আদিম যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্যতা, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ মারা গিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যুগে যুগে নানা রকমের রোগ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ আবিষ্কার করেছে হরেক রকম ওষুধ। পানির অপর নাম যদি জীবন হয়, ওষুধের অপর নামও জীবন বলা যায়। কারণ ওষুধ বাঁচিয়েছে অজস্র মানুষের জীবন।
একটি ওষুধ আবিষ্কার করে তা বিপণন উপযোগী করে তুলতে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অজস্র অর্থ খরচের পাশাপাশি লাগে কয়েক বছর সময়। এই মহাযজ্ঞ শেষ করে যখন জীবনরক্ষার্থে এই ওষুধ সাধারণ মানুষের নাগালে আসে, তখন অনেক সময় উদঘাটন হয়, এই ওষুধ জীবন রক্ষাকারী নয়, জীবন হন্তারক; এই ওষুধ সেবনে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে ক্ষতিকর কোনো ব্যাধিতে। এমনই এক জীবন হন্তারক ওষুধ ট্রোগ্লিটাজন সম্পর্কে জানা যাক।
১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাস, নিউজিল্যান্ড জার্নাল অভ মেডিসিন ট্রোগ্লিটাজনের ওষুধি গুণ নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। এই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল, ট্রোগ্লিটাজন ইনসুলিন প্রতিরোধ্যতা কমানোর মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেরল্ড অলেফস্কাই ছিলেন এই গবেষণা প্রবন্ধের একজন গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ লেখক। তিনি মানব শরীরে ট্রোগ্লিটাজনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করার জন্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ ডায়াবেটিস এন্ড ডায়জেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজে যান এবং ১৯৯৫ সালে সংস্থাটির অনুমতিও পান।
ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি ‘রেজিলিন’ নাম দিয়ে ট্রোগ্লিটাজন তৈরি করতে চায়। এজন্য কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার কাছে অনুমতি চায়। কিন্তু সবাই ট্রোগ্লিটাজনের ওষুধি গুণ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার মেডিক্যাল অফিসার জন গুয়েরিগুয়আন তখনকার সময়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের তুলনায় ট্রোগ্লিটাজনের কার্যকারিতা খুব বেশি নয় বলে উল্লেখ করেন।
দুটি ফেজ থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে রোগীদের যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ক্ষতিকর লক্ষণ দেখা যাওয়াতে গুয়েরিগুয়আন ট্রোগ্লিটাজনের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে ট্রোগ্লিটাজন বাতিল করার পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি এই প্রতিবেদনটি খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার পরামর্শক কমিটিকে দেখায়নি। পরামর্শক কমিটি ট্রোগ্লিটাজনের ক্ষতিকর প্রভাব না জানার কারণে ট্রোগ্লিটাজনকে কার্যকর ওষুধ ভেবে খুব দ্রুত ১৯৯৬ সালের ১১ ডিসেম্বর অনুমতি দিয়েছিল।
ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে এই ওষুধটি বাজারজাত করে। অভূতপূর্বভাবে লোকজন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় এই ওষুধ সেবন শুরু করল। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ট্রোগ্লিটাজন যুক্তরাষ্ট্রে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় সেবন করা যায়, এমন ওষুধের ১২ শতাংশ বাজার দখল করে ফেলল।
যুক্তরাজ্যের গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম কোম্পানিও ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে ট্রোগ্লিটাজন বাজারজাত করা শুরু করল। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখের মধ্যেই এই ওষুধটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম কোম্পানি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে যকৃত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ১৩৫টি ঘটনা শনাক্ত হয় এবং ৬ জন মারাও গিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে ট্রোগ্লিটাজন প্রত্যাহারের ফলে ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানির শেয়ার ১৮.৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এত কিছু ঘটার পরেও যুক্তরাষ্ট্রে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার অব্যাহত থাকল। এর ফলে ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানির শেয়ার আবারও বাড়তে লাগল।
