ধরুন, ঘরে একটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। খুব কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দিলেন। খুব জাঁকজমকভাবেই অনুষ্ঠানটি শেষ হলো। খাওয়াদাওয়া, গল্প-গুজব সেরে সকলেই একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ঘরে তখন স্বামী-স্ত্রী একাকী বসে সারাদিনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গল্প করছেন। এমন সময় লক্ষ্য করলেন, একটি জিনিস ঘরের মধ্যে যেন নেই। একটু খোঁজাখুঁজি করেই বের করলেন, টেবিলের উপরে রাখা আপনার প্রিয় একটি পুরনো শো-পিস নেই। আরও কিছু সময় খুঁজে নিশ্চিত হলেন, সেটি খোয়া গেছে। কিন্তু আপনার স্পষ্ট মনে আছে, সকালবেলাতেও ঠিক সে জায়গাতেই আপনি দেখে রেখেছিলেন। তাহলে কি অতিথিদের মধ্যে কেউ একজন চুরি করেছে সেটি? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? জিনিসটির দাম যে খুব আহামরি রকমের, তা-ও তো নয়। বাসায় যারা এসেছিলেন সকলেই প্রতিষ্ঠিত এবং সম্ভ্রান্ত ঘরের। এমন কেউ আসেনি, যাকে চোর বলে ভাবা যেতে পারে। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে জিনিসটি খরচের খাতায় লিখে নিয়ে ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
আমাদের এই সাংসারিক জীবনে অনেককেই এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। অনেক সময় অনেক দামী জিনিসপত্রও চুরি হয়ে যেতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, এই ধরনের চুরি যারা করেন, তারা যে অভাবের তাড়নায় তা করেন, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় স্বভাব বা রোগের কারণেও এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত চুরি করতে পারেন। আর চিকিৎসাশাস্ত্রে এই মানসিক রোগের নামই হলো ক্লেপটোম্যানিয়া।
ক্লেপটোম্যানিয়া হচ্ছে এমন এক ধরনের রোগ, যার কারণে রোগী সবসময় কিছু চুরি করার জন্য তাড়না বোধ করতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত চুরি করতে না পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের মধ্যে একধরনের দমবন্ধ অবস্থার অনুভব করতে থাকে। এমনও হয় যে, খুব কাছের কারো কাছ থেকে চুরি করতে পর্যন্ত তিনি দ্বিধা বোধ করেন না। কিন্তু অন্যান্য চুরির সাথে এর পার্থক্য হলো, এক্ষেত্রে রোগী চুরি করা জিনিস কখনো বিক্রি করেন না বা নিজের ব্যবহারের জন্য রেখে দেন না। চুরি করার পর তিনি খুব আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন এবং চুরি করা জিনিসটি ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে থাকেন।
ক্লেপটোম্যানিয়া একটি বিরল কিন্তু গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্যব্যধি, যা যে কারোরই হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত অনেকে আমাদের আশেপাশেই হয়তো রয়েছে। তবে এই মানসিক ব্যাধি কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যার ফলে সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু অনেক রোগীই সামাজিকতা এবং লোকচক্ষুর ভয়ে সহজে কোনো ডাক্তারের কাছে যেতে চান না বা কারো কাছে এই বিষয়ে কথা বলতে চান না। এর ফলে রোগী কখনো রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন না।
উপসর্গসমূহ
- এমন কোনো জিনিস, যেটার কোনো প্রয়োজন নেই, তবুও সুযোগ পেয়ে তা চুরি থেকে বিরত রাখার জোর চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে প্রতিহত করতে না পারা।
- যতক্ষণ চুরির সুযোগ পাওয়া না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত খুব অস্থির থাকা, উদ্বিগ্ন থাকা এবং এক ধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করা।
- চুরি করার সময় একধরনের মানসিক শান্তি এবং আনন্দ অনুভব করা।
- চুরি করার পর অসম্ভব আত্মগ্লানি, ভয় এবং অনুশোচনা কাজ করা।
বৈশিষ্ট্যসমূহ
- এ ধরনের চুরিগুলো কোনোপ্রকার পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই সংগঠিত হয়ে থাকে। এসকল চুরির সাথে অন্য কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকে না।
- এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত অনেক জিনিসের স্তূপ বা কোনো বড় সুপার মার্কেট বা এ ধরনের পাবলিক জায়গা থেকে চুরি করে। অনেকে আবার আত্মীয় বা বন্ধুর বাসা থেকে চুরি করে ফেলে।
- চুরি করা জিনিসগুলোর বেশিরভাগ সময় কোনোপ্রকার আর্থিক মূল্য থাকে না বা খুব দুষ্প্রাপ্য কিছু নয়।
- চুরি করা জিনিসটি কখনো নিজের জন্য ব্যবহার করা হয় না। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি চুরির জিনিসটি পরবর্তীতে কাউকে দান করে দেন বা যেখান থেকে চুরি করেছিলেন সেখানেই রেখে আসতে চান।
ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া
যদি কেউ বুঝতে পারেন যে, তার অনিচ্ছা স্বত্বেও চুরি করার অভ্যাস রয়েছে এবং খুব চেষ্টা করেও চুরির অভ্যাস কমাতে পারছেন না, তবে দেরি না করে মানসিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়ায় হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অনেকে জানাজানি হওয়ার ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। আবার অনেকে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাবেন, বলে কাউকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে চান না। তবে এসব ক্ষেত্রে সবচাইতে নিরাপদ হলো একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। কারণ, একজন পেশাদার চিকিৎসক কখনো রোগীর কোনো গোপন তথ্য সাধারণের কাছে প্রকাশ করেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ সঠিকভাবে মেনে চলে অনেক সময় ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
যদি কাছের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়
এই রোগে আক্রান্ত হলে তাদের আশেপাশের মানুষজনের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদি পরিবারের কোনো সদস্য বা বন্ধুবান্ধব ক্লেপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়, তবে তার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এবং পারিবারিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ রোগের প্রভাব কমিয়ে আনা যেতে পারে।
ক্লেপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সাথে কথা বলার সময় কিছু বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে-
- আপনি তার ভালো চাইছেন এবং তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত।
- চুরির ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; যেমন- গ্রেফতার, চাকরি হারানো, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি।
- রোগীকে যথেষ্ট পরিমাণ আশ্বস্ত করা যে, চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগের প্রতিকার সম্ভব।
কারণ
ক্লেপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো স্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে আক্রান্ত হওয়ার অনেক ধরনের মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। অনেকের মতে, এটি সেরোটোনিন নামক একটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মস্তিষ্কের রাসায়নিক (নিউরোট্রান্সমিটার) জনিত সমস্যা। অনেকের ধারণা, বংশগত কারণ, সাংসারিক অশান্তি বা মানসিক আঘাত এই রোগের মূল কারণ।
ঝুঁকি
ক্লেপটোম্যানিয়া মোটেও কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। এ ধরনের রোগীরা সহজে নিজেদের সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারে না। ফলে অনেকেই একটা সময় ধরা পড়ে যায়। ফলে অনেক সময় এই রোগের কারণে জেল, জরিমানা বা শাস্তি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়ে। তবে বয়স বাড়ার পরেও এই রোগ থেকে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই রোগে আক্রান্ত দুই-তৃতীয়াংশ রোগীই নারী।
জটিলতা
ক্লেপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত রোগী গুরুতর মানসিক অশান্তি, পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক সমস্যা ও বিভিন্ন ধরনের আইনী সমস্যার মধ্যে পড়তে পারেন। এই রোগের কারণে অনেক সময় কাছের মানুষের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন পর্যন্ত হতে পারে। এই ধরনের রোগের ব্যাপারে সকলের সঠিক তথ্য না থাকার কারণে সকলেই এটিকে যেকোনো সাধারণ চুরির সাথে মিলিয়ে ফেলেন। ফলে এই ধরনের রোগীকে আর দশজন সাধারণ চোরের মতোই দেখা হয়ে থাকে আমাদের সমাজে। তাই অবস্থা অনেক সময় এমনও হয়ে দাঁড়ায় যে, সামাজিক বিরূপ দৃষ্টিকোণ, অপমান, লজ্জা ও জেলের ভয়ে রোগী একসময় আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতেও প্ররোচিত হয়।
প্রতিকার
ক্লেপটোম্যানিয়ার কারণ কিন্তু একেবারেই পরিস্কার নয়। অনেকগুলো উপসর্গ বলা হলেও, ঠিক কী কারণে এই রