প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশের মানুষ সাপ এবং সাপের কামড়ের সাথে পরিচিত। কখনই সাপ দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ৭,০০,০০০ সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটে এবং তার মধ্যে প্রায় ৬,০০০ মানুষ মারা যান। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে, বাড়িতে নারী ও শিশুরা এবং ক্ষেত-খামারে কৃষকেরা সাপের কামড়ের শিকার হন। এর ফলে বিষ সংক্রান্ত আঘাতের সৃষ্টি হয়, যা থেকে বিভিন্ন জটিলতাসহ মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বেশিরভাগ মানুষ এখনও এ বিষয়ে সচেতন নন। মোট আক্রান্ত মানুষের মাত্র ৩% হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। বাকী ৯৭% মানুষ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে যান। ফলে সঠিক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু ঘটে। তাই এ বিষয়ে সচেতন করাই আজকের লেখার উদ্দেশ্য।
সাপ সম্পর্কে আমাদের সবারই মোটামুটি ধারণা রয়েছে। তবুও সাপ নিয়ে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করা যাক। সাপ কর্ডাটা পর্বের রেপটাইলিয়া শ্রেণির অন্তর্গত একটি প্রাণী। আশ্চর্যজনক কথা হল, আচরণগত দিক থেকে সাপ খুবই নিরীহ, সহজে এরা আক্রমণ করে না। শুধুমাত্র যখন কোনো কিছুকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে, তখন আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে কামড়ে দেয়। এদের তালুতে ‘জ্যাকবসনের সংবেদী অঙ্গ’ নামক (Jacobson’s sense organ) একটি অঙ্গ থাকে, যার মাধ্যমে পরিবেশে বিভিন্ন বস্তু/জীবের উপস্থিতি সনাক্ত করে। পিট ভাইপারগুলোতে চোখ ও চোয়ালের মাঝখানে তাপ সংবেদী ছিদ্র থাকে। সাপের দেহে বাহ্যিক কোনো কান নেই কিন্তু মধ্যকর্ণ রয়েছে। তাই সাপ শুনতে পায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সাপের দাঁতকে ইংরেজীতে ফ্যাং (Fang) বলে। নির্বিষ সাপে অনেকগুলো দাঁত থাকে, যেগুলো আকারে ছোট হয়। কিন্তু বিষধর সাপে প্রধানত দু’টি লম্বা, বাঁকানো ও নালিযুক্ত দাঁত থাকে। দাঁত দু’টি উপরের চোয়ালের সাথে যুক্ত এবং মিউকাস পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। সাপের কামড়ের সময় এই দাঁতগুলো সামনের দিকে সামান্য সোজা হয়ে যায় এবং শিকারের দেহে প্রবেশ করে। এই লম্বা দাঁতের পাশাপাশি ছোট দাঁত থাকতেও পারে, নাও পারে।
আমাদের দেশে প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রায় ২৮ প্রজাতি বিষধর, যার ১২ প্রজাতি সামুদ্রিক। সমস্ত সাপকে প্রধানত দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে-
১. নির্বিষ সাপ
২. বিষধর সাপ
বাংলাদেশে পাওয়া যায়, এমন কিছু নির্বিষ সাপের মধ্যে কিছু সাধারণ সাপ হলো- অজগর (Python), বোয়া, ঢোড়া/মাইট্টা সাপ (Keelback), দু’মুখো সাপ (Blind snake), আঁচিল সাপ (Wart snake), ফণিমনসা (Cat snake), লাউডগা সাপ (Vine snake), ধারাজ সাপ (Rat snake), পাইন্যা সাপ (Water snake) প্রভৃতি।
বাংলাদেশের বিষধর সাপগুলোকে কয়েকটি পরিবারে ভাগ করা হয়েছে:
- এলাপিডি পরিবার: গোখরা (Cobra), কাল-কেউটে (Krait)
- ভাইপারিডি পরিবার: রাসেলস ভাইপার (Russel’s Viper), সবুজ পিট ভাইপার (Green Pit Viper)
- হাইড্রোপিডি পরিবার: সামুদ্রিক সাপ (Sea snakes)
এবার সাপের বিষ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া যাক। সাপের বিষ মূলত সাপের লালা এবং বিষগ্রন্থি হলো বিশেষায়িত লালাগ্রন্থি। এই বিষগ্রন্থিগুলো চোখের পেছনে, নিচের দিকে থাকে। গ্রন্থি থেকে নালির মাধ্যমে বিষ দাঁতে সঞ্চারিত হয়। যখন সাপ কামড় দেয়, তখন ওই লম্বা দাঁতের নালির মাধ্যমে বিষ আক্রান্তের দেহে প্রবেশ করে। সাপের বিষ একটি প্রোটিন জাতীয় পদার্থ যার প্রধান উপাদান জুটক্সিন (Zootoxin)। প্রজাতিভেদে এর উল্লেখযোগ্য উপাদানসমূহ:
১. টক্স্যালবুমিন:
- হিমোটক্সিন
- নিউরোটক্সিম
- প্রোটিয়োলাইসিন
- কার্ডিওটক্সিন
- ফ্রিবিনোলাইসিন
- মায়োটক্সিন
২. এনজাইম:
- ফসফোলাইপেজ A
- প্রোটিয়েজ
- হায়ালিউরোনিডেজ
- কোলিনেস্টারেজ
- কোয়াগুলেজ
- হাইড্রোলেজ
- ট্রান্স এমাইনেজ
- এটিপিএজ
৩. পেপটাইড এবং পলিপেপটাইড
মানবশরীরে সাপের বিষের প্রভাব
সাপের বিষ আক্রান্ত স্থান হতে রক্ত এবং লসিকার মাধ্যমে দেহের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ক্রিয়া শুরু করে দেয়। স্বাভাবিক ত্বকে এর কোনো প্রভাব নেই। আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রকার সাপের বিষ পাওয়া যায়।
- নিউরোটক্সিক
- হিমোটক্সিক
- সাইটোটক্সিক
যে সমস্ত বিষ নিউরোটক্সিক, সেগুলো স্নায়ু, স্নায়ুসন্ধি, মস্তিষ্কের শ্বাস-প্রশ্বাস কেন্দ্র প্রভৃতির উপর কাজ করে। নিউরোটক্সিক বিষ মাংশপেশীকে অসাড় করে দেয়। ফলে শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়।
হিমোটক্সিক বিষ রক্তকণিকা ভেঙে ফেলে, রক্ত জমাট বাঁধায়। এছাড়াও হৃদপেশী, রক্তবাহিকা প্রভৃতির উপর কাজ করে এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, শক প্রভৃতির মাধ্যমে মৃত্যু ঘটায়।
সাইটোটক্সিক বিষ শরীরের বিভিন্ন কোষগুলোকে আক্রমণ করে অসাড় করে দেওয়ার ফলে কোষের মৃত্যু হয়।
সাপ কামড়ানোর উপসর্গ সমূহ
কিছু সাধারন উপসর্গ দেখে সাপের কামড় কিনা, তা নির্ণয় করা যায়। যেমন:
- সাধারণ: মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি করা, পেট ব্যথা, আক্রান্ত স্থান ফুলে যাওয়া
- স্নায়বিক: মাংশপেশীর অসাড়তা, নাসিক কণ্ঠস্বর, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসা, ঘাড়ের মাংশপেশীর অসাড়তা, গিলতে বা জিহ্বা বের করতে বা চোয়াল নাড়াতে কষ্ট হওয়া, ঝাপসা দৃষ্টি, শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া, দুর্বলতা, খিঁচুনী, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
- রক্ত সম্পর্কিত: আক্রান্ত স্থান হতে ক্রমাগত রক্তপাত, দাঁতের মাড়িতে রক্তপাত, রক্তবমি, কাশি বা মূত্রের সাথে রক্ত যাওয়া প্রভৃতি।
কামড়ের চিহ্ন দেখে সাপের ধরণ নির্ণয়
যদি আপনাকে বা আপনার পরিবারের কাউকে সাপ কামড় দেয়, তবে কীভাবে বুঝবেন সেটি বিষধর সাপ নাকি নির্বিষ সাপের কামড়? এর জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। বিষহীন সাপের কামড়ে আক্রান্ত স্থানে অনেকগুলো দাঁতের চিহ্ন থাকে, যেগুলো অগভীর। এই অগভীর চিহ্নসমূহ সারিতে বিন্যস্ত থাকে। কিন্তু বিষধর সাপের কামড়ে দু’টি গভীর ক্ষত চিহ্ন থাকে। এক্ষেত্রে ছোট দাঁতের চিহ্ন থাকতেও পারে, নাও পারে। এছাড়া বিষধর সাপের ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থান লাল, নীল, কালো ইত্যাদি রং ধারণ করতে পারে।
সাপ কামড়ালে কী করবেন?
হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় অধিকাংশ মানুষ কী করতে হবে তা বুঝে উঠতে পারেন না। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, কিংবা সাপটিকে মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এসময় ঠাণ্ডা মাথায় আপনার নেওয়া কিছু সাধারণ পদক্ষেপই বাঁচিয়ে দিতে পারে কারো মহামূল্যবান জীবন।
১. আশ্বস্তকরণ: আক্রান্ত ব্যক্তিকে বার বার আশ্বস্ত করতে হবে এবং সাহস দিতে হবে, আতঙ্কগ্রস্ত হতে দেয়া যাবে না। কেননা, নির্বিষ সাপের কামড়েও অত্যধিক আতঙ্কিত হয়ে মানসিক আঘাতে মারা যেতে পারেন। (বাংলাদেশের অধিকাংশ সাপই বিষহীন। হাতেগোনা কিছু সাপ বিষধর। আবার, বিষধর সাপ পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ ঢুকিয়ে দিতে ব্যর্থ হতে পারে। এসব জানানোর মাধ্যমে রোগীকে আশ্বস্ত করা যেতে পারে)।
২. আক্রান্ত অঙ্গ অবশ্যই স্থির রাখতে হবে। হাতে হলে হাত নড়ানো যাবে না, পায়ে হলে হাঁটাচলা করা যাবে না, স্থির হয়ে বসতে হবে।
৩. আক্রান্ত অঙ্গ ব্যান্ডেজের সাহায্যে একটু চাপ দিয়ে প্যাঁচাতে হবে। একে প্রেসার ইমোবিলাইজেশন বলে। ব্যান্ডেজ না পাওয়া গেলে গামছা, ওড়না বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে।
৫. যদি সাপটিকে ইতোমধ্যে মেরেই ফেলেন, তাহলে সেটি হাসপাতালে নিয়ে আসুন। তবে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোভাবেই হাত দিয়ে ধরা যাবে না। কেননা কিছু সাপ মরার ভান করে থাকে। তবে সাপ মারতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
৬. যত দ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
যে কাজগুলো কোনোভাবেই করা যাবে না
অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে আমরা এমন কিছু কাজ করি, যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হয়ে যায়। তাই এ ব্যাপারে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি।
১. কোনো ধরনের শক্ত বাঁধন/গিঁট দেওয়া যাবে না। সাধারণত দেখা যায়, হাত বা পায়ে কামড় দিলে, কামড়ানো জায়গা হতে উপরের দিকে দড়ি বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়, যাতে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। উপরন্তু, এতে বন্ধনকৃত হাত/পায়ে রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে রক্ত প্রবাহের অভাবে টিস্যুতে পচন (Necrosis) শুরু হতে পারে।
২. চিকিৎসার জন্য ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে না
৩. কামড়ানো স্থানে ব্লেড, ছুরি প্রভৃতি দিয়ে কোনো প্রকার কাটাকুটি করা যাবে না
৪. অনেক মানুষের ধারণা, আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে বিষ বের করলে রোগী ভালো হয়ে যাবে। মূলত বাংলা সিনেমাগুলোর কল্যাণে এমন ভ্রান্ত ধারণার উদ্ভব হয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কেননা বিষ রক্ত এবং লসিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা কোনোভাবেই চুষে বের করা সম্ভব নয়। তাই কোনো অবস্থাতেই আক্রান্ত স্থানে মুখ দেয়া যাবে না।
৪. কোনো ধরনের ভেষজ ঔষধ, মুখের লালা, পাথর, উদ্ভিদের বীজ, গোবর, কাদা ইত্যাদি লাগানো যাবে না
৫. কোনো রাসায়নিক পদার্থ লাগানো বা তা দিয়ে ছ্যাঁক দেয়া যাবে না
৬. যদি আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো কিছু গিলতে বা কথা বলতে সমস্যা হয়, বমি, অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ, নাসিক কন্ঠস্বর ইত্যাদি দেখা দেয় তাহলে কোনো কিছু খাওয়ানো যাবে না
৭. কোনো কিছু খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না
৮. ব্যাথা নিবারণের জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না
৯. হাসপাতালে নিতে অযথা দেরি করা যাবে না।
অ্যান্টিভেনম নিয়ে কিছু কথা
সাধারণত বিষধর সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। অ্যান্টিভেনম বা প্রতিবিষ শরীরে সাপের বিষকে ধ্বংস করে দেয়। ঘোড়ার দেহে সাপের বিষ প্রবেশ করার মাধ্যমে ঘোড়ার দেহে অ্যান্টিভেনম তৈরী হয়, যা পরবর্তীতে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। তবে সব বিষধর সাপের বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভেনম কার্যকরী নয়। যেমন- সবুজ পিট ভাইপার, সামুদ্রিক সাপ। আবার, আমাদের সবার দেহে অ্যান্টিভেনম কাজ নাও করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অ্যান্টিভেনম এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এতে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
তাই একমাত্র রেজিস্টার্ড ডাক্তারই সাপের ধরন, কামড়ের ধরন ও উপসর্গ প্রভৃতি দেখে অ্যান্টিভেনমের ব্যপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং রোগীর/ রোগীর অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে রোগীর দেহে প্রয়োগ করবেন।
সচেতন হওয়ার মাধ্যমেই আমরা একদিকে সাপের কামড় যেমন এড়াতে পারি তেমনি কামড় দিলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে বাঁচিয়ে দিতে পারি মানুষের মহামূল্যবান জীবন। তাই সচেতনতা একান্তভাবে কাম্য।