আজকাল টিভি, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে প্রতিনিয়তই আমরা এদিক-ওদিক থেকে অতর্কিত হামলার সংবাদ দেখি, বলতে গেলে এসবের সাথে একরকম অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও এরকম কোনো কিছু ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। দুর্ভাগ্যবশত বলতেই হয়, আমরা কেউই হামলাকারীদের নাগপাশ থেকে মুক্ত নয়, সে যে-ই হোক, খুব আপন কিংবা খুব পর।
আর এটিও সত্য যে, আপনাকে প্রতিটি সময় প্রস্তুত থাকতে হবে এবং চারপাশে সজাগ দৃষ্টি রেখেই আপনাকে চলতে হবে। হ্যাঁ, আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই, শুধু প্রয়োজন আপনার কৌশলী মনোভাব এবং বিপদের সময় যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রাখা।
আগেই বলে নিই, এখানে আত্মরক্ষার জন্য আপনাকে কারাতে মাস্টার হবার কোনো প্রয়োজন নেই, যদি আপনি শিখতে চান, তাহলে ভিন্ন ব্যাপার। তবে হঠাৎ অতর্কিত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে অথবা এ অবস্থায় পতিত হবার পর আপনাকে কিছু সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসরণ করতে হবে। শর্ত একটাই, মাথা গরম রাখা যাবে না। আসুন শুরু করা যাক।
দৃঢ়মুষ্টিতে প্রতিহত করা
বস্তুত অযাচিত হাতাহাতি কিংবা মারামারির শুরুতে হাতের কব্জির পজিশন নিয়ে বহু আগে থেকেই একটা ছোটখাটো বিতর্ক চলে আসছে। যদিও মারামারির সময় বা ঠিক আগে আমাদের হাতের কবজি আপনাআপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। হ্যাঁ, এখানেও একটু সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে, তা হলো, আপনার হাতের বুড়ো আঙ্গুলকে কোনোভাবেই ব্যথা দেয়া যাবে না। তার মানে এই নয় যে, আপনি বুড়ো আঙ্গুলটিকে বাকি আঙ্গুলগুলোর মধ্যে লুকিয়ে রাখবেন, এতে করে আঙ্গুলে মারাত্মক ব্যথা পাবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এক্ষেত্রে হাতের বুড়ো আঙ্গুলকে ঠিক বের করার মতো না করে হাতের বাকি আঙ্গুলগুলোর উপরে রাখুন। উপরের ছবিটির দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
হাত বেঁধে ফেললে যা করবেন
ধরুন, কেউ আপনার দু’হাত খুব শক্ত করে বেঁধে রেখেছে, কীভাবে ছুটে যাবেন বুঝতে পারছেন না। কী করবেন তখন? জীবনে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হাত দুটোকে কোনো কিছুর সাথে ঘষবেন, নাকি একটু বুদ্ধি খাটাবেন? তবে বুদ্ধি খাটাতে গিয়ে আবার মাথা গরম করা যাবে না। আগেই বলে দিয়েছি, বিপদে যে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে সেই জয়ী। আচ্ছা, এখন দড়ির শক্ত গিঁট থেকে মুক্ত হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন বাতাসের অবাধ চলাচল, মানে দু’হাতের মাঝে বাতাসকে চলাচলের জন্য একটু জায়গা করে দেওয়া। যদি হাত বাধা থাকে, তাহলে হাত দুটিকে ছবির মতো করে একসাথে মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেলুন। যদি শরীর বাঁধা থাকে, তাহলে যত সম্ভব নিঃশ্বাস ভিতরে নেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার বন্ধনীর সাথে আপনার শরীরের যতই দূরত্ব তৈরি হবে, ততই বাঁধন হতে মুক্ত হবার সম্ভাবনা বাড়বে।
ডাক্ট টেপ দিয়ে বেঁধে ফেললে কী করবেন ?
কী করবেন? এখন যদি কেউ ডাক্ট টেপ দিয়ে আপনাকে বেঁধে ফেলে? চিন্তার কোনো কারণ নেই, এটি ছিঁড়তে যতটা কঠিন মনে হয় ঠিক ততটাই সহজ। কিন্তু একটি বিষয় মাথায় রাখা আবশ্যক, ডাক্ট টেপে হাত বাঁধা অবস্থায় টানাটানি করলে মোটেও লাভ নেই। আপনাকে যা করতে হবে, ডাক্ট টেপে বাঁধা অবস্থায় আপনার হাত দুটোকে মুষ্টিবদ্ধ করে মাথার উপর নিতে হবে এবং সকল শক্তি প্রয়োগ করে হাত দুটোকে দেখানো ছবির মতো করে উপর থেকে নিচের দিকে নামাতে হবে। ঠিক একইভাবে যদি আপনার হাত পিছনের দিকে বাঁধা থাকে, তবুও আপনি এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারবেন।
টার্গেট করুন সংবেদনশীল জায়গাগুলো
আপাতদৃষ্টিতে শারীরিক শক্তির দিক থেকে যদি হামলাকারী থেকে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হন, তাহলে এই পদ্ধতিটি আপনার জন্যই। সবার শরীরেই কিছু সাধারণ জায়গা থাকে, যেখানে আঘাতপ্রাপ্ত হলে যে কেউ নিমিষেই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য। তবে মনে রাখবেন, আঘাতটি খুব দ্রুততার সাথে এবং শক্তিশালী হতে হবে। আপনি যদি আঘাত করতে সময় বেশি নেন, তাহলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাটাই বেশি থাকবে। ছবিতে শরীরের সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।
হাতে থাকা বস্তুটির সহায়তা নিন
আপনাকে সাহায্য করতে পারে এমন যেকোনো বস্তু ব্যবহার করুন, আক্রমণের সময় হয়তো হাতে থাকা ঘরের চাবিটিও হতে পারে আপনার পরম বন্ধু। নারীদের ক্ষেত্রে, নিজেদের হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন অথবা আপনার গায়ে থাকা স্কার্ফটিকে হামলাকারীর মুখের দিকে ছুঁড়ে মারতে পারেন, এতে করে হামলাকারী হতে কিছুটা হলেও দুরত্ব তৈরি করা সম্ভব। তবে ভ্যানিটি ব্যাগে পিপার স্প্রে রাখতে ভুলবেন না যেন।
যদি হাত শক্ত করে ধরে ফেলে
ধরুন, হামলাকারী হঠাৎ করে এসেই আপনার হাত ধরে ফেললো, কী করবেন, আত্মসমর্পণ করবেন? নাকি পাল্টা জবাব দেবেন? সেক্ষেত্রে হামলাকারী আপনার হাত ধরার সাথে সাথে দ্রুত আপনার হাতটিকে সজোরে এক ঝটকায় হামলাকারীর বুড়ো আঙ্গুল বরাবর ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে ফেলতে হবে (চিত্রে বর্ণিত)।
এ কৌশলটি যত দ্রুত প্রয়োগ করতে পারবেন, ততই আপনার মঙ্গল। যদি এ পদ্ধতিতে আঘাত করার সুযোগ না পান, সেক্ষেত্রে আপনার পা দিয়ে সজোরে হামলাকারীর কুঁচকিতে আঘাত অথবা হাঁটুতে লাথি মারতে হবে। অথবা আপনার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে তার পায়ের উপর দাঁড়িয়ে যাবেন। এতে করে সে নড়ার সুযোগ পাবে না এবং আপনি সহজেই তাকে পরাস্থ করতে পারবেন।
সজোরে চুলের মুঠি ধরলে কী করবেন?
হামলা করার এ পদ্ধতিটি অনেক পুরোনো এবং অনেকেই এভাবে হামলার শিকার হয়ে থাকেন। সচরাচর নারীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ঘটে থাকে বেশি। এ ধরনের হামলায় মূলত ভিকটিমের উপর হামলাকারীর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। চিন্তার কোনো কারণ নেই, এ থেকেও মুক্তির উপায়ও আছে। প্রথমত আপনাকে যা করতে হবে, পেছন থেকে চুলে হাত দেবার সাথে সাথে আপনি হামলাকারীর হাত ধরে ফেলবেন যা আপনাকে পুনরায় আপনার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিতে সহায়তা করবে। আর যতক্ষণ না পর্যন্ত হামলাকারীর হাতের মুষ্টি আপনার চুল থেকে শিথিল হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, আর শিথিল হওয়া মাত্রই সজোরে ছাড়িয়ে নিন এবং নির্দিষ্ট দূরত্বে চলে যান।
গলায় কিংবা ঘাড়ে হাত দিলে কী করবেন ?
প্রথমত, বিচলিত হবেন না। যখনই হামলাকারী সজোরে আপনার গলায় চাপ দিবে, আপনি সাথে সাথে আপনার পা দিয়ে তার কুঁচকিতে আঘাত করবেন। যদি এতেও কিছু না হয় তাহলে আপনার হাতের আঙ্গুল ব্যবহার করে, হামলাকারীর চোখে এবং মুখে জোরে খোঁচা দিতে পারেন। এতে করে হামলাকারী সাথে সাথে তার হাত ছাড়িয়ে নিতে বাধ্য।
লিফটে থাকলে কী করবেন ?
আমাদের সকলেরই ব্যাপারগুলো জানা যে, আপনি খুব অপরিচিত কারও সাথে লিফট দিয়ে না ওঠা অথবা খুব সন্দেহজনক হলে সাথে সাথে লিফট থেকে নেমে যাওয়া উচিত। কিন্তু ব্যতিক্রম তো হতেই পারে, এজন্য আপনি লিফটে ওঠার পর যেখানে লিফটের বাটনগুলো আছে সেখানটায় দাঁড়াবেন, অবশ্য এর আগে লিফটের কোন বাটনে কী আছে তা দেখে নিতে ভুলবেন না যেন।
গাড়িতে কিংবা যাত্রাপথে হামলা থেকে বাঁচতে করণীয়
প্রযুক্তির কল্যাণে এবং জীবনযাত্রার সহজ করার নিমিত্তে ইদানিং আমাদের দেশেও অনেক ধরনের গাড়ি সার্ভিসের উদ্ভব হয়েছে। আর সাথে সাথে নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে চলে আসছে, বিশেষ করে নারীদের একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হচ্ছে। তাই নতুন কোনো গাড়িতে ওঠার ক্ষেত্রে আপনি যা করতে পারেন, সবার প্রথমে আপনার কাছের কাউকে গাড়িটির নাম্বার, গাড়ির রং এবং আপনার গন্তব্য জানিয়ে দিতে পারেন। গাড়িতে ওঠার পর চালকের গন্তব্যের সাথে আপনার গন্তব্যের মিল আছে কিনা তা বারবার মিলিয়ে নেবেন।
সত্যি বলতে গেলে, কেউই আমাদের পরিচিত নয়। অন্যদিকে কাউকে একবার দেখেই খারাপ-ভালো নির্ণয় করাটাও একটু কষ্টের হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আপনাকেই সজাগ থাকতে হবে সবসময়। যদি হামলার শিকার হয়েই যান, তাহলে ভুলে যাবেন না যে, আপনারও পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ আছে। আর কোথায় আঘাত করবেন সেটাও হয়ত এতক্ষণে জেনে গিয়েছেন। আপনার দৈনন্দিন চলাচল সুখকর হোক। এই কামনা রইল।
ফিচার ইমেজ: Judo Karate Class in Gurgaon