতিতে কবিতা রচনা করার ব্যাপারটা সকল রীতিনীতির একটি পবিত্র অংশ হিসেবে দেখা হয়। সেখানে সবার মধ্যেই সাহিত্য বা কবিতা রচনা করার ক্ষেত্রে রয়েছে এক বিশেষ ঝোঁক। ধনী-গরীব, বড়-ছোট, এককথায় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ভুলে সকলেই কোনো না কোনোভাবে এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। রাস্তার একজন ঝাড়ুদারও তার জীবনের কোনো বিশেষ মুহূর্ত বা কষ্টের সময় বোঝানোর জন্য ‘খৈয়াম’ (ইতিহাসে সাহিত্যের সবচাইতে পরিপূর্ণ কবিতার বই) থেকে কিছু অংশ পাঠ করেন।
একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারও রুমির নিগূঢ় অর্থবহ শ্লোক বর্ণনা করতে পারেন, এমনকি একজন রাজনীতিবিদও ফেরদৌসি শুনিয়ে সকলকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। উদাহরণগুলো বলার মূল উদ্দেশ্য হলো, কবিতা রচনা বা পাঠের বিষয়টা যে ইরানে সকল শ্রেণীর লোকজনের কাছেই খুব সাধারণ একটি বিষয় তা বুঝিয়ে বলা। অনেকে নিজেদের সন্তানদের নাম এই হাফিজের কবিতার কোনো লাইনের বিশেষ কোনো শব্দ ব্যবহার করেই রাখেন। হাফিজ শুধুমাত্র কবিতাই নয়, বরং রম্যরচনার ক্ষেত্রেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পারস্যের রম্যরচনার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা এবং রাজত্ব শুধু তারই রয়েছে।
হাফিজের মূল কবিতার বই হলো ‘ডিভান’। বর্তমানে আধুনিক ইরানে হাফিজ পরিগণিত হন অতুলনীয় এবং অত্যন্ত সম্মানিত কবি হিসেবে। আর তার কবিতাকে প্রয়োজনীয় সম্মান এবং শ্রদ্ধাও প্রদর্শন করা হয়। তবে যখন তিনি এসব লেখেন, তখন তাকে এবং তার কবিতাগুলোকে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় প্রেক্ষাপট থেকে ডিভানের সাথে কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাছাড়া ডিভানের মূল উপজীব্য বিষয় হলো ভালোবাসা ও যুক্তি কিংবা উন্মত্ততা ও যৌক্তিকতার মধ্যকার মূল চিন্তা। তার বইয়ে কিছু শব্দ বা কথা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। যেমন- কারো মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হওয়ার পেছনে প্রচুর যুক্তি হতে পারে, তবে হাফিজ এর মানে শুধু নেশাগ্রস্তদের বোঝাতে চেয়েছেন।
ভালোবাসার সাথে বারবার মদ বা নেশাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়গুলো টেনে এনেছেন। তার গজলগুলো পরিচিতি লাভ করার আরেকটা কারণ ছিল, এগুলোতে কবির উদ্দেশ্য কিছুটা অস্পষ্ট যা পাঠকদের মনে হাজারটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও তার গজলগুলো অলঙ্কারবহুল, কিন্তু সহজবোধ্য হওয়ায় পারস্যের বাইরেও এগুলোর কদর করা শুরু হয়, যা শত শত বছর পরে এখনও বহাল আছে।
ফাল-এ-হাফিজে ব্যবহৃত কবিতার বিষয়টি বোঝা গেল। এখন এই সংস্কৃতির শুরু সম্পর্কে একটু বলা যাক। এর কারণও কবি হাফিজ। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে তার মৃত্যু। প্রচলিত এক গল্প মতে, হাঙ্গেরিয়ান আমির ক্যারোলি রিভিচকি ১৭৬৮ সালে ভাষাবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম জনসনকে লেখা একটি চিঠি থেকে জানতে পারেন, ইরানের একদল সাধু বুঝতে পারছিলেন না, হাফিজের লাশটি কী করা উচিত। আর এই চিন্তার জন্য দায়ী হাফিজের গজল, যা সেই সময়ের মানুষজনের চিন্তাধারার বিপরীতে ছিল।
হাফিজের লাশ তার অনুপযুক্ত কবিতা লেখার জন্য পুড়িয়ে দেওয়া হবে নাকি সেই কলহ শেষ করার জন্যে একটি অভিনব ও দৈব উপায় বের করেন তারা। উপায়টি ছিল এমন- এলোমেলোভাবে হাফিজের একটি বই নির্বাচন করে তা থেকে প্রথম পঙক্তিতে যা লেখা থাকবে সেটাই করা হবে। কবি হাফিজের ভাগ্য ভালো ছিল। কেননা ঐ পঙক্তি মতে, তিনি (হাফিজ) জান্নাতবাসী হবেন, যদিও তিনি কিছু গুনাহের ভাগীদার। ফলশ্রুতিতে, তার লাশ নিয়ে আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
ফাল-এ-হাফিজ বিষয়টা অনেকের কাছে কুসংস্কার মনে হতে পারে। তবে ইরানবাসী আজও এগুলোর উপর বিশ্বাসী, যদিও ভাগ্য পরীক্ষার এ সংস্কৃতিতে ফলাফল সবসময় ইতিবাচক আসে না। একসময় সিরাজ শহরে সীমাবদ্ধ থাকা ঐতিহ্য সকল ফারসিভাষীর নিকট পরিচিত হয়ে ওঠে। তাদের মতে, ইরানের বাইরের যেকোনো ব্যক্তিও নিজেদের ভবিষ্যত পরীক্ষা করতে পারে, শুধু তার দরকার হাফিজের ডিভানের। তবে ইরানে এর প্রভাবই অন্যরকম। যেকোনো সময় আপনি ফাল-এ-হাফিজ করতে পারলেও ইরানের নতুন বছর উদযাপনের উৎসব ‘নুরুজ’ এবং ‘শাব-এ-ইয়াল্ডা’ উৎসবের রমরমা পরিবেশে এই ফাল-এ-হাফিজ আকর্ষণই আলাদা।