ধূমপানের কারণে স্ট্রোক হয়
ধূমপানের কারণে হৃদরোগ হয়
পরোক্ষ ধূমপানের কারণে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়
বর্তমানে কোনো সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলেই বিভিন্ন অঙ্গের বীভৎস ছবিসহ এ ধরনের সতর্কবাণী চোখে পড়ে। আইন করে সিগারেটের প্যাকেটে এসব সতর্কবার্তা মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া কোনো প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন বা এতে প্রলুব্ধ করার যেকোনো কৌশলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ধুমপান যে স্বাস্থ্যের জন্যে ভীষণ ক্ষতিকর, এটি বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সত্য। চেইন-স্মোকার থেকে সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানি, কেউই এটি অস্বীকার করে না। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন ধূমপানের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ছিল না। সিগারেট কোম্পানিগুলো নানা চিত্তাকর্ষক প্রক্রিয়ায় তাদের পণ্যের প্রচার করতো। এমনকি এর জন্যে তারা ডাক্তারদেরও ব্যবহার করতো। বিভিন্ন গবেষণার দোহাই দিয়ে, সিগারেট কোম্পানিগুলো তাদের ক্রেতাদের বোঝাতো তাদের সিগারেট তেমন কোনো ক্ষতি করে না।
কোনো ডাক্তার ধূমপানে উৎসাহ দিচ্ছে বা কেউ প্রচার করছে যে ধূমপান স্বাস্থ্যকর, এমন ধারণা বর্তমানে আমাদের কাছে ভীষণ আজগুবি মনে হয়। কিন্তু ১৯৫০ এর আগে, ধূমপান যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এর কোনো পরীক্ষিত প্রমাণ ছিল না। সিগারেট ও ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ১৯৪০ এর দশকে এসে ফুসফুসের ক্যান্সার নিয়ে মানুষ ভীত হতে শুরু করে। এ রোগের ফলে মৃত্যুর হার সেই সময় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। মানুষ নিশ্চিতভাবে জানতো না যে এটি সিগারেটের কারণে হতে পারে।
তবে সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে মানুষ কিছুটা হলেও চিন্তিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। মানুষের এ চিন্তা দূর করতেই সিগারেট কোম্পানিগুলো ডাক্তার ও চিকিৎসাশাস্ত্রকে ব্যবহার করতে শুরু করে। খেলোয়াড়, অভিনেতা ও অন্যান্য সেলিব্রেটিদের পাশাপাশি সিগারেটের বিজ্ঞাপনে জায়গা করে নিতে থাকনে ডাক্তাররা।
তখন পেনিসিলিন সহ বিভিন্ন আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞান সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এর ফলে চিকিৎসাশাস্ত্র ও ডাক্তারদের প্রতি তৈরি হয়েছিল বিশেষ আস্থা। সিগারেট কোম্পানিগুলো মানুষের সে আস্থাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ডাক্তারদের কথা উল্লেখ করে মানুষকে সিগারেট বিষয়ে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা চালায় তারা।
তবে অন্যান্য বিজ্ঞাপনের মতো কোনো ব্যক্তি-বিশেষ ডাক্তারের দ্বারা এ বিজ্ঞাপন করানো হতো না। কারণ ডাক্তারদের কোনো বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়া সেসময় নৈতিকতা বিরোধী ছিল। তাই কোনো অভিনেতাকে ডাক্তারের মতো সাজিয়ে দেখানো হতো বিজ্ঞাপনে। ছবিগুলোতে তাদের দেখানো হতো, একজন আদর্শ চিকিৎসক হিসেবে যিনি বেশ আগ্রহের সাথে ধূমপানের অভ্যাসকে সঙ্গী করে নিয়েছেন।
এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা এমন বার্তা ছড়াতে চায় যে, একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের সিগারেট পান করেন, তাহলে সেটি নিশ্চয়ই নিরাপদ হবে। জার্নাল অব দ্যা আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন-এর মতো প্রখ্যাত সব জার্নালগুলোতেও প্রচারিত হতো এসকল বিজ্ঞাপন। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এসময় চিকিৎসক সমাজ থেকে এ বিষয়ে তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। ধারণা করা হয়, এ বিজ্ঞাপনগুলোতে ডাক্তারদের বেশ অভিজাতভাবে তুলে ধরা হতো বলে তেমন কেউ এ নিয়ে খুব বেশি সোচ্চার হয়নি।
সিগারেট কোম্পানিগুলো এর ফায়দা ভালোভাবেই লুটেছে। বিজ্ঞাপনে ডাক্তারদের ব্যবহারের ফলে সিগারেটের জনপ্রিয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। ক্যান্সার বা স্ট্রোকের মতো ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়গুলো তো পরের কথা, ধূমপানের ফলে সরাসরি যে সমস্যাগুলো হতো যেমন, নাক ও গলায় খুসখুসে ভাব বা কাশি এসবও অস্বীকার করতো কোম্পানিগুলো। তারা প্রচার করতো
অন্যান্য ব্র্যান্ডের সিগারেট আপনার গলায় এসব সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু আমাদেরটা করবে না।
বিজ্ঞাপনে সর্বপ্রথম চিকিৎসকদের ব্যবহার করেছিল আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি। লাকি স্ট্রাইক নামের একটি সিগারেট তৈরি করতো তারা। তাদের বিজ্ঞাপনী সংস্থা বহু চিকিৎসকের কাছে এ সিগারেটের কার্টুন পাঠিয়ে দিয়েছিল। এরপর তারা সেসকল চিকিৎসকদের জিজ্ঞেস করেছিল, “এ সিগারেট কি গলায় কম জ্বালা ধরায়?”। চিকিৎসকদের অনেকেই এ বায়াসড প্রশ্নটির হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। আর আমেরিকান টোব্যাকো তাদের উত্তরকে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে। ১৯৩০ সালের দিকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়, “২০ হাজার ৬৭৯ জন চিকিৎসক বলেছেন লাকি স্ট্রাইক সিগারেট গলায় কম জ্বালা ধরায়”।
১৯৩৭ সালে প্রচারিত ফিলিপ মরিস কোম্পানির বিজ্ঞাপনটি ছিল আরো এক কাঠি সরেস। স্যাটারডে ইভিনিংয়ের একটি পোস্টে লেখা হয়, ডাক্তাররা একটি গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, ধূমপায়ীরা যখন অন্য সিগারেট ছেড়ে ফিলিপ মরিস ধরেছেন তখন তাদের নাক ও গলার সমস্যা দূর হয়ে গেছে বা অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। অবশ্য এ ‘গবেষণা’ যে, ফিলিপ মরিসের দেওয়া তহবিলে হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি সে লেখায়।
ফিলিপ মরিস এ ধরনের ‘গবেষণার’ বিজ্ঞাপন চল্লিশের দশক ধরে চালিয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি একই কাজ করে আরজে রেনল্ড টোব্যাকো কোম্পানিও। এজন্য একটি মেডিকেল রিলেশন ডিভিশনও গঠন করেছিল তারা। ফিলিপ মরিসের মতো তারাও বিভিন্ন গবেষণার জন্য তহবিল প্রদান করতে থাকে। এরপর তাদের ‘গবেষণায়’ প্রাপ্ত ফলাফল উল্লেখ করতে থাকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে। ১৯৪৬ সালের দিকে “ডাক্তাররা অন্য সিগারেটের চেয়ে ক্যামেল সিগারেট বেশি পান করেন” এ স্লোগান দিয়ে তারা একটি প্রচারাভিযানও চালিয়েছিল।
এ বিজ্ঞাপনের কৌশল অনেকটা আমেরিকান টোব্যাকোর মতোই ছিল। ফ্রিতে ডাক্তারদের ক্যামেল সিগারেটের কার্টুন ধরিয়ে দেওয়া হতো। এরপর তাদের জিজ্ঞেস করা হতো, “আপনারা কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট পান করেন?”
কিন্তু তাদের এসব কূটচাল মুখ থুবড়ে পড়ে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে। এসময় শক্ত প্রমাণ মেলে যে, সিগারেটের কারণে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো রোগের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবগুলো সিগারেট কোম্পানি এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। তারা নতুন ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা করে যে, আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না যে, সিগারেট আসলেই ক্ষতিকারক কি না।
১৯৫৪ সালে বেশ কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি একত্রিত হয়ে A Frank Statement to Cigarette Smokers শিরোনামে সকল ধূমপায়ীদের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি প্রদান করে। এতে তারা বলার চেষ্টা করে যে, ফুসফুসের ক্যান্সার বিষয়ক সাম্প্রতিক গবেষণায় অনেকেই সিগারেটের সাথে এর সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখনো নিশ্চিতভাবে এটি জানা যায়নি। ফুসফুসের ক্যান্সার বাড়ানোর জন্যে সিগারেটকে যেমন সন্দেহ করা যায়, তেমনই আধুনিক সমাজের আরো অনেক বিষয়কেই সন্দেহ করা যায়। এ গবেষণাকে বিতর্কিত বলেও আখ্যা দেয় তারা।
এরপর কোম্পানিগুলো একসাথে একটি গবেষণা প্রকল্প চালু করে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। এরপর থেকে সিগারেটের বিজ্ঞাপনে ডাক্তারদের ব্যবহার করাও বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ আর এসব অপবিজ্ঞানের আলাপে গলছিল না। তাছাড়া ডাক্তাররাও ধূমপানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে থাকে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ইউ.এস সার্জন জেনারেল রিপোর্টে বলা হয়, ফুসফুস ও গলায় ক্যান্সার এবং ক্রনিক ব্রংকাইটিসের অন্যতম কারণ ধূমপান।
এসব গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পরেও সিগারেট কোম্পানিগুলো এ কথা স্বীকার করে নিতে রাজি হয়নি। তারা তাদের ‘গবেষক’ দলের বরাত দিয়ে এটিকে বিতর্কিত ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের এ কৌশল বন্ধ করতে আইনের প্রয়োগ করতে হয়। সার্জনদের রিপোর্ট প্রকাশের বছর দুয়েক পর, আমেরিকান কংগ্রেস সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সতর্কবার্তা মুদ্রণের আইন পাশ করে ও এর বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে।
২০০৬ সালে যখন ইউরোপে ইলেকট্রিক সিগারেটের বিপণন শুরু হয়, তখন এটিকেও নিরাপদ আখ্যা দিয়ে কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালাতে শুরু করে। এ বিষয়টি শুধুমাত্র সিগারেট বা ই-সিগারেটের ক্ষেত্রে নয়, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তাদের পণ্য বিক্রি করতে এভাবে অপবিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে থাকে। অনেকে বিজ্ঞানের নামে নানান চটকদার বিষয় নিয়ে হাজির হয়, যা আসলে সত্যি নয়। এসব বিষয়ের ফাঁদে পড়া থেকে সতর্ক থাকা উচিত আমাদের।
ফিচার ছবি- stanford.edu