বিশ্বজুড়ে এখন চীনের উহান নগরীর নাম শুনেই গা শিউরে উঠে কারো কারো। গবেষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই উহান নগরী থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। তবে দীর্ঘদিন যাবতই এই শহরের খ্যাতি ছিল পশুপাখির অন্যতম বৃহত্তম বাজার হিসেবে, জীবন্ত পশুপাখির পাশাপাশি এইসব বাজারে এদের প্রক্রিয়াজাত মাংসও বিক্রি করা হয়ে থাকে। চীনে এই ধরনের বাজার (অনেকেই এই বাজারগুলোকে ‘Wet Market’ ও বলে চিহ্নিত করে থাকেন) দুর্লভ নয়, সামুদ্রিক আর প্রান্তিক বনাঞ্চল এলাকায় গড়ে ওঠা একইধরনের বাজারে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর এক অদ্ভুত সমাহার দেখা যায়। আর চীনের এই পশুপাখি-মাংসের বাজার থেকেই বারবার জন্ম নিচ্ছে একেকটি বৈশ্বিক মহামারী।
২০০৩ সালে বিশ্বব্যাপী সার্স ছড়িয়ে পড়ার পেছনেও দায়ী করা হয় চীনের গুয়াংডং প্রদেশের ‘ফশান’ নগরীর পশুপাখির বাজারকেই, এটিও চীনের দক্ষিণপ্রান্তের এক উপকূলীয় এলাকায়। সামুদ্রিক প্রাণীর পাশাপাশি এই বাজারে হরহামেশাই দেখা মিলতো বন্যপ্রাণীর। সার্স মহামারীর জন্য দায়ী করা হয়েছিল এই বাজারের ‘সিভেট ক্যাট’ (Paguma larvata) নামের একধরনের বিড়ালকে।
গবেষকদের জীনতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় এই বিড়াল থেকেই মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম সার্স ভাইরাস ছড়াতে থাকে। বিশ্বব্যাপী সার্স ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে চীন সাময়িকভাবে ‘ফশান’ নগরীর পশুপাখির বাজারটি দ্রুত বন্ধ করে দেয় এবং সিভেট ক্যাটের বিক্রি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু মাসখানেক পরেই সার্সের প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে সেই বাজার আবার চালু হয়ে যায়, চীনের সরকার সিভেট ক্যাটের লালন পালন এবং বিক্রির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
বিশ্বব্যাপী সার্স ছড়িয়ে যাবার পরে অনেক মহল থেকেই দাবী উঠেছিলো পশুপাখি বিশেষ করে অপ্রচলিত পশুপাখিদের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। চীন সরকার বেশ কয়েকবার তাদের আইনে বেশকিছু সংশোধন আনলেও একদম বন্ধ করে দেয়নি এই ব্যবসা।
চীনের এই খাত কত বড়?
চাইনিজ একাডেমি অভ ইঞ্জিনিয়ারিং এর হিসাব অনুসারে, চীনের পশুপাখি পালন এবং বিপণনের বাজার ব্যবস্থা দিনকে দিন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের দেওয়া হিসেব অনুসারে, এই খাতের আর্থিক মূল্যমান প্রায় ৫২০ বিলিয়ন ইউয়ান যা ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য। এইখাতে শুধু যে প্রাণীজ মাংসের চাহিদাই প্রধান এমনটি নয়, চীনের একাডেমি অভ ইঞ্জিনিয়ারিং বলছে বিশ্বজুড়ে প্রাণীর চামড়ার বড় চাহিদা মিটিয়ে থাকে এই খাত। বৈধ, অবৈধ, সংরক্ষিত, দুষ্প্রাপ্য কিংবা বিলুপ্তপ্রায় যেকোনো প্রাণীর চামড়ার অন্যতম বড় সরবরাহক এই বাজারগুলো। তবে শুধু কি খাদ্য আর চামড়া?
