“আমি মি. এক্স, সজ্ঞানে নিজ দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বাংলাদেশে যদি কোথাও করোনা ভাইরাসের কারণে বিশেষ (মহামারী) পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবকের দরকার হয় – দেশ, জাতি, জনগণ তথা সমগ্র বিশ্বের স্বার্থে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেবা দিতে এবং জরুরি প্রয়োজনে ট্রেনিং নিতে ইচ্ছুক।”
“Let me know if any kinds of training are provided to serve Coruna covid-19 virus affected patients. I am willing to join. It’s my request to everyone or government that please allow me to sacrifice myself in this severe mission as a patriot.”
এরকম বেশ কিছু স্ট্যাটাস দেখা যাচ্ছে আজকাল ফেসবুকে। নিজের নামের নিচে ফোন নাম্বার ও ঠিকানা দিয়ে প্রচার করছে অনেকে। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে অনেক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করতে চাইছেন, সেবা করতে আগ্রহী হচ্ছেন। এটি একদিকে যেমন ভালো লাগার ব্যাপার, অন্যদিকেও আশঙ্কারও।
ভালো লাগার ব্যাপার এজন্য যে, স্বেচ্ছাসেবীরা দেশের বিপদে বরাবরের মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছেন, কাজ করতে চাইছেন। দেশের প্রতিটি দুর্যোগেই আমরা দেখি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্যোগী হয়ে মানুষকে সেবা দেয়।
উদ্দেশ্য খুবই সৎ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার হলো, যারা কাজ করতে চাইছেন, তারা কি সকলেই পরিপূর্ণভাবে ভাইরাসটি এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল?
সমস্যাটি ঠিক এখানেই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তরা সাধারণ কোনো রোগী নয়। ক্ষেত্রবিশেষে ক্যান্সারের রোগীদের চেয়েও তাদের রোগ ভয়াবহ। ক্যান্সারও মানুষকে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল করতে পারে না, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে না, যেভাবে করোনা দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, ক্যান্সার মোটেই সংক্রামক নয়!
প্রচণ্ড সংক্রামক বিধায় উপযুক্ত মেডিকেল সরঞ্জাম ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছাড়া চিকিৎসক বা নার্সরাও করোনা রোগীদের সেবা দিতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের পর্যন্ত ছোঁয়া যাচ্ছে না। নানা কায়দা-কসরত করে তাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হচ্ছে।
আমাদের দেশে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছেন, সেখানে কাজ করেন লক্ষ লক্ষ স্বেছাসেবী। তাদের বেশিরভাগেরই উদ্দেশ্য মহৎ। তারা মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোবাসেন। রক্তদান থেকে শুরু করে মেডিকেল ক্যাম্পেইনে ফ্রি চিকিৎসা, শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, গরিব-অসহায়দের স্বাবলম্বী করাসহ নানা ধরনের কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবীগণ। তাদের এসব কাজ প্রশংসনীয়। আজ দেশের এই মহাবিপদে কিংবা ক্রান্তিলগ্নে স্বেচ্ছাসেবীরা কি তবে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?
মোটেই না। তারা নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সরাসরি সেবা না দিতে পারলেও এই আতঙ্ককজনক পরিস্থিতিতেও বেশ কিছু কাজ করতে পারেন, যা মানুষের জন্য বেশ উপকারী হবে।
এক. করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সাধারণ মানুষের অনেকেরই তাতে নাভিশ্বাস উঠছে। স্বেচ্ছাসেবীরা চাইলে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিজেরা তৈরি করে অথবা ন্যায্যমূল্যে সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন। তবে অবশ্যই বিতরণ করার ক্ষেত্রে সচেতনতা কাম্য। স্বেচ্ছাসেবীরা দলবদ্ধ হয়ে জটলা না করে দল-উপদলে ভাগ হয়ে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই কাজ করা উচিত।
দুই. যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না অথবা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো অনুসরণ করেন না, তাদের অনেকেই এখনও সচেতন নন। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। “কিছুই হবে না” কিংবা “কিছুই হচ্ছে না” ভাব আছে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে।
দেশ লকডাউন হওয়ার আগপর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবীরা তাদেরকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যাতে সবাই ঘরে থাকেন এবং একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হন- এটি বোঝানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তা বজায় রেখে ঘরে ঘরে, হাট-বাজারে লিফলেট, মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাড়ার সবার নাম্বার সংগ্রহ করে মোবাইল ফোনেও দেওয়া যেতে পারে দিক-নির্দেশনা।
তিন. অনেকে বিদেশ থেকে এলেও মানছেন না হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম। ঘরে না থেকে বাইরে বের হচ্ছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছেন, উপস্থিত হচ্ছেন অনেক সামাজিক ও ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে বোঝাতে গেলে তৈরি হচ্ছে বাগ্বিতণ্ডা।
স্বেচ্ছাসেবীরা চাইলে সাংগঠনিকভাবে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য বোঝাতে পারেন, চাইলে প্রশাসনের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে। বিদেশ-ফেরতদের এটা বিশ্বাস করাতে হবে যে, কোয়ারেন্টিন শুধু নিজে বাঁচার জন্য নয়, নিজের পরিবার ও দেশকে বাঁচানোর জন্যও প্রয়োজন।
চার. ধর্মভিত্তিক অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে দেশে। তারাও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। দুর্যোগের সময় ঘরে নামাজ পড়লে যে কোনো ক্ষতি নেই- এটি সরলমনা, ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের বোঝানো যেতে পারে। প্রয়োজনে মসজিদ কমিটি, ইমাম সাহেব, মোয়াজ্জিন সাহেবদের সাথে আলোচনা করে মসজিদের মাইকে অসুস্থ ও বিদেশফেরতরা যাতে আপাতত মসজিদে না গিয়ে ঘরেই নামাজ আদায় করে নেন, সেজন্য প্রচারণা চালানো যেতে পারে। মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধের বিষয়ে সরকারি নির্দেশ আসার আগপর্যন্ত এরকম প্রচারণা কাজে দেবে অনেক।
পাঁচ. পরিস্থিতি আরেকটু খারাপ হলে দেশ আজ অথবা কাল, লকডাউন, কারফিউ কিংবা জরুরি অবস্থায় যাবে। তখন স্বেচ্ছাসেবীরা পালন করতে পারেন যুগান্তকারী ভূমিকা। দিনমজুর, হতদরিদ্র মানুষেরা দুদিন ঘরে বসে থাকলেই খাদ্যসঙ্কটে পড়বে নিশ্চিত। তাদেরকে সাধ্যমতো খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের দেশটা মধ্যম আয়ের হলেও এখনও প্রচুর মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে আছেন। শহরে বস্তিবাসী ও গ্রামের গৃহহীন ক্ষেতমজুর, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষরা আক্ষরিক অর্থেই বিপদে থাকবেন। তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে সবাই মিলে।
ছয়. এমনও দেখা যাবে যে, একটা পরিবারের সবাইকেই সঙ্গত কারণে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে। কোনোক্রমেই যাতে কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের বাইরে বের হতে না হয়, সেজন্য তাদেরকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে।
সাত. দেশ সম্পূর্ণ লকডাউন হওয়ার আগপর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারসহ গণজমায়েতের সকল স্থানে স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মানুষ যাতে গণপরিবহনে ওঠার আগে-পরে, বাজারে ঢোকার ও বের হওয়ার সময় হাত পরিষ্কার করে নেয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
মূলত এসব কর্মকাণ্ড ছাড়া করোনাভাইরাস ইস্যুতে স্বেচ্ছাসেবীদের আর তেমন কোনো কাজ নেই। কারণ এটি মোকাবেলার মূল কাজ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল কর্মীদেরই করতে হবে, বাকিদের কাজ শুধুই সচেতনতামূলক। অবশ্য এসব কাজ করতে হলেও নিজেদের যতটা সম্ভব বিচ্ছিন্ন রেখে করতে হবে।
নিজেরা সচেতন ও সুস্থ না থাকলে জনসেবা করাটাও মুশকিল। প্রয়োজনে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। যতটা সম্ভব ঘরে থাকতে হবে। নিজেদের নিরাপদ রেখেই সব করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করা অবশ্যই ভালো, কিন্তু নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে নয়।