১৯৯৭ সালে অড্রেয় লারু জোন্স নামে একজন সুস্থ স্কুলশিক্ষক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটি সেবন করেছিলেন। তার ইমপ্যায়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স ছিল, তাই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ছিল। ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে জোন্স ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটি সেবন করেছিলেন। কিন্তু ওষুধ সেবনের সাত মাস পর তার যকৃৎ অকার্যকর হয়ে যায়; ১৯৯৮ সালের ১৭ মে তিনি মারা যান।
জোন্সের মৃত্যুর পর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডায়জেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজ, ১৯৯৮ সালের জুন মাসের ৪ তারিখ ট্রোগ্লিটাজন নিয়ে চলমান পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করে, যাতে তারা জোন্সের মৃত্যুর সাথে ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটির কোনো যোগসূত্র নেই বলে উল্লেখ করেছিল।
১৯৯৮ সালের ২৭ জুলাই, সিডনি এম. ওলফে এবং ল্যারি স্যাসিচ পাবলিক সিটিজেনস হেলথ রিসার্চ গ্রুপের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার মাইকেল ফ্রাইডম্যানের কাছে একটি আবেদন করেন। এই আবেদনে তারা ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বলেন। তারা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আরও জানতে চান, আর কতজন মানুষ মারা গেলে কিংবা আর কতজন মানুষের যকৃত প্রতিস্থাপন করলে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে।
ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার নিষিদ্ধের আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তৎকালীন অনেক প্রসিদ্ধ ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বলেন, ট্রোগ্লিটাজন কোনোভাবেই নিষিদ্ধ করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রোগ্লিটাজন ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকল। সাধারণ নাগরিকেরা ট্রোগ্লিটাজন প্রত্যাহারের জন্য খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার কাছে আবেদন করতে থাকল। অন্যদিকে, নেতৃস্থানীয় চিকিৎসকরা ট্রোগ্লিটাজন ব্যবহারের পক্ষে মতামত জানিয়ে বলেছিলেন, হতাহত ছাড়া কোনো যুদ্ধ হয় না।
১৯৯৯ সালের ১৮ আগস্ট, ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এককভাবে ট্রোগ্লিটাজন ব্যবহার না করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বলা হলো। কিন্তু ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্য কোনো ওষুধের সাথে কম্বিনেশন ড্রাগ হিসেবে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার অব্যাহত থাকল।
ডেভিড উইলম্যান নামে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ট্রোগ্লিটাজনসহ তৎকালীন আরও কিছু ওষুধ নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখেন। এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ডেভিড পুলিৎজার পুরস্কার পান।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার মেডিক্যাল অফিসাররা নেতৃস্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিবিদের কাছে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার কতটুকু অনিরাপদ, তা নিয়ে কিছু তথ্য ফাঁস করেছিলেন। এর ফলে ট্রোগ্লিটাজনের নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। অবশেষে, খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থা ২০০০ সালের ২১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে ট্রোগ্লিটাজন প্রত্যাহার করে।
মার্চ ১৯৯৭ থেকে মার্চ ২০০০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১.৯২ মিলিয়ন মানুষ ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটি সেবন করে। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার ডেভিড গ্রাহাম একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে একজন ট্রোগ্লিটাজন ওষুধ সেবনকারীর যকৃৎ অকার্যকর হয়েছিল। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০০০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯৪ জনের যকৃতের অকার্যকারিতা শনাক্ত হয়, ৬৬ জন মারা যায় এবং ১১ জনের যকৃত প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়।
ট্রোগ্লিটাজন দুর্ঘটনার ফলে ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ৩৫,০০০ মামলা করা হয়। মামলার ফলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছিল এই কোম্পানিকে।
ট্রোগ্লিটাজন দুর্ঘটনা আমাদের দেখাল, ওষুধ শুধু জীবন রক্ষাকারী নয়, মাঝে মাঝে জীবন হন্তারকও হয়। আগামীতে হাজির হব নতুন কোনো জীবন হন্তারক ওষুধের কাহিনী নিয়ে। ততদিন পড়তে থাকুন আপনাদের প্রিয় রোর মিডিয়ার অন্যান্য লেখা।