সরকারি আর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবছর দরকার শত সহস্র প্রাণীর। বিভিন্ন ওষুধ, প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আর জীববিজ্ঞানের গবেষণা, এছাড়াও পোষা প্রাণীরও চাহিদা সরবরাহ হয় এই খাত থেকে।
বিশাল আকারের এই শক্তিশালীর খাতের রয়েছে বহুমুখী কর্মসংস্থানের দিক। পশুপালন থেকে শুরু করে শিকার, পরিবহন, বিপণন, ব্যবস্থাপনা আর সরবরাহ ব্যবস্থায় জড়িত প্রায় ১৪ মিলিয়ন মানুষ। এছাড়া শত-সহস্র মানুষ প্রান্তিকভাবে দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতেও কাজ করে থাকেন। তাই এই শিল্প চীনের জিডিপি বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান উৎস হওয়ার পাশাপাশি চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রাণীর ব্যবহার প্রচুর। ঐতিহ্যবাহী এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় বরাবরই ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাণীর হাড়, নখ, চামড়া। বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে চীনের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অনেকেই এই চিকিৎসা ব্যবস্থার ভোক্তা হওয়ায় বলে একে নিয়ন্ত্রণে আনতে বরাবরই হিমশিম খেতে হয় চীনের প্রশাসনকে।
করোনা ভাইরাস, চীনের উহানের প্যাঙ্গোলিন
চীনের উহানের বাজার থেকে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস, কিন্তু কে প্রথম বাহক? সার্সের ক্ষেত্রে যেমন ‘সিভেট ক্যাট’কে দায়ী করা হয়েছিল। কারণ সিভেট ক্যাট থেকে প্রাপ্ত ভাইরাস এবং মানুষকে আক্রান্ত করা ভাইরাসের মাঝে নব্বই শতাংশের বেশি মিল পাওয়া গিয়েছিল। তাই বিজ্ঞানীরা প্রথমেই বেছে নিয়েছিলেন বাদুড়, সাপ, বানর, প্যাঙ্গোলিন এবং আরো বেশ কয়েকটি প্রাণীকে। প্যাঙ্গোলিন থেকে পাওয়া করোনাভাইরাসের সাথে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের আছে ৯৯ শতাংশ মিল। সাউথ চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সেন ইয়োনগি প্যাঙ্গোলিনের প্রায় ১০০০ নমুনা পরীক্ষা করেছেন যার ৭০ শতাংশে ভাইরাসের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বাদুড়কেও শুরুতে দায়ী করা হয়েছিল, কারণ করোভাইরাসের বেশ কয়েকটি প্রকরণ বাদুড়ও বহন করে। তবে এক্ষেত্রে বাদুড়ের কাছ থেকে পাওয়া করোনাভাইরাসের চেয়েও প্যাঙ্গোলিনের কাছ থেকে পাওয়া করোনাভাইরাসকে নিকটতর প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বজুড়ে পাচার হওয়া যদি কোনো প্রাণী থাকে তার তালিকায় এক নাম্বারে স্থান করে নেবে এই প্যাঙ্গোলিন। সাধারণ মানুষ হয়তো এই প্রাণীর নাম তার জীবদ্দশায় না শুনেই থাকতে পারেন। দেখতে অনেকটা ডাইনোসরের মতোই, তবে আকার-আকৃতিতে এরা ৩০ সেন্টিমিটার থেকে সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সারা দেহ কেরাটিন নির্মিত আঁশে ঢাকা থাকে, মাছের আঁশের তুলনায় এই আঁশ বেশ পুরু আর শক্ত। এই শক্ত আঁশ দিয়ে প্যাঙ্গোলিন প্রতিরক্ষা করে থাকে। তবে এই প্রতিরক্ষা বর্মই কাল হয়েছে এর জন্য।
কারণ চীনের প্রাচীন ওষুধে (Traditional Chinese medicine/TCM ) প্যাঙ্গোলিনের দেহের বিভিন্ন অংশ বিশেষ করে আঁশের চাহিদা প্রচুর। প্যাঙ্গোলিন থেকে সংগৃহীত আঁশ শুকিয়ে, গুড়া করে নানা কাজে লাগানো হয়।
চীনের ট্রেডিশনাল মেডিসিনে এই আঁশ থেকে তৈরি দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয় খিঁচুনি, ম্যালেরিয়া, হিস্টেরিয়া, বোবা এবং নানা অদ্ভুত রোগের চিকিৎসায়।
