যীশু খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগেকার কথা। দেবতাদের পুণ্যভূমি গ্রীস নগরী। অপরূপ সৌন্দর্যে সুসজ্জিত শহর। চারপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি, বহমান নদীর কুলকুল ধ্বনি। সুন্দরের মহিমায় মহিমান্বিত এই নগরী। হবেই না বা কেন? এ যে দেবতাদের পীঠস্থান। আর সেই স্বর্গরাজ্যে অধিষ্ঠিত ছিলেন দেবতা ‘এপোলো’। আর যে মন্দিরে তার অধিষ্ঠান সেটি হল বিখ্যাত ‘ডেলফি’ মন্দির যেটি বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসে স্থান দখল করে আছে।
মন্দির ‘ডেলফি’তে হাজারো মানুষের ভিড়। মন্দিরের আশপাশের জায়গা, এমনকি পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত ছেয়ে গেছে মানুষে। সকলের মাঝে উৎসাহের কমতি নেই। হবেই না বা কেন? আজকে যে বিচার হবে; আর সেই বিচার করবেন মন্দিরের দেবতা স্বয়ং। এই মন্দিরের আছে বিশেষ ক্ষমতা। মানুষের ভবিষ্যৎবাণী থেকে শুরু করে যেকোনো ন্যায় বিচার এই মন্দিরের চাতালেই হয়ে থাকে। রাজা যখন দিশাহীন হয়ে পড়েন, শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে এই মন্দিরকেই বেছে নেন।
এ মন্দিরে কোনো যাজক ছিল না। কেবল বিশেষ মতাদর্শের নারীরাই মন্দিরটির যাজিকার পদ পেত। তাদের ডাকা হতো ‘পিথিয়া’ নামে। এই পিথিয়ারা বেশ শক্তিশালী ছিলেন। পিথিয়াদের আধ্যাত্মিক শক্তির বলে দেবতা পৃথিবীতে নেমে এসে সকল সমস্যার সমাধান করতেন। সেই দিনও পিথিয়ারা গুরুগম্ভীর স্বরে মন্ত্র আবৃত্তি শুরু করলেন। ছিটিয়ে দিলেন দেবতার মূর্তির গায়ে মস্ত্রঃপূত জল। প্রার্থনা করলেন অপরাধীদের নাম উচ্চারণ করতে করতে। ধীরে ধীরে যেন শব্দ ভেসে এলো দেবতার গলা থেকে! একে একে দোষীদের নাম বলে গেলেন নিশ্চল প্রাণহীন দেবতা। সেই সাথে যোগ করলেন তাদের শাস্তি। ভক্তিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সাধারণ জনগণ, এমনকি দেশের রাজাও। ধন্য ধন্য করতে লাগলেন সকলে। পিথিয়াদের জয়জয়কার শুরু হলো চারদিকে। তাদের পুণ্যের কারণেই তো দেবতার কণ্ঠধ্বনি তারা শুনতে পেরেছে!
