সম্ভাব্যতা: সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য, টস ও কুফার ব্যবচ্ছেদ

কেউ কেউ মাঝে মাঝে বলে থাকে ‘সবকিছুই কোনো না কোনো কারণবশত ঘটে’। একদিক থেকে এই কথাটি সঠিক। সবকিছু আসলেই কোনো না কোনো কারণে ঘটে। এই কথাটিকে অন্যভাবে বললে দাঁড়ায়- কোনো ঘটনা ঘটার জন্য কারণ থাকতে হয়। কারণ সবসময়ই ঘটনা ঘটার আগে সংঘটিত হতে হয়। সুনামির সৃষ্টি হয় সমুদ্রের তলদেশের ভূমিকম্পের কারণে। তলদেশে ভূমিকম্প ঘটে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চরণের ফলে। টেকটোনিক সঞ্চরণ ঘটে গলিত ম্যান্টলের পরিচলন প্রবাহের কারণে। পরিচলন সম্পন্ন হয় কেন্দ্র থেকে তাপমাত্রার প্রবাহের কারণে। তাপমাত্রার প্রবাহ ঘটে পদার্থবিজ্ঞানের আরো কিছু নিয়মের ফলে। অর্থাৎ কোনোকিছু ঘটার পেছনে আগের কোনো কারণ থাকে। কিন্তু মানুষ এই ‘কারণ’কে একটু ভিন্ন চোখে দেখে। তারা মনে করে কোনো ঘটনা কোনো না কোনো ‘উদ্দেশ্যে’ ঘটে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বলে-

এই বিধ্বংসী ভূমিকম্প ছিল আমাদের পাপের ফল।’

কিংবা

‘নাচ-গান, ডিস্কো ক্লাব, মদ-জুয়া ইত্যাদি পাপের আড্ডাখানা ভেঙে ধ্বংস করে দেবার জন্যই সুনামি এসেছিল জার্মানিতে।’

‘মেয়েরা বাটিক লুঙ্গি পরে হাঁটে বলে নেপাল-বাংলাদেশ-ভারতে ভূমিকম্প হয়েছিল।

প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রকৃত কারণ জানা সত্ত্বেও তারা কীভাবে এ ধরনের অর্থহীন ধ্যানধারণার আশ্রয় নেয় তা আসলেই অবাক করার মতো। কেউ কেউ আছে সচেতন ও শিক্ষিত, কিন্তু শিক্ষিত হবার পরেও বই পুস্তকে বৈজ্ঞানিক কারণ সম্বন্ধে জানার পরেও এসব ধ্যান-ধারণা দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাখ্যা দেয়।

সম্ভবত এটা ছোটবেলার যুক্তিহীন কল্পনার প্রভাব। শিশুকালের চিন্তা-ভাবনার ধরণ এখনো রয়ে গেছে মনে। শিশু-মনোবিজ্ঞানীরা একবার জরিপ করে দেখেছিলেন, শিশুরা কোনো কিছুর কারণ হিসেবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করে যায়। আপাত দৃষ্টিতে মজার ও হাস্যকর কারণকেই তারা সঠিক বলে বিবেচনা করে। অনেকগুলো শিশুকে বলা হয়েছিল, কিছু কিছু পাথর কেন চোখা হয়। সেখানে উত্তর হিসেবে আসল কারণ দেয়া ছিল। কিন্তু দেখা যায় তারা এই কারণটিকে সঠিক বলে ধরে নিচ্ছে না। যে ব্যাখ্যায় বলা আছে পাথর সরু বা চোখা থাকার কারণ হচ্ছে পশুদের চুলকানি ধরলে এর মাধ্যমে তারা চুলকিয়ে নিতে পারে, সেই ব্যাখ্যাটিকেই শিশুরা সঠিক বলে ধরে নিচ্ছে।

শিশুদের ধারণা কিছু কিছু পাথর চোখা থাকে কারণ, চুলকানি ধরলে পশুরা তাতে চুলকিয়ে নিতে পারে। ছবি: ইশা ফাউন্ডেশন

ছোটদের বেলায় এটা মেনে নেয়া যায়। তাদের মন মানসিকতাই এরকম। সবকিছুকে উপযুক্ত কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য তাদের মন-মানসিকতা প্রস্তুত নয়। কিন্তু যখন দেখা যায় সুস্থ-সবল-বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ কোনোকিছুকে ব্যাখ্যা করার জন্য উদ্ভট আর অতি-কাল্পনিক জিনিসকে নিয়ে আসছে, তখন তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। ভূমিকম্পের ব্যাখ্যা দেবার জন্য তারা শিশুদের মতোই উদ্ভট গল্পের আশ্রয় নেয়। অমুক দুর্ভাগ্যের কারণে ঐ লোকটি সুনামিতে মারা গেছে কিংবা অমুক সৌভাগ্যের কারণে ঐ লোকটি সুনামির আক্রমণ থেকে সুস্থ সবলভাবে ফিরে আসতে পেরেছে। বোধশক্তি সম্পন্ন মানুষের কাছে এ ধরনের ব্যাখ্যা ও বিশ্বাস আসলেই আশা করা যায় না।

দুর্ভাগ্য বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে? কিংবা সৌভাগ্য বলতেও কি কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে? কোনো কোনো মানুষ কি অন্য মানুষ থেকে বেশি ভাগ্যবান? কারো কারো জীবনে কি দুর্ভাগ্য সবসময় লেগেই থাকে? লোকজন মাঝে মাঝে বলে থাকে, গত কিছুদিনে আমার অনেকগুলো দুর্ভাগ্যের ঘটনা ঘটেছে। তাই সামনে কিছু হলে সৌভাগ্যকর কিছু হওয়া উচিৎ। নইলে সাম্য থাকে না! আবারো যদি আমার দুর্ভাগ্য দেখা দেয়, তাহলে এটা আমার উপর খুবই অবিচার হবে।

কেউ কেউ বলে থাকে, আমার এবার কদিন ধরে একদমই ফাটা কপাল। একের পর এক সৌভাগ্যই পেয়ে যাচ্ছি কয়েক দিন ধরে। এখন যদি কিছু করতে যাই, তাহলে অবশ্যই খারাপ কিছু ঘটতে পারে। কারণ টানা এতবার যেহেতু সৌভাগ্য পেয়েছি, তাই এবার দুর্ভাগ্য আসার সম্ভাবনাই বেশি। লোকজন এমনটা ভাবে গড়ের নিয়মের কারণে। গড় বা এভারেজ অনুসারে ভালো ও মন্দের সম্ভাবনা প্রায় সমান সমান থাকবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাদের গড়ের ধারণায় ত্রুটি আছে। ভালো ও মন্দের সম্ভাবনা সমান সমান, তবে এটি এরকম নয়, একটু ভিন্ন রকম।

কদিন ধরে খুব সৌভাগ্য যাচ্ছে তাই আপাতত সাবধানে থাকতে হবে, খারাপ কিছু আসতে পারে। ছবি: পিক পাল্প

ক্রিকেট খেলার উদাহরণে চলে যাই। কে আগে ব্যাটিং করবে বা কে আগে ফিল্ডিং করবে তা বাছাই করার জন্য টস দেয়া হয়। টসে দুই দলের দুই অধিনায়ক অংশগ্রহণ করে। গ্যালারিতে বসে প্রত্যেক সমর্থকই আশা করে তার দলটি টসে জিতবে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার একটি একটি ম্যাচের আগে ইয়াহুর প্রশ্নোত্তর ওয়েবসাইটে একজন লোক প্রশ্ন করেছিল

ভারতের অধিনায়ক ধোনি কি আবারো টসে জেতার সৌভাগ্য অর্জন করবে?

এই প্রশ্নটির উত্তর বেশ কয়েকজন দিয়েছিল। এদের মাঝে যে উত্তরটিকে সেরা উত্তর হিসেবে বাছাই করা হয়েছে সেটি ছিল এমন-

আমি দৃঢ়ভাবে সাম্যতার নীতিতে বিশ্বাস করি। তাই আমার ধারণা টসে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারাই জিতবে।

ইয়াহু প্রশ্নোত্তরের স্ক্রিনশট

এখানে কত সাবলীলভাবেই একজন লোক ননসেন্সের মতো কথা বলে ফেললো। আবার এই উত্তরটি সেরা উত্তর হিসেবেও নির্বাচিত হয়ে গেল। কেন এই লোকটি এমন বলেছিল? কারণ হচ্ছে এই ম্যাচের আগের ম্যাচগুলোতে ধোনি টানা কয়েকবার টসে জিতেছিল। উনার মতানুসারে, যেহেতু ধোনি টানা কয়েকবার টসে জিতেছে, তাই এখন তার হেরে যাবার সম্ভাবনা বেশি।

এবার হেরে গেলে হার-জিতের একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রকৃতি ভারসাম্য পছন্দ করে, প্রকৃতি ভারসাম্যে থাকতে চায়। এটাকেই অন্যভাবে বলা যায়, সাঙ্গাকারা বেশ কয়েকবার টসে হেরেছে। টানা কয়েকবার জিততে পারেনি, তাই এবার তার জিতে যাবার সম্ভাবনা বেশি।

কিন্তু সত্যিকার বাস্তবতা হচ্ছে ধোনি এর আগে কতবার টসে জিতেছে তার সাথে এই টসের কোনো সম্পর্ক নেই। ধোনি যখনই কোনো টস করবে, তখন তার জিতে যাবার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। টস দেবার আগে টসে অবশ্যই সাম্যতা বা ভারসাম্যের নীতি বজায় থাকে। জেতার সম্ভাবনা যেমন আছে, ঠিক সমান পরিমাণ হারার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু যখনই কোনো টস সংঘটিত হয়ে যায়, তখনই সেটি সম্ভাব্যতা আর অনিশ্চয়তার নিয়মের বাইরে চলে যায়। হয়ে যাওয়া কোনো টসের সাথে সামনে হবে এমন ধরনের টসের কোনো সম্পর্ক নেই। এর আগে ধোনি যতবারই টসে জিতুক না কেন, এই টসেও তার জেতার (বা হারার) সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। এক্ষেত্রে সাম্যতা বা ভারসাম্যের নীতি প্রযোজ্য নয়।

আগে যতবারই টসে জিতুক না কেন, প্রত্যেকটা নতুন টসে হার জিতের সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। ছবি: জিমবায়ো

এটা ঠিক যে, কেউ যদি কোনো একটি পয়সাকে ১ হাজার বার টস করে তাহলে হেড ওঠার সম্ভাবনা ৫০০ বার এবং টেল ওঠার সম্ভাবনা ৫০০ বার। কিন্তু ধরা যাক কেউ একজন এই পরীক্ষাটি সত্যি সত্যিই করলো। ৯৯৯ বার টস করে দেখে ৯৯৯ বারই তার হেড উঠেছে। বাকি টসটিতে তাহলে কী উঠবে? এখানে কিন্তু টেল উঠার সম্ভাবনা ছিল ৫০০ বার। কিন্তু একবারও টেল উঠেনি। তাহলে শেষের বেলায় টেল ওঠার সম্ভাবনা প্রচণ্ড রকম বেড়ে যায় না? আসলে না। সম্ভাবনা বাড়ে না। শেষ বেলাতেও টেল ওঠার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি থেকে যাবে।

আগের ৯৯৯টি টস যখন দেয়া হয়নি, তখন সবগুলো মিলে একটা সম্ভাব্যতা ছিল ৫০০ বার উঠবে হেড আর ৫০০ বার উঠবে টেল। কিন্তু যখনই টসগুলো হয়ে গেল, তখন সেগুলো সম্ভাব্যতার হিসেবের বাইরে চলে গেল। যখন ৫০০টি টস বাকি, তখন টেল ওঠার সম্ভাবনা ছিল ২৫০ বার। কিন্তু কোনো কারণে এটি হয়নি। কিন্তু না হলেও সেগুলো পরবর্তী টসে প্রভাব রাখতে পারবে না। কোনো টেল না উঠে যখন দুটি মাত্র টস বাকি, তখনও টেল ওঠার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। অর্থাৎ দুটির মাঝে মাত্র একটি টসে টেল ওঠার সম্ভাবনা আছে।

কোনো টস একবার সম্পন্ন হয়ে গেলে সেটি আর পরবর্তী টসে প্রভাব রাখবে না। ছবি: ক্রিক ফ্রগ

আমাকে যদি বলা হতো বাজি ধরবো কিনা, তাহলে আমি হেড উঠবে বলেই বাজি ধরতাম। কারণ এতবার একটানা হেড উঠলে বুঝতে হবে কয়েনের মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে, নাহলে যে টস করছে সে কোনো কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এমন করছে।

ব্যাট আগে করবে নাকি পরে করবে এই সিদ্ধান্তের উপর খেলার অনেক কিছু নির্ভর করে। কোনো খেলোয়াড় যদি সত্যিকার অর্থেই টসে জেতার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়, তাহলে তার ভাগ্যের জন্য তাকে দলের অধিনায়ক করে রেখে দিতো। সত্যিকার প্রতিভার মূল্য তখন কমে যেতো। কিন্তু ভাগ্যবশত এরকম অসামঞ্জস্যতা পৃথিবীতে নেই। কেউ অধিনায়ক হলে তার যোগ্যতা দিয়েই হয়। টসে জেতার ভাগ্য দিয়ে নয়। আমরা বড়োজোর বলতে পারি সে ভালো খেলোয়াড়, আজও সে ভালো খেলবে। কিন্তু এমন করে বলতে পারি না যে, সে টসে যেতে প্রায়ই, তাই আজকেও জিতবে বা আজকে হারবে। দুটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যৌক্তিকভাবে কুফা বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। ছবি: প্রথম আলোর ওয়েবসাইট থেকে স্ক্রিনশট

একই কারণে খেলায় ‘কুফা’ বা ‘সুফা’ বলতেও কিছু নেই। আমি অমুক টি-শার্ট পরে খেলা দেখলে আমার টিম জেতে- এরকম বাক্য একদমই অর্থহীন। বিশেষ টি-শার্ট পরলে কিংবা গালে নিজের দেশের পতাকা আঁকলে তা দলের হারা জেতায় কোনো প্রভাব রাখে না। যদি সকলে মিলে এটা করে এবং এটা খেলোয়াড়ের চোখে পড়ে, তাহলে খেলোয়াড় তা দেখে মানসিকভাবে ভরসা পায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এর ফলে খেলোয়াড় খেলায় ভালো করতেও পারে। তখন তা খেলার হারা-জেতায় প্রভাব রাখে। তবে তা সম্পূর্ণই মানসিক ব্যাপার। এর মধ্যে ভাগ্য বা সম্ভাব্যতা বলতে কিছু নেই। কেউ চায়ের স্টলে কিংবা ঘরে টিভির সামনে বসে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী, সুফা-কুফা নিয়ে কর্মকাণ্ড করলে তা কোনোভাবেই খেলার হার-জিতে প্রভাব রাখে না।

ফিচার ছবি: Schlesinger Pain Center

Related Articles

Exit mobile version