চীনের দক্ষিণাংশে বিশেষ করে ধনিকশ্রেণীর মাঝে দুর্লভ প্রাণীজ দ্রব্য ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। অনেকেই ভেবে থাকতে পারেন, শুধুই ওষুধ কিংবা খাদ্যের জন্যই এই প্রাণীর চাষাবাদ আর শিকার করা হয়। তবে ব্যপারটি আরেকটু বিস্তৃত, এই অর্থনৈতিক বলয়ে প্রচুর শৌখিন এবং ক্ষমতাবান লোকের আধিপত্য বেশি, যারা সামাজিক মর্যাদার জন্য দুর্লভ প্রাণীর হাড়, চামড়া, নখ সংরক্ষণ করেন। কেউ দুর্লভ প্রাণীর চামড়ায় নির্মিত পোশাক ব্যবহার করেন, কেউ তৃপ্তি পান মাংস খেয়ে আর কেউ কেউ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করেন। পাশাপাশি এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা তাদের বলয়ের বাইরের মানুষকে বরাবরই উৎসাহিত করে দুর্লভ প্রাণীজ দ্রব্য ব্যবহারের জন্য। চীন সরকারও এই খাতকে নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে এসেছে বরাবরই। ২০১৮ সালের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, স্টেট কাউন্সিলের প্রকাশিত ঘোষণায় চীনের এই ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মিং’ বা ‘বন্য পশু চাষ’কে উৎসাহিত এবং ত্বরান্বিত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা আছে।
চীনের বন্যপশু চাষের ইতিহাস, ঝুঁকি এবং ভবিষ্যৎ
চীনের এই পশুপালনের ইতিহাসের দিকে চোখ বুলালে ফিরে যেতে হবে সত্তরের দশকে, চীনে তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। চীনের কমিউনিস্ট প্রশাসন যাদের হাতে খাদ্য উৎপাদন আর বিতরণের সকল ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত তারা চিন্তা করলেন একে ব্যক্তিখাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়। ১৯৭৮ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পশু ফার্মকে সরকার উৎসাহিত করতে শুরু করে। বড় কোম্পানিগুলো গরু, মুরগী এবং শুকরের মতো সাধারণ পশু পালনের দিকেই মনোযোগ দেয়। তবে ছোট ছোট ফার্ম গড়ে উঠে যারা সাপ, বাদুড়, কচ্ছপ, ব্যাঙ, হরিণ, শেয়ালের মতো অপ্রচলিত প্রাণী পালন শুরু করে। বাজারে চাহিদা থাকায় এসব ছোটখাট ফার্ম দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ওষুধ হিসেবে ব্যবহার আর অভিজাতদের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এই ফার্মের সংখ্যা আর বাজারও বেড়েছে বহুগুণে।
১৯৮৮ সালে চীন ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ পাস করে, যাতে বন্যপ্রাণীকে উল্লেখ করা হয় রাষ্ট্রের সম্পত্তি (Resources owned by the state) এবং সেই আইনে বন্যপ্রাণীকে পোষ মানানো এবং তাদের লালন পালন করার অনুমতি দেওয়া হয়। স্টেট কাউন্সিলের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে যে কেউ বন্যপ্রাণী লালন পালন এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে পারবে এমন ধারা সৃষ্টি করা হয়।
তাই চীনের পশুপাখির মার্কেটে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর বাজার বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা প্রাণীরাও বিক্রি হতে থাকে একই বাজারে। একই বাজারে জীবিত পশু, তার মাংস, হাড়, নখ বিক্রি শুরু হওয়ার সাথে সাথে রোগ জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে।
ফলাফল হিসেবে ২০০৩-০৪ সালে চীনের পশুপাখির বাজার থেকে সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এবং এর জন্য চীনের বাজারগুলোতে বিক্রি হওয়া সিভিট ক্যাটকেই দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা। এই ঘটনার পরে দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এসব বাজার, কিন্তু তা সার্সের প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে আবারও বহাল তবিয়তে ফিরে আসে এসব বাজার। বরং সময়ের সাথে এসব বাজারে নতুন নতুন প্রাণীর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে, বাজার বহুমুখী হয়েছে।
২০১৯ সালে আবারো এমনই একটি বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। এই লেখাটি লেখার সময়েও হয়তো বিশ্বে কোথাও ঘরে বন্দী হয়ে আছেন মানুষেরা, ধসে পড়ছে অর্থনীতি, কেউ শুয়ে আছেন বিছানায় রোগে কাতর হয়ে আর কেউবা ব্যস্ত প্রতিষেধক আবিষ্কারে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বারবার চীনকে অনুরোধ করেছেন ঝুঁকিপূর্ণ বন্যপ্রাণীর বাজার এবং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে।
এই মহামারী শুরু হওয়ার সাথে সাথে উহানের পশুপাখির বাজারটি বন্ধ আছে। ঝুঁকিপূর্ণ বন্যপ্রাণীর ব্যবসা বন্ধ করতে না পারলে এমন মহামারী হয়তো হানা দিবে বারবার।