পাঠকরা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন কী সূক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল আর বিচক্ষণতার বলে এই পিথিয়ারা তাদের কার্য সিদ্ধ করতেন। আর সে তো অন্য কিছু নয়, শুধুমাত্র দক্ষ ‘ভেন্ট্রিলোকুইজমে’র চর্চা। আর এ থেকেই বোঝা যায় কত শতাব্দী আগে থেকেই এ বিদ্যার চর্চা হয়ে আসছে। শুধু পিথিয়ারাই নয়, অতি প্রাচীনকাল থেকে পুরোহিত ও জাদুকররা এর চর্চা করতো সমাজে তাদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য।
উপরে বর্ণিত গল্পটি কিছুটা কল্পনাপ্রসূত হলেও গ্রিক মিথোলোজি অনুসারে ডেলফি ছিল একটি দৈববাণী প্রকাশের মাধ্যম বা জায়গা। গ্রিক সভ্যতায় এই স্থানটির রহস্যময়তা ও গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। চুরির মিথ্যা অপবাদে ঈশপের গল্পের স্রষ্টা ঈশপের মৃত্যুদন্ডের আদেশও হয় এই ডেলফি মন্দিরে।
বাংলায় ‘মায়াস্বর’, কিন্তু ইংরেজী ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’ নামটিতেই বেশি পরিচিত। যিনি এই খেলাটি দেখান তিনি হলেন ‘মায়াস্বরবিদ’ বা ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’। ‘মায়াস্বরবিদ’ ও একটি পুতুলের মাঝে মজাদার কথোপকথনের মধ্যে চলে এই খেলার আবহ। কখনো হাসি-ঠাট্টা, কখনো জীবন দর্শন, কখনোবা সমাজের হালচাল নিয়ে রচিত হয় কথোপকথনের বিষয়বস্তু। কিন্তু উপস্থাপনা খুব সূক্ষ্ম হওয়া বাঞ্ছনীয় যাতে করে দর্শকদের মাঝে সন্দেহ না হতে পারে যে দুজন একই ব্যক্তি।
এবার আসা যাক এর উৎপত্তির আলোচনায়। ভেন্ট্রিলোকুইজম (Ventriloquism) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ Venter (পেট) এবং Loqui (কথা) থেকে। এথেন্সের ‘ইউরিকাইস’ ভেন্ট্রিলোকুইজমের নামকরা যাজক ছিলেন। তিনি এবং তার শিষ্যদের নাম হয়েছিল ‘Belly Prophet’ ।
পরবর্তীতেও বিভিন্ন ধর্মে এই ‘ভেন্ট্রিলোকুইজমে’র ব্যবহার দেখা যায়। মূলত মৃত আত্মা নামানো, যাকে আমরা প্ল্যানচেট বলে থাকি, এই কাজে ভেন্ট্রিলোকুইজম সবচাইতে বেশি ব্যবহার করা হত। ধীরে ধীরে এই বিদ্যাটি সকলের কাছে যাদুবিদ্যা হিসেবে ধরা দেয় এবং এর পর থেকেই মূলত মঞ্চে ভেন্ট্রিলোকুইজমের ব্যবহার শুরু হয়। চীনও এই বিদ্যাটির জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ওখানে এই বিদ্যার নাম ‘কৌজি’।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’ একটি বিনোদনের মাধ্যম হয়ে গড়ে ওঠে। এই সময়টিতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের ভ্রাম্যমাণ বাজারের সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন পর্যটক, পরিব্রাজক ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে বিভিন্ন মেলায় এই বিদ্যার প্রদর্শন শুরু হয়।
ইংল্যান্ডেই এই বিদ্যার দৃশ্যমান রূপের সূচনা হয় বলে ধরা হয়ে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভেন্ট্রিলোকুইজম একটি প্রতিষ্ঠিত বিনোদন মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু সেই সময় এই বিদ্যায় এখনকার মতো পুতুলের ব্যবহার ছিল না। তখন অন্য আওয়াজটি মনে হতো অনেক দূর থেকে আসছে যা এখন খুব কাছে একটি পুতুল রেখে করা হয়। ১৭৫৭ সালে অস্ট্রিয়ান ব্যারন ডি মেঙ্গেন নামে জনৈক ব্যক্তি প্রথম মঞ্চে পুতুলের ব্যবহার শুরু করেন।
এই ভেন্ট্রিলোকুইজমের আধুনিকায়নের পেছনে অনেক দক্ষ ব্যক্তির অবদান থাকলেও ফ্রেড রাসেলকেই আধুনিক ভেন্ট্রিলোকুইজমের জনক বলা হয়। এই ফ্রেড রাসেলই প্রথম ভেন্ট্রিলোকুইজমকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় স্টেজ শো করতেন। পরবর্তীতে পল উইনচেল, জিম্মি নেলসন, ডেভিড স্ট্রেসম্যান, জেফ দুনহাম, টেরি ফেটোর, ওয়েল্যান্ড ফ্লাওয়ার্স, সারি লুইস, উইলি টাইলার এবং জে জেনসন এর মতো অনেক গুণী ভেন্ট্রিলোকুইলিস্ট এ অদ্ভুত খেলায় যুক্ত হন।
এই উপমহাদেশে ভেন্ট্রিলোকুইজমের সূত্রপাত ঘটে ভারতের ‘প্রফেসর যশোয়ান্ত পাধ্যায়ে’র হাত ধরে। তার ছেলে রামদাস পাধ্যায় এই বিদ্যাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করেন প্রথম টেলিভিশনে দেখানোর মাধ্যমে। কিন্তু আঁকা সংস্কৃতির জনপ্রিয়তার সাথে সাথেই ভাটা পড়তে থাকে এই বিদ্যার। টিভিতে মানুষ অনেক বেশি আধুনিক হয়ে পড়তে থাকে, যার দরুন এই বিদ্যার গ্রহণযোগ্যতা বেশ কমে যায়। কিন্তু স্ট্যান্ড আপ কমেডির জনপ্রিয়তার সাথে সাথে বর্তমানে আবার নতুন করে তরুণদের মধ্যে ভেন্ট্রিলোকুইজমের প্রতি আগ্রহ জন্মাচ্ছে।
ভেন্ট্রিলোকুইজমের কলাকৌশল বেশ জটিল ও অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিকভাবে শব্দের উচ্চারণ করা ভেন্ট্রিলোকুইজমের জন্য অত্যাবশ্যক। সমস্ত ব্যাপারটির সময় ম্যাজিশিয়ান ঠোঁটে কোনো নড়াচড়া করতে পারে না বা করলেও তা মুখগহ্বরের মধ্যে খুব কৌশলে করতে হয়।
ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সাথের পুতুলটিকে সঠিক সময় সঠিকভাবে নড়াচড়া করানো। পুতুলের অঙ্গভঙ্গির প্রত্যুত্তরে মুখে ধরে রাখতে হয় সমগ্র মুখ বিস্তৃত হাসি। এর ফলে ঠোঁট যথেষ্ট ফাঁকা থাকে, এতে ঠোঁটের নড়াচড়া ছাড়াই শব্দ বেরোতে পারে ভেতর থেকে।
ভেন্ট্রিলোকুইস্টকে শব্দ উচ্চারণের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। স্বরবর্ণগুলো ঠোঁটের নড়াচড়া ছাড়াই উচ্চারণ করা যায় । কিন্তু বাংলায় (ব, ম, প) এবং ইংরেজিতে (f, v, p and m) ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখানেও তাকে বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হয়। এ কারণে একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ছোট শিশুর ডামি ব্যবহার করেন যাতে করে মনে হয় শিশুটি সব কথা এখনও উচ্চারণ করতে শেখেনি। তাদের মুখের এই অস্পষ্ট স্বরকেই স্বাভাবিক মনে হয়।
ভেন্ট্রিলোকুইজম অনেক প্রাচীন বিদ্যা হলেও এর জনপ্রিয়তা বহুকাল ধরে চলে আসছে। সাহিত্যাঙ্গনেও এই বিষয়ের উপর অনেক বই রচিত হতে দেখা যায়। সত্যজিত রায়ের ‘ভুতো’ গল্পটি তো অসম্ভব রোমহর্ষক একটি গল্প। বর্তমানে খুব কম সংখ্যক লোক এই বিদ্যার প্রতি আগ্রহ দেখায়। এই শিল্পে প্রয়োজন প্রচুর অনুশীলন এবং দক্ষ লেখনির হাত। তাই এই বিদ্যায় পারদর্শী হওয়াটা অবশ্যই চাট্টিখানি কথা নয়।