মা হওয়ার চেয়ে আনন্দদায়ক কোনো কিছু হয়তো নেই একজন নারীর জন্য। একটি শরীরের ভেতর বড় হতে থাকে আরেকটি শরীর, আরেকটি ছোট্ট প্রাণ; এই অনুভূতি নিশ্চয়ই অনন্য! গর্ভাবস্থায় একজন হবু মা তার পেটের সন্তানটির সুস্থতা নিশ্চিত করতে কত কিছু যে করে চলেন, তার ইয়ত্তা নেই। এই সময় গর্ভবতী মা নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অসঙ্গতি বা সমস্যারও মুখোমুখি হন। এর আগে আমরা লিখেছিলাম গর্ভাবস্থায় বমিভাব দূর করার ঘরোয়া সমাধান নিয়ে। আজকের লেখায়ও থাকছে এমন আরও কিছু সমস্যার ঘরোয়া সমাধানের উপায়।
এমন কিছু ভাগ্যবান হবু মায়েরা থাকেন, যারা কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভবতী নারীদের মর্নিং সিকনেস থেকে শুরু করে হাত-পা ফুলে যাওয়া, ঘুম না হওয়া, হাতে-পায়ে অসহনীয় যন্ত্রণা আর কোনো কিছুর খাওয়ার রুচি না থাকা সহ আরও নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে পুরো গর্ভধারণের সময়টা পার করতে হয়। আর এসবের জন্য মূলত গর্ভাবস্থায় হরমোনাল এবং শারীরিক পরিবর্তনগুলো দায়ী।
গর্ভাবস্থায় হবু মায়েরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন সেগুলো খুব মারাত্মক বা বিপদজনক না হলেও, সবার উচিত গর্ভবতী মায়ের এসব সমস্যার দিকে মনযোগী ও যত্নবান হওয়া। সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়তো পারে গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি দিয়ে একটু স্বস্তি দিতে।
বুক জ্বালাপোড়া
গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের তারতম্যের কারণে বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে। সত্যি বলতে গেলে, গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালাপোড়া অন্যতম সাধারণ সমস্যা। প্রেগন্যান্সি হরমোনের কারণে Lower Esophagel Sphincter শিথিল হয়ে যায়, যার ফলে পাকস্থলীর অ্যাসিড গলনালির দিকে বের হয়ে আসে। এছাড়াও জরায়ুর বৃদ্ধির ফলে অনেক সময় পাকস্থলীতে চাপ সৃষ্টি হয়ে পাকস্থলীর অ্যাসিড উপরের দিকে উঠে আসতে পারে, যার ফলে বুক জ্বালাপোড়া করে। চাইলে ওষুধ খেয়ে হয়তো এই বুক জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, তবে এই ওষুধের প্রভাব পড়বে আপনার পেটের সন্তানের উপর।
জার্নাল অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজিতে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হওয়া এক গবেষণায় জানা গেছে, গর্ভাবস্থায় যে মায়েরা নিয়মিত বুক জ্বালাপোড়ার ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন, তাদের জন্ম নেওয়া সন্তানদের হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সমাধান
- দিনে দু’বার পানি ও অ্যাপল সিডার ভিনেগার পান করুন, শুধু এক চা চামচ অপরিশোধিত অ্যাপল সিডার ভিনেগার এবং এক গ্লাস গরম পানি।
- আদা চা-ও ভালো উপকারে আসে।
- চর্বিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার থেকে দূরে থাকুন এবং সিগারেট, কফি ও কোলা পান করবেন না।
- খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে শুয়ে না পড়লেই ভালো।
- তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে, বিশেষত পানি পান করুন বেশি করে।
- রাতে ঘুমানোর সময় বিছানা থেকে মাথা কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি উঁচু রাখা দরকার।
- কোমরের কাছে আঁটসাঁট করে পোশাক না পড়ে ঢিলা করে পরুন।
ক্লান্তি ও অবসাদ
গর্ভধারণের প্রথম ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহ ক্লান্তি আর অবসাদে আপনার শরীর ভেঙে পড়তে চাইবে, আর প্রতিদিনের কাজগুলো যেন আরও বেশি ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে শুরু করে। নিজেকে দোষ দেবেন না বা অপরাধী বোধ করবেন না, কারণ এই সময়টায় আপনার শরীর সবচেয়ে বেশি প্রেশার নেয় বর্তমান শারীরিক অবস্থায় সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে। আবার অনেক গর্ভবতী মা গর্ভাবস্থার শেষ ৪ সপ্তাহে অনেক বেশি ক্লান্তি অনুভব করেন, যার অন্যতম কারণ শরীরের অতিরিক্ত ওজন ও ঘুম না হওয়া। গর্ভাবস্থায় শরীরে ক্রমবর্ধমান প্রজেস্টেরনের মাত্রা এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়াও এই অতিরিক্ত ক্লান্তি ও অবসাদের অন্যতম কারণ।
সমাধান
- দিনে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
- আপনার শরীরের কথা শুনুন। যখনই ক্লান্ত লাগবে যত কাজই থাক, সব বাদ দিয়ে বিশ্রাম নিন।
- সারাদিনে কিছুক্ষণ পরপর পা না ঝুলিয়ে বরং পা উঠিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।
- পর্যাপ্ত ক্যালোরি, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
- দিনের বিভিন্ন সময়ে একটু করে করে সুষম খাদ্য খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
- গর্ভধারণ থেকে শুরু করে পুরো গর্ভকালীন অবস্থাতেই কাজের বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
কোষ্ঠকাঠিন্য
গর্ভধারণকালীন শরীরের ক্রমবর্ধমান প্রজেস্টেরনের মাত্রা বাড়ার ফলে হজম শক্তি হ্রাস পায় এবং ইউটেরাসের বৃদ্ধির ফলে পাচনতন্ত্রের স্থানান্তরণ ঘটে। যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এছাড়া খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, গর্ভকালীন খাদ্য তালিকায় যোগ হওয়া অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম ও আয়রন, মানসিক চাপ, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন এবং প্রয়োজনীয় ফাইবার ও তরল গ্রহণ না করার ফলে হবু মায়েরা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন।
সমাধান
- সারাদিনে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
- ব্যায়াম করুন, কমপক্ষে দিনে ৩০ মিনিট হাঁটা নিশ্চিত করুন।
- খাদ্য তালিকায় উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কাঁচা বা রান্না করা সবজি, ফল, খেজুর, ভাত (কমপক্ষে প্রতিদিন ৩ টেবিল চামচ), মটরশুঁটি এবং হোল গ্রেইন খাদ্য সামগ্রী (বাদাম ও ওটমিল) ইত্যাদি।
- অল্প অল্প করে সারাদিনের বিভিন্ন সময়ে খাবার খেতে হবে এবং ভালোমতো চিবিয়ে খেতে হবে।
- আয়রন সাপ্লিমেন্ট কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ হতে পারে, এক্ষেত্রে আপনার গাইনি চিকিৎসকের সাথে বিস্তারিত কথা বলুন।
- ঘুমুতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান করুন।
পা ও পিঠ ব্যথা
হবু মায়ের পেট ও স্তন স্ফীতি লাভ করায় অতিরিক্ত ওজন এবং গর্ভাবস্থায় শরীরের হরমোন গর্ভবতী মায়ের মেরুদণ্ড অনেকটাই মসৃণ করে ফেলার দরুন পিঠের উপর বেশি চাপ পড়ে। আবার শরীরের এই অতিরিক্ত ওজন আপনার পা বহন করে চলে আর সাথে তো আছেই মানসিক চাপ। এই সবকিছু মিলিয়ে গর্ভাবস্থায় পা ও পিঠে ব্যথা অনুভূত হয়।
সমাধান
- মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন ও হাঁটুন।
- বসার জন্য ভালো সাপোর্ট দেবে এমন চেয়ার বেছে নিন এবং প্রয়োজনে বসার সময় পেছনে বালিশ নিয়ে বসুন।
- অতিরিক্ত উঁচু এবং একদম নিচু জুতা এড়িয়ে চলুন।
- অতিরক্ত ওজন তোলা থেকে বিরত থাকুন। আর যদি একদমই উপায় না থাকে এড়ানোর, সেক্ষেত্রে নিচু না হয়ে বরং হাঁটু মুড়ে মেরুদণ্ড সোজা রেখে ভারী কিছু তুলুন।
- একটানা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না এবং ঘুমানোর সময় পায়ের মাঝে একটা বালিশ রাখুন ভারসাম্য রক্ষার জন্য।
ঘুম না হওয়া
গর্ভাবস্থায় বেশিরভাগ মা-ই ঘুম না হওয়া নইলে ভাঙা ভাঙা ঘুমের শিকার হন। গর্ভধারণের প্রথম দিকে ঘুম হয় না, কারণ আপনার নতুন শারীরিক অবস্থার সাথে আপনার শরীর নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় তখন। আর শেষের দিকে শরীরের অতিরিক্ত ওজনের কারণে ঠিকভাবে শুতে না পারা এবং পেটের ভেতর ছোট্ট সোনামণির অবিরাম নড়াচড়ার কারণে ঘুমুতে পারেন না মায়েরা।
সমাধান
- ঘুমুতে যাওয়ার আগে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন।
- লেবুর রস দিয়ে হালকা গরম পানি অথবা হালকা গরম দুধ পান করুন ঘুমুতে যাওয়ার আগে এবং ঘুমানোর আগে হালকা খাবার খান।
- চেষ্টা করুন প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমুতে যাওয়ার রুটিন করতে।
- ছোটখাটো ব্যায়াম করুন।
- কীভাবে শুয়ে ঘুমালে আরাম পান সেটি খুঁজে বের করুন এবং একাধিক বালিশ ব্যবহার করুন ঘুমাতে। পায়ের মাঝামাঝি বালিশ রাখুন, আরাম পাবেন।
- ঘুমাতে যাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার সেরে ফেলুন।
- ক্যাফেইনযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- হাতে পায়ে মালিশ নিন।
নাক আটকে থাকা
নাক আটকে থাকা গর্ভধারণের সময়ের খুব সাধারণ সমস্যা। আর এই নাক বন্ধ হয়ে থাকা হবু মায়েদের জন্য ঘুম না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
সমাধান
- নাকের উপর গরম পানিয়ে চুবিয়ে একটা কাপড় রাখুন, এতে উপকার পাবেন।
- হারবাল চা পান করুন।
- ঘুমুতে যাওয়ার আগে গরম পানির বাষ্প টানুন নাক দিয়ে।
- মাথা কিছুটা উঁচুতে রেখে ঘুমুতে চেষ্টা করুন।
মাথা ব্যথা
গর্ভাবস্থায় আরও একটি সমস্যা হচ্ছে মাথা ব্যথা হওয়া। হরমোনাল পরিবর্তনের দরুন গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস মূলত এটি হয়ে থাকে। এছাড়াও উদ্বেগ, ক্লান্তি, নাক বন্ধ হয়ে থাকা, চোখ টনটন করা ইত্যাদি কারণগুলোও মাথা ব্যথার জন্য দায়ী।
সমাধান
- একটা ভেজা কাপড় কপালে দিয়ে রাখুন আরাম পাবেন। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে আবার গরম পানিতে চুবানো কাপড় ভালো কাজ করে।
- রাতে চেষ্টা করুন পর্যাপ্ত ঘুমুতে আর দিনে যখনই পারবেন বিশ্রাম নেবেন।
- ২-৩ ঘণ্টা পর পর কিছু না কিছু খান।
- বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- হাঁটতে বের হতে পারেন, তবে অবশ্যই নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে।
গর্ভাবস্থায় হবু মায়েদের শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি নানা ধরনের মানসিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। হুট করে রেগে যাওয়া, অনেক বেশি আবেগগ্রস্থ হয়ে পড়া, কান্নাকাটি করা, মানসিক চাপে থাকা ইত্যাদি ঘটে থাকে এসময়। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের স্বামী এবং পরিবারের সবাইকে অনেক বেশি সহযোগী মনোভাবাপন্ন হতে হবে। একমাত্র পরিবারের সবাই মিলে সঠিক শারীরিক ও মানসিক যত্ন নিয়েই হবু মায়ের জন্য সুস্থ ও সুন্দর গর্ভকালীন পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন।