হ্যাশট্যাগ #NoShaveNovember, #RazorFree, #NoGrooming। নভেম্বর মাসে যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়াতে গেলেই এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ে। অর্থাৎ নভেম্বর মাস আসার মানে হলো ছেলেরা তাদের দাঁড়ি এবং গোঁফ শেভ করা ছেড়ে দিতে হবে এবং সেই সাথে এগুলো সুন্দরমতো গজিয়ে সবাইকে দেখাতে হবে। জিনিসটা বর্তমানে অনেকটা ট্রেন্ডের মতো হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ না জেনে, না বুঝে “নভেম্বর রেইন” নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার মতো মানুষজন “নো শেভ নভেম্বর” নিয়েও পোস্ট করে কেবল ট্রেন্ডের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য।
দুঃখের বিষয় হলো, নো শেভ নভেম্বরের পেছনে যে মহৎ উদ্দেশ্য আছে তা আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না। এই ট্রেন্ড তৈরির পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী সেটি খুব কম লোকই জানার চেষ্টা করে বা করেছেন। তাহলে চলুন আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরা যাক এই নভেম্বরের শীতের মধ্যে কেনো শেভ না করার ট্রেন্ড চালু হয়েছে।
অনেকেই এটা জেনে চমকে যাবেন যে, নো শেভ নভেম্বর পালনের আসল উদ্দেশ্য হলো ক্যানসারের চিকিৎসা এবং গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা! অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সুন্দর করে দাঁড়ি রেখে সবাইকে দেখানোর সাথে ক্যানসার চিকিৎসার কী সম্পর্ক? বলছি সেই কথা। এজন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে শিকাগোল্যান্ডের এক পরিবারের কাছে। ২০০৭ সালে সেই পরিবারের কর্তা ম্যাথিউ হিল কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন এ ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা আর গবেষণার অগ্রগতিও বেশ কম ছিলো। উল্লেখ্য, কোলন ক্যানসার হলো আমাদের খাদ্য পরিপাক যন্ত্রের বৃহদন্ত্রে হওয়া একটি ক্যানসার। সাধারণত পুরুষদেরই এই ক্যানসার বেশি হয়।
ম্যাথিউ মারা যাওয়ার পর ২০০৯ সালে তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ক্যানসারের চিকিৎসা এবং গবেষণা খাতের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজ করবে। ক্যানসারের ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি করবে। এজন্য তারা একটি ট্রেন্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় যা হলো নো শেভ নভেম্বর। কিন্তু কথা হলো, এত এত ট্রেন্ড থাকতে দাঁড়ি না কাটার ট্রেন্ডটাই বাঁছাই করলো কেন? আর দাঁড়ি না কাটার সাথে ক্যানসারের চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহের সম্পর্ক কী?
একটু আগেই বলা হয়েছে, কোলন ক্যানসার সাধারণত পুরুষদের বেশি হয়। আর মুখের দাঁড়ি-গোঁফ হলো পুরুষদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য। তাই তারা এমন একটি ট্রেন্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নিলো যেখানে পুরুষরা তাদের দাঁড়ি-গোঁফ ছাটা একমাসের জন্য বন্ধ করে দিবে এবং সেই একমাসে সেলুনে যাওয়ার পেছনে তাদের যে অর্থ ব্যয় হতো, তা ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যয় করবে। অর্থাৎ, একমাসের সেলুন বিল বাঁচিয়ে তারা সেই অর্থ দান করে দিবে। এটাই হলো নো শেভ নভেম্বরের মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, একে আমরা এমন একটি ট্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছি যার মানে হলো একমাস দাঁড়ি-গোঁফ বানিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বেড়ানো। এমনভাবে দেখিয়ে বেড়ানোর পিছে আসলে কোনো অর্থই নেই। এটা অনেকটা আইস বাকেট চ্যালেঞ্জের মতো। ২০১৪ সালের দিকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া আইস বাকেটে চ্যালেঞ্জের মূল উদ্দেশ্য ছিলো মস্তিষ্কের নিউরনের একটি রোগ ALS (Amyotrophic Lateral Sclerosis) এর চিকিৎসা ও গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, এটি কেবল একটি মজার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ অবশ্য বেশ সাফল্যের মুখ দেখেছে। তা না হলে কি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটসের মতো লোক এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে থাকেন? নো শেভ নভেম্বর চ্যালেঞ্জও অবশ্য অর্থ সংগ্রহের দিক থেকে কম সাফল্য পায়নি।
২০০৯ সালেই ক্যানসারের চিকিৎসায় অর্থ সংগ্রহের জন্য শিকাগোল্যান্ড হিলের পরিবারটি একটি অনলাইনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা তৈরি করে। এর নাম নো শেভ নভেম্বর। অর্থাৎ ট্রেন্ডের নামেই সংস্থাটি গড়ে ওঠে। এখানে চাইলেই আপনি একমাস সেলুনে না গিয়ে যে অর্থ জমিয়েছিলেন তা দান করে দিতে পারেন ক্যানসারের চিকিৎসার স্বার্থে। আপনি চাইলে নিজের নামে সেখানে রেজিস্ট্রেশন করে নিজ এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারেন ক্যানসারের চিকিৎসায় অর্থ সংগ্রহের জন্য। এরপর সেই অর্জিত অর্থ দান করে দেবেন নো শেভ নভেম্বরের একাউন্টে।
তবে আপনি যদি সরাসরি অর্থ দান করতে না চান, তারও ব্যবস্থা আছে। সংস্থাটির ওয়েব সাইটেই বেশ কিছু ভালো ভালো টিশার্ট, মগ, রিস্টব্যান্ড, রিং বিক্রি হয়। এই পণ্যগুলো বিক্রি করে তারা যে অর্থ লাভ করে, তার পুরোটাই চলে যায় ক্যানসার চিকিৎসায়। ২০০৯ সালে এই সংস্থাটি চালু করার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তারা প্রায় ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছে।
এর পাশাপাশি বলে রাখা ভালো, ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়াতে ৩০ সদস্যের একটি গ্রুপ মিলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে এরকমই একটি ট্রেন্ড চালু করে, যার নাম “মোভেম্বর”। “নো শেভ নভেম্বর” ট্রেন্ডে দাঁড়ির ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেও মোভেম্বরে গুরুত্ব দেয়া হয় গোঁফ না কাটার ব্যপারে। গোঁফের ইংরেজি “Moustaches” এর “মো” এবং “November” এর “vember” নিয়েই এই ট্রেন্ডের নামকরণ করা হয়।
এবার আসল কথায় আসা যাক। নো শেভ নভেম্বর ট্রেন্ডে আপনি “আসল” অর্থে যোগ দেবেন কীভাবে? কাজটি খুবই সহজ। এজন্য আপনাকে মাসের শুরুতেই সব দাঁড়ি-গোঁফ ছেটে ফেলতে হবে। একদম ক্লিন শেভ যাকে বলে। এরপর পরবর্তী একমাসের জন্য আপনার রেজর থেকে দূরে থাকতে হবে। ভুলেও সেটায় হাত দেয়া যাবে না। আপনার দাঁড়ি-গোঁফকে মুক্তভাবে একমাস গজাতে দিন। এমনকি কাঁচি দিয়ে কেটে দাঁড়ি ছোট করাও যাবে না। নিজে ট্রেন্ডের অংশ হওয়ার পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবদেরও উৎসাহ দেবেন এই ট্রেন্ডের অংশ হতে। মাস শেষে শেভ করার পেছনে যে অর্থ খরচ হওয়ার কথা ছিলো, তা আপনি দান করে দেবেন ক্যানসারের চিকিৎসায়।
কিন্তু এখানে বেশ কয়েকটি সমস্যা আছে। সবার তো আর একই সময়ে দাঁড়ি গজায় না। আবার অনেক মেয়েও এই ট্রেন্ডের অংশ হতে চায়। কিন্তু দাঁড়ি না থাকায় তারা তো এর নিয়ম মেনে চলতে পারে না। অনেকের আবার চাকরির খাতিরে নিয়মিত শেভ করতে হয়। তাদের জন্য এই ট্রেন্ডের অংশ হওয়া বেশ সমস্যাই বটে। সেক্ষেত্রে তারা শেভ না করে নো শেভ নভেম্বরের ওয়েবসাইট থেকে পণ্য কিনে সাহায্য করতে পারেন। নারীরা চাইলে পেডিকিউর এবং মেনিকিউরের পিছনে একমাসে বিউটি পার্লারে গিয়ে যে অর্থ খরচ করতেন, তা ক্যানসারের চিকিৎসায় দান করে দিতে পারেন।
লেখার মাঝামাঝি বলেছি যে, এই “নো শেভ নভেম্বর” ট্রেন্ডটিকে বর্তমানে একপ্রকার ফ্যাশন ট্রেন্ড বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি এই ট্রেন্ডের কোনো প্রকার উদ্দেশ্য ছিলো না। তাই আপনি এবং আমি যেহেতু এখন এই ট্রেন্ডের প্রকৃত অর্থ জানি, আমাদের করণীয় হবে যারা না বুঝেই এই ট্রেন্ড পালন করছে তাদের সচেতন করা এবং সেই সাথে ক্যানসারের চিকিৎসা ও গবেষণায় অর্থ দানে জনমত সৃষ্টি করা।