চাকরি হচ্ছে না? আজই ব্যবহার করুন ‘এফ এন্ড এফ সাদা ক্রিম’, চাকরি সুনিশ্চিত!
আপনার সোনামণি কি পরীক্ষায় লিখে শেষ করতে পারছে না? আজই তাকে খেতে দিন ‘হারকিউলিস ড্রিঙ্কস’ আর তাকে করে তুলুন এক্সাম রেডি!
আধুনিক জীবন এরকমই নানা বিজ্ঞাপনের বিস্তৃত জালের মাঝে আটকে শুধু হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি চলেছে প্রতিটি মুহূর্ত। বিজ্ঞাপন তো নয়, যেন অনুভূতি নিয়ে খেলা! টেলিভিশন চালু করলে বিজ্ঞাপন, রেডিও চালু করলে বিজ্ঞাপন, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে পাশের দেয়ালে বিজ্ঞাপন, একটু উপরে তাকালে হাজারো বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন, ল্যাম্পপোস্টের গায়ে বিজ্ঞাপন- এমনই নানা বিজ্ঞাপনের চাপে পিষ্ট সকলে। আজকাল তো টেলিভিশনে নাটক বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান দেখতে বসে ভুলেই যেতে হয় অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপন নাকি বিজ্ঞাপনের মাঝে অনুষ্ঠান! সর্বদাই চলছে এই বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা। সাধারণ মানুষজন তা বুঝেও যেন না বোঝার ভান করে চলেছি। এটি আপনার দোষ নয়, দোষ নয় বিজ্ঞাপনদাতাদেরও। এটি আমাদের উপর এমনভাবেই প্রভাব ফেলে যে আমরা একটি সময় গিয়ে সাড়া দিয়ে ফেলবো। কিন্তু কীভাবে এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রভাবিত করছে আমাদের?
বিজ্ঞাপনের মাধ্যম
এই যে আধুনিকায়নের যুগ, এটি তৈরি করেছে মানুষই। তবে কারো একার পক্ষে সবকিছু সরবরাহ করা তো সম্ভব নয়, তাই শরণাপন্ন হয়েছে একে অন্যের কাছে। প্রথম দিকে চেনা-পরিচিতদের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি আদান-প্রদান চলত। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের চাহিদা এতটাই বাড়তে থাকলো যে, শুধু নিজেদের মধ্যের কয়েকটি জিনিস দিয়ে স্বচ্ছন্দ্যে জীবন চলছে না। তখন আবার কেউ কেউ নতুন নতুন জিনিসপত্র উদ্ভাবনও করছিল। তা সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য ফেরি করা শুরু করলো। দেখল, তাতেও হচ্ছে না। তারপর কোথাও কোথাও দেয়াল লিখনের মাধ্যমে নিজের তৈরি পণ্য সম্পর্কে জানানোর প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে সকলে উপলব্ধি করে, এটিই হতে পারে প্রচারের বড় একটি মাধ্যম। এর পরের ঘটনা সকলেরই জানা। রেডিও, টেলিভিশনের অন্যতম অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিজ্ঞাপন। রঙিন, সুরেলা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনও রয়েছে, যেগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশি। সেই প্রাচীনকালের নিয়মে দেয়াল লিখনে বিজ্ঞাপনেরও দেখা মিলবে সবখানেই। তাছাড়া আধুনিক বিলবোর্ড তো আছেই। আজকাল আবার বিভিন্ন দালানে রঙ-বেরঙের নকশা বা পেইন্টিং ব্যবহারের পরিবর্তে বিজ্ঞাপন আঁকাও দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনা।
বিজ্ঞাপন এবং আমাদের ভাবনা
বিজ্ঞাপন দেখে ভাবনা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। যেমন ধরুন একটি চকলেটের বিজ্ঞাপন দেখে আপনি আকৃষ্ট না হলেও আপনার চার বছর বয়সী ছোট ভাইটি ঠিকই মনোযোগ সহকারে দেখছে। আবার একটি রঙ ফর্সাকারী ক্রিম দেখে আপনার বোনটি আকৃষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ নিজেদের আগ্রহের স্থান থেকেই আমরা বিজ্ঞাপনের দিকে খেয়াল করি। একটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকের ভাবনায় মিল আছে- সকলেই ভাবে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানানো হচ্ছে, যাতে আমরা সঠিক পণ্য বাছাই করতে পারি। অজস্র ঠান্ডা পানীয়ের বিজ্ঞাপন দেখে শেষ পর্যন্ত আপনি হয়তো এমন একটি বেছে নিলেন, যেটির বিজ্ঞাপনে আপনার প্রয়োজনকে বেশি তুলে ধরা হয়েছে, বা বাঘের মতো শক্তি পেয়ে যাবেন এমন আশ্বাস দিয়েছে!
বিজ্ঞাপন আসলে কী করছে?
বিজ্ঞাপন আসলে আমাদের প্রভাবিত করছে। অনেকেই বলে থাকবেন যে তারা বিজ্ঞাপনের দ্বারা একেবারেই প্রভাবিত হন না। কিন্তু সত্য হলো এ-ই যে, আপনি আপনার অজান্তেই বিজ্ঞাপনের প্রভাবের শিকার। বিজ্ঞাপনের দুইটি ধরণ হতে পারে, যেগুলো যৌক্তিক বা অযৌক্তিক বা দুয়ের সংমিশ্রণে হতে পারে।
যেমন-
১। পণ্যকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন
যে পণ্য আপনি চেনেন না, কোনোদিন নামই শোনেন নি এমন পণ্য নিশ্চয়ই কিনতে চাইবেন না। তাই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তথ্য প্রদান করা হয়। এ ধরনের বিজ্ঞাপনগুলো সাধারণত যৌক্তিক হয়ে থাকে। এতে পণ্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের একাংশ তুলে ধরার পাশাপাশি সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কেও তুলে ধরে। এই বিজ্ঞাপনগুলো ভোক্তাকেন্দ্রিক নয়, পণ্যকেন্দ্রিক। এ ধরনের বিজ্ঞাপনগুলো দেখে আপনি পণ্যটি কেন কিনবেন, তা সম্পর্কিত ধারণা পাবেন এবং একইরকম অন্য পণ্যটি কেন কিনবেন না- তা উল্লেখ করা হয়। উদাহরণ হতে পারে বিভিন্ন হেলথ ড্রিংক্সের বিজ্ঞাপন।
তবে এক্ষেত্রে শুধু কোম্পানির ভালো দিকগুলোই তুলে ধরা হয়, আসল তথ্যগুলো কিন্তু আড়ালেই রয়ে যায়। তবুও সাধারণ জনগণ কিন্তু সেগুলোকেই ফোকাস করে পণ্যটি কিনে ফেলেন।
২। ভোক্তাকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন
এগুলো অনেকটাই অযৌক্তিক। যেমন ধরুন, প্রসাধনী পণ্যের বিজ্ঞাপন চলছে। দেখাচ্ছে একটি মেয়ে কালো বলে তার চাকরি হচ্ছে না। তারপর মেয়েটি ঐ প্রসাধনী ব্যবহার শুরু করলো এবং তার বড় একটি চাকরি হয়ে গেল! এমন পণ্য দেখে প্রথমত আপনার হাসি পেতে পারে, বিরক্তি আসতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই আপনার মনে হতে পারে যদি সত্যি এমন হয়? চেষ্টা করলে ক্ষতি কী! আর এভাবেই বিজ্ঞাপন আপনাকে প্রভাবিত করে ফেলতে পারে।
মোট কথা, বিজ্ঞাপন আমাদের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘অ্যাফেক্টিভ কন্ডিশনিং’ বা ‘আবেগীয় শর্তারোপ’ বলা হয়ে থাকে। অনুভূতি নিয়ে খেলাটা অনেকটা এমন যে আপনি আপনার পরিচিত পণ্যটির ব্যবহার থেকে বের হয়ে যেন বিজ্ঞাপন দেখে ঐ পণ্যটি কেনেন। এবং এটিই হয়। কোনো একটি পণ্য সম্পর্কে ভালো এবং ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি করে চলতি অন্যান্য পণ্যের থেকে মূল্যবান বা আকর্ষণীয় করে তোলে বিজ্ঞাপন। তাই দেখা যায় টিভি বা পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের অসংখ্য বিজ্ঞাপন এড়িয়ে যেতে চেয়েও তা আমাদের প্রভাবিত করে ফেলে।
জেনে বুঝে কেন আমরা প্রভাবিত হই?
বিজ্ঞাপন দেখে প্ররোচিত হয়ে কতকিছুই না কেনা হয়, ব্যবহার করা হয় প্রতিদিন। কোনোটি উপকার করছে ,আবার কোনোটি ব্যবহার করে টাকা যেন জলে ফেলা হলো। কিন্তু কেন? তা কি শুধুই বিজ্ঞাপনের প্রভাব? অনেকটা তা-ই। ব্যস্ত জীবনযাত্রায় কোনোকিছুতেই যেন নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া যায় না, সেটি পণ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে হোক বা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। তাই সকলে সেটিই বেছে নেন, যা কিছুটা ভালো অনুভূতির সৃষ্টি করে বা মন্দ অনুভূতি থেকে মুক্তি দেবে। আর তাই বিজ্ঞাপন দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হই।
আরেকটি কারণ হলো অভিজ্ঞতা। ধরুন, পূর্বে কোনো একটি বিজ্ঞাপন দেখে একটি পণ্য কিনে ভালো ফলাফল পেয়েছেন। আর তাই পরবর্তীতে বিজ্ঞাপন দেখে আকর্ষণীয় লাগলেই মনে হয়, সেটি ভালোই হবে!
বিজ্ঞাপনদাতারা এভাবেই আপনাদের মানসিক জগতে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়। সেই অধিকার তো আপনিই দিচ্ছেন- জানতে বা অজান্তে।
কিছুই কি করার নেই?
বিজ্ঞাপন আপনার অনুভুতি নিয়ে খেলে যাবে আর আপনার কিছুই করার থাকবে না? বিজ্ঞাপনগুলোর বেশিরভাগই মনোবিজ্ঞানের কার্যকর তত্ত্ব ব্যবহার করে করা হয়, তাই তা সহজেই আপনার অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কিন্তু অনুভূতি তো আপনার। তা আপনি যদি একটু সচেতন হতে পারেন, তাহলেই এই খেলায় ভুক্তভোগী হতে হয় না। বিজ্ঞাপন দেখে না গলে যাচাই করে পণ্য ব্যবহারের অভ্যাস করুন। আর আপনার বাসায় যে ছোট বাচ্চাটি রয়েছে, তাকেও বিজ্ঞাপনের বাস্তব দিক এবং কাল্পনিক দিকগুলোকে আলাদা করতে সাহায্য করুন, বুঝিয়ে বলুন।