আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গরাও আছেন। এবি ডিভিলিয়ার্স কিংবা ব্রেন্ডন টেলরদের মতো আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গদের কে না চেনেন। কিন্তু সাদা চামড়ার কৃষ্ণাঙ্গ! এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, খানিকটা কাঁঠালের আমসত্বের মতো শোনাচ্ছে বৈকি। তবে এক অর্থে তেমন কিছুই কিন্তু অস্তিমান এই বিচিত্র বাস্তবতায়।
ধবধবে সাদা গায়ের রঙ, চুল এমনকি চোখের পাপড়িও সাদা, পিটপিট করে তাকায়, কেউ বা হাতে সাদাছড়ি নিয়ে চলে। কোনো না কোনো সময় এ ধরনের ব্যতিক্রমী মানুষ হয়ত পাঠকদের কারো চোখেও পড়েছে। আদতে এটি একটি রোগ। নাম আলবিনিজম। এ রোগে আক্রান্তদের বলে আলবিনো। এ রোগের দরুন দেহে মেলানিন নামক একধরনের রঞ্জকের তৈরি ব্যহত হয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এরা, প্রতি ১৭,০০০ থেকে ২০,০০০ জনে একজন। তবে আফ্রিকায় এই হার ৫০০০ থেকে ১৫,০০০ জনে একজন। আফ্রিকান আলবিনোরাই আজকের লেখার ‘সাদা চামড়ার কৃষ্ণাঙ্গ’।
যে মেলানিন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয়, যে অতিবেগুনি রশ্মিকে ধরা হয় জীবনঘাতী ক্যান্সারের অন্যতম কারণ, সেই মেলানিনই প্রায় অনুপস্থিত আলবিনোদের দেহে। দেড় ডলারের কমে যেখানে ৮০ ভাগ আফ্রিকানের দিন গুজরান হয়, সেখানে ইউরোপিয়ান আলবিনোদের মতো ১০-১৫ ডলারের সানস্ক্রিন ক্রিম মেখে বাইরে বেরোনোর সৌভাগ্য এদের হয় না। ৯০% আফ্রিকান আলবিনো তাই ৪০ বছরের বেশি বাঁচেনও না। সারা পৃথিবীতে আলবিনোদের শত্রু সূর্য। কিন্তু আফ্রিকার আলবিনোদের অতিরিক্ত একটি শত্রু রয়েছে- শিকারি। এই শিকারিদের কাছে প্রাণ না হারাবার প্রার্থনাতে তটস্থ থাকেন আলবিনোরা।
নিশ্চয়ই ভাবছেন মানুষ শিকার করে, এমন শিকারিও হয় নাকি? হ্যাঁ, হয়। গন্ডারের শিং, হাতির দাঁত, তক্ষকের চামড়া ইত্যাদির মতো আলবিনোদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নিষিদ্ধ বাজারে বিকোয়। তাই বনে যেমন পশু শিকার হয়, তেমনি বাসা বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বা চলার পথে দিনে-দুপুরে তুলে নিয়ে গিয়ে শিকার করা হয় আলবিনোদের। খোলাসা করা যাক ব্যাপারটি।
কুসংস্কারাবিষ্ট আফ্রিকায় এখনো মানুষ অর্থবিত্ত, ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কিংবা মনের মানুষকে বশে আনতে সেরা উপায় মনে করে কালোজাদুকেই। তানজানিয়া, মালাউই, মোজাম্বিকসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে কালোজাদু ও ডাকিনীবিদ্যা চর্চার একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে আলবিনোদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কালোজাদুকর ও তাদের অনুসারীদের বিশ্বাস, আলবিনোদের কাটা অঙ্গে কিছু ভেষজ লাগিয়ে মন্ত্র পড়লেই পূরণ হবে মনোবাঞ্ছা। শুধু কি তা-ই? এইডস সেরে যাবে, এই আশায় কবর থেকে আলবিনোদের লাশ তুলে কাজে লাগানো হয় কালোজাদুতে।
তানজানিয়ায় আলবিনোদের ডাকা হয় ‘দিলি’, ভাবার্থ যার ‘টাকা-পয়সা’। কেন এই নাম? হিসেবটা সহজ। যে জিনিস দিয়ে কালোজাদু করলে বড়লোক হওয়া যায়, তার পেছনে স্বাভাবিকভাবেই কোটি টাকার বাণিজ্যও হয়। আলবিনোদের দেহের প্রমাণ সাইজের ছোট একটি টুকরোর দামই ১০-২০ হাজার ডলার। বড়সড় পুরো একটি অঙ্গ প্রায় ৭৫ হাজার ডলার সমমানের। কী বীভৎস! কালোজাদুকরদের কাছে প্রত্যাদেশিত হয়ে অনেকে ভাড়াটে শিকারি দিয়ে হত্যা বা অঙ্গহানির কাজটি করান। আবার অনেক শিকারি নিজ থেকেই ‘শিকার’ করে জাদুকরদের বাজারে কোটি টাকায় আলবিনোদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট কিছু দিশেহারা মা-বাবা অবধি নিজ সন্তানকে শিকারির কাছে বিক্রি করেছেন, এমন প্রমাণও আছে।
আফ্রিকায় আলবিনোদের সবচেয়ে বড় নরক হলো তানজানিয়া। কেননা দেশটির প্রতি ১৪০০ জনেই একজন আলবিনো! ওদিকে দেশটির ৬০ ভাগ মানুষ বিশ্বাস রাখেন কালোজাদুতে। দেশটির কতিপয় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, খনি মালিক, জেলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হতে দ্বারস্থ হন কালোজাদুকরদের। নির্বাচনের সময় এলে এই তালিকায় নাম লেখান রাজনীতিবিদরাও। আর গবেষণামতে নির্বাচনের সময়েই আলবিনোদের ওপর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। তানজানিয়ানদের গড় আয় যেখানে মাসিক দেড় লাখ তানজানিয়ান শিলিং, সেখানে আলবিনোদের একটি ক্ষুদ্র দেহাংশের দাম ২ কোটি তানজানিয়ান শিলিং। জাতিসংঘের হিসেব মতে বিগত ১৮ বছরে তানজানিয়ায় ৮০ জন আলবিনোকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এ কথা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, দুর্গম আফ্রিকার অপরাধের কৃষ্ণগহ্বর থেকে সবটুকু তথ্য পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়।
রাজধানী দার-এস-সালামের পুলিশ কম্যান্ডার অগাস্টিন সেঙ্গার বক্তব্য অনুযায়ী, অপরাধ সংঘটিত হয় দুর্গম এলাকায়, অপরাধী অতঃপর গা ঢাকা দেয় মহাদুর্গমে, তাই তাদের ধরতে ভালোই বেগ পেতে হয় পুলিশকে। আলবিনো হত্যার দায়ে দেশটিতে সর্বশেষ ২০১৩ সালে ফাঁসি হয়েছে একজনের। অপরাধের ধরন এখন পাল্টেছে। পুরো প্রাণটা না নিয়ে শরীর থেকে দু-একটা অঙ্গ কেটে নিতে স্বচ্ছন্দ হচ্ছে অনেক শিকারি। ওদিকে অনিরাপদ এলাকাগুলো থেকে আলবিনো পরিবারদের শহরে পুনর্বাসনের কাজ করছে তানজানিয়ার সরকার। অনেক এলাকায় আবার গড়ে উঠেছে আলবিনোদের আশ্রম।
জনাব সেঙ্গার দাবি অনুযায়ী, অন্তত হত্যা নাকি কমেছে তানজানিয়ায়। তবে মালাউইতে হত্যা থেমে নেই। গত বছর হুইটনি চিলাম্ফা (২) ও হ্যারি মকোশিনি (৯) নামক দুই আলবিনো শিশুকে হত্যা করা হয়। এ বছরও হত্যা করা হয়েছে ফ্লেচার মাসিনা নামে এক আলবিনোকে। গোড়া থেকে হাত-পা তো বটেই, হৃদপিন্ড, কলিজা, ফুসফুস, চোখ, জিহবা, পুরুষাঙ্গ সব কিছুই কেটে নিয়ে যায় ঘাতকেরা। বাড়ির পাশের মাঠে কেবল পড়েছিলো মাসিনার বীভৎস মাথা, পাঁজর আর কতক নাড়িভুঁড়ি। তাকে হত্যা করেছিলো যে গরিব কৃষক, তার ফসল বেচার আয় ছিলো বছরে দুই লাখ মালাউই-কোয়াচা। অথচ হত্যার চুক্তিটি ছিলো ৪ কোটি কোয়াচার! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে বর্তমান অবধি দেশটিতে ২০টি খুনসহ আলবিনোদের ওপর মোট ৬৫টি আক্রমণ নথিবদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতির হুকুমে আলবিনোদের জন্য বিদ্যালয়ের বাইরে থাকে বাড়তি পুলিশি নিরাপত্তা।
অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ছিটেফোঁটা আছে এই সমস্যা। থান্ডাজাইল এমপুঞ্জি নামের এক কালোজাদুকরের কাছে প্রথমে এসেছিলো দুই তরুণ। বড়লোক হতে চেয়েছিলো তারা। আলবিনো তরুণীর হাত, চামড়া আর যোনী কেটে তাতে জড়িবুটি লাগিয়ে মন্ত্রপাঠ করলেই নাকি হবে কার্যসিদ্ধি। ব্যস, এমপুঞ্জিকে তরুণী হত্যায় সহায়তা করলো ঐ দুই তরুণ। আর বিস্ময়কর হলেও সত্য, প্রাথমিকভাবে মেয়েটিকে অপহরণ করবার কাজে ঐ দুই তরুণকে সাহায্য করেছিলো স্বয়ং তরুণীর প্রেমিক! এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেই রায় হয়েছে সেই ঘটনার। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে জাদুকরের। দুই তরুণের ২০ ও প্রেমিকের হয়েছে ১৮ বছরের কারাদণ্ড।
‘আন্ডার দ্য সেইম সান’ নামক এক সংস্থার জরিপমতে ২০১২ সাল থেকে আফ্রিকার ২৯টি দেশে আলবিনোদের ওপর ৫৭০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ২০৬টিই হত্যা! অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, গত বছর থেকে কানাডা ও পশ্চিমের কিছু উন্নত দেশে আফ্রিকান আলবিনোদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী পুনর্বাসন সংস্থা। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়েও আছে ভাবনা। কেনিয়ান আলবিনোদের জন্য দেশটির সরকার দেড় মিলিয়ন ডলারের সান কেয়ার সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। এসব সামগ্রী ব্যবহার না করলে শিকারি বিনাই মারা পড়বে আলবিনোরা, শুধু একটু ধীরলয়ে।
এবার দেখুন দেড় মিনিটের এই ছোট ভিডিওটি।
রোগের দরুন স্বাস্থ্যঝুঁকি আর নিরাপত্তা শঙ্কাই কেবল নয়, আফ্রিকান সমাজে বাঁকা চোখেও দেখা হয় এই আলবিনোদের, যেমনটি দেখানো হয়েছে ভিডিওটিতে। আলবিনোদের অধিকার রক্ষায় ও বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করছে স্থানীয় অনেক সামাজিক সংগঠন। জিম্বাবুয়ের সরকার গত অক্টোবরে চালু করেছে ‘বিয়ন্ড দ্য স্কিন’ নামক ক্যাম্পেইন। আলবিনিজম সম্পর্কিত কুসংস্কারের মূলোৎপাটন ও সর্বপ্রকার বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলাই যার লক্ষ্য। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অনুযায়ী, আলবিনিজমে আক্রান্তরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির হয়। কিন্তু তারাই বা কতটুকু সুস্থ-স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন, যারা বর্ণ-ধর্ম-গায়ের রঙ ইত্যাদির ধাঁধায় ‘মানুষ’ পরিচয়টিকেই ঝাপসা দেখে কিংবা দেখেই না?
ফিচার ছবি: listverse.com