উচ্ছল এক বন্ধু দল মৃদুলাদের। সাতজনের দলে চারজন মেয়ে, তিনজন ছেলে। গোটা ক্যাম্পাস মাথায় তুলে রাখতে এই সাতের একসাথে থাকাই যথেষ্ট, হৈচৈ আর আড্ডার তোড়ে সবার কান ঝালাপালা করে দেয় এরা। খেতে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, কেনাকাটা কিংবা দল বেঁধে পড়াশোনা করতে বসা, সব কাজেই দেখা যায় এদের। যদিও এত হাসি আর গল্পের কখনো কখনো সুর কেটে যায়, যখন তুহিন ঐ অদ্ভুত আচরণগুলো করে। মেয়েদের সাথে কেমন যেন একটা সূক্ষ্ম রেষারেষি ওর, অবিশ্বাস বা অবজ্ঞার সম্পর্ক। সবসময় এমনটা করে না, কিন্তু মাঝেমাঝে খুব প্রবলভাবে দেখা যায় এই ব্যাপারটা।
মেয়েরা এই কাজটা ভালো পারবে না, ঐ জায়গায় মেয়েরা ছিল বলে এত ঝামেলা হয়েছে, এসব কথা প্রায়শই শোনা যায় তার মুখে। দলের বাকিরা মিলে আচ্ছা মতন বকে দিলে অবশ্য চুপ হয় সে, কিন্তু তাতে কী! মেয়েদের নিয়ে তুহিনের এই ধারণাগুলো তো পাল্টায় না। মৃদুলা আর বাকি মেয়েরা টের পায়, তুহিনের মনে তাদের জন্য একটা তীব্র অপছন্দের জায়গা ঠিকই রয়েছে, যেটা সে সবসময় আড়ালে রাখতে পারে না। এর কোনো কারণ তারা ভেবে পায় না। কিংবা হয়তো তুহিন নিজেও কোনো কারণ দিতে পারবে না।
সহকর্মীদের কাছে কাজেকর্মে সহায়ক মনোভাবই পেয়ে থাকেন ফারজানা। সন্তানের জন্মের পর যখন বিরতি কাটিয়ে কাজে ফিরলেন, অফিসের সকলেই বেশ সাহায্য করেছিল তাকে কাজ গুছিয়ে নিতে। নিজে ভীষণ কর্মঠ আর সবার প্রয়োজনে সাহায্য করেন বলে সবাই তাকে খুব পছন্দ করে অফিসে। ব্যতিক্রম কেবল হামিদ সাহেব। কেন যেন উনি ফারজানাকে সহজভাবে নিতেই পারেন না। সুযোগ পেলেই ফারজানাকে বিদ্রূপ করা, কাজের সমালোচনা করা, এগুলো তার অফিস ডিউটি যেন। কেবল ফারজানা নয়, অন্য নারী সহকর্মীদের সাথেও তার আচরণ এরকম। ফারজানা বুঝে উঠতে পারেন না, এর পেছনে কোনো কারণ কি আদৌ রয়েছে নাকি স্রেফ আনন্দের জন্য এমনটা করেন হামিদ সাহেব। কিন্তু এসব করে কেমন আনন্দই বা পাচ্ছেন তিনি?
উপরের চিত্র দুটি কাল্পনিক, কিন্তু এগুলো বাস্তবিক ঘটনারই প্রতিরূপ। নারীর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশের খুব সাধারণ ধরন এসব। একজন মিসোজিনিস্ট অর্থাৎ নারীবিদ্বেষী মানুষ সহজাতভাবেই এই আচরণগুলো প্রদর্শন করে থাকে। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা, মূলত এটাই প্রকাশ করে তারা তাদের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিতে। নারীদের অপছন্দ করা, কিংবা ঘৃণা করা এবং অবিশ্বাস করা, এসবই নারীবিদ্বেষ। এই বিদ্বেষের ব্যাপারটা এতই জটিল যে প্রায় ক্ষেত্রেই একজন পুরুষ নিজেই বুঝে উঠতে পারে না যে তিনি নারীবিদ্বেষী। নিজের আশেপাশে এই জাতটাকে চিহ্নিত করাও কঠিন হয়।
ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামির দর্শনের অধ্যাপক বেরিট বোগার্ট নারীবিদ্বেষীদের নিয়ে তার চিন্তাধারা জানিয়েছেন সাইকোলজি টুডের এক প্রতিবেদনে, সেটি এখানে তুলে ধরা হলো। নারীর প্রতি ঘৃণা একজন পুরুষের মনে অবচেতনভাবেই থাকে, যা তৈরি হয় অনেকদিন ধরে। জীবনের একদম প্রাথমিক ধাপে যদি একটি ছেলে নারীজাতির কোনো সদস্য দ্বারা অবহেলিত হয়, সেটা হতে পারে মা, বোন কিংবা প্রেমিকা, সেটি তার মধ্যে নারীদের প্রতি ঘৃণার বীজ বপন করে দিতে পারে। এই ঘৃণাই ধীরেধীরে ডালপালা মেলে বড় হতে থাকে, পরিণত হয় বিদ্বেষে। মনের যত আবেগ, চিন্তাধারা বা সিদ্ধান্ত, সবকিছুতে প্রভাব ফেলতে থাকে এটি। প্রচ্ছন্ন থেকে একসময় প্রকট রূপ ধারণ করে নারীবিদ্বেষ আর তখন হয়তো সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার পথ আর খোলা থাকে না।
চিহ্নিতকরণ মুশকিল হলেও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য তো আছেই যেগুলো নারীবিদ্বেষী পুরুষের সাথে মিলে যায়। সেসব নিয়েই বলা হয়েছে এখানে। পরিচিত একজন পুরুষ নারীদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব রাখছে কিনা, সেটা ক্ষতিকারক কিনা বা কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার প্রতিটি নারীর।
একজন নারীবিদ্বেষী পুরুষ প্রাথমিকভাবে নারীর প্রতি বেশ কমনীয় হতে পারে। আর ঠিক সে কারণেই নারীরা তার সাথে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের দরকার মনে করবে না, সহজ আচরণ করবে। যত সময় যাবে, পুরুষটি একটি লুকোচুরির স্বভাব প্রকাশ করতে থাকবে। তার আচরণের পরিবর্তন হবে খুব দ্রুত, এই খুব ভালো তো পরক্ষণেই বেশ খারাপ ব্যবহার, তারপর চট করে আবার ভালো ব্যবহার করা, এরকমটা হতে পারে। এবং অবধারিতভাবেই, এসব হবে নারীদের কিংবা কোনো একজন নারীর প্রতি যাকে সে নিশানা হিসেবে বেছে নিয়েছে।
নারীদেরকে সে কথা দেবে, বিভিন্ন প্রতিজ্ঞা করবে আর সেগুলো ভুলেও যাবে, পূরণ করতে অনীহা দেখাবে। অন্যদিকে, পুরুষদের দেয়া প্রতিজ্ঞা রাখতে কিন্তু তার কোনো অবহেলা থাকবে না। পুরুষদের প্রতি তার আচরণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও ভদ্র, যেখানে নারীদের সাথে সাধারণ ভদ্রতা রক্ষায়ও তার আপত্তি দেখা যায়। কোনো নারীর সাথে দেখা করার বেলায় অফিসের বাইরে কোনো মিটিংয়ে সে দেরি করবে, অপেক্ষায় রাখবে ঐ নারীকে। অথচ কোনো পুরুষের সাথে এমন আচরণ সে করবে না।
মেয়েদের উপর চোটপাট করা একজন নারীবিদ্বেষী পুরুষের স্বভাব। মেয়েদের প্রতি তার কথাবার্তায় থাকবে কটাক্ষ। মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া আর আত্মকেন্দ্রীক হওয়া এমন পুরুষদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ব্যাপারটা এমন হতে পারে, যে মেয়েটি তার জন্যেই খেটে মরছে, হয়তো মেয়েটি তার স্ত্রী, সে মেয়ের কাজকর্মকে ছোট করে সে প্রতিনিয়ত তৃপ্তি পাচ্ছে। মেয়েটির প্রতি একবিন্দু মনোযোগী না হয়ে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। কারণ সেই মনের ভেতর রাজত্ব করা ভয়াবহ ঘৃণা, যা তাকে একজন মেয়ের প্রতি সদয় হতে দেয় না।
সামাজিকভাবে একটা মেয়ে তার কাছে সর্বদাই পুরুষের অধীন। কর্মক্ষেত্র হোক, পরিবার হোক বা অন্য কোথাও, অন্য কোনো মাধ্যমে সে সবসময়ই একজন মেয়েকে একজন ছেলের চেয়ে হীন বানাবে। যে কাজের জন্য সে তার একটা ছেলে বন্ধু কিংবা পুরুষ সহকর্মীর প্রশংসা করবে, একই কাজের জন্য নিন্দা করবে একটা মেয়ের। কারণটা বেশ সরল, সে নারীবিদ্বেষী।
মেয়েদের সাথে প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক আচরণ থাকবে একজন নারীবিদ্বেষীর। সামাজিকভাবে বা কাজের জায়গায় একজন মেয়ে তার চেয়ে ভালো কাজ করলে সেটা তার কাছে ভয়াবহ কিছু হবে। ঐ মেয়ের প্রতি তার বিদ্বেষ বাড়বে আরো অনেকটাই। এমনকি একজন নারীর কাজকে সে নিজের নামে চালিয়ে অবধি দিতে পারে! একই জায়গায় কাজটা যদি কোনো ছেলে করে থাকে, তার প্রতিক্রিয়া হবে মিশ্র।
একজন নারীকে তিক্ততা অনুভব করাতে সাধ্যের সবটুকু করতে পারে এমন একজন ব্যক্তি। নারীদের সবার সামনে অপমান করে আনন্দ পাবে। নারীর সাথে সম্পর্কে সে নিজের খুশিমত যৌনতা চাইবে, কিংবা সঙ্গীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে বন্ধ করবে। সঙ্গীকে ঘুরতে নিয়ে গেলেও তার সাথে তার প্রত্যাশার ঠিক বিপরীত আচরণটাই করবে। সম্পর্কে প্রতারণা করাটাও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এমন পুরুষদের জন্য। যখন খুশি সম্পর্ক ছেড়ে চলে যাওয়া আর তারপর যখন আবার এসে কোনো গল্প ফেঁদে সঙ্গীকে সম্পর্কে ফেরত আনার চেষ্টা করা, একজন নারীবিদ্বেষী পুরুষের এসব বিদ্যা বেশ ভালো জানা আছে।
এই পুরুষেরা সময়ের সাথে হয়ে উঠতে পারে কল্পনাতীত ভয়াবহ। তাই ঠিক সময়ে এদের চিহ্নিত করে নেয়া নারীর জন্য খুব জরুরি। আর যদি আপনি তেমন কাউকে খুঁজে পান, তবে তাকে জানিয়ে দিতে ভুলবেন না যেন, সে যে ধরা পড়ে গেছে!
ফিচার ইমেজ: Charles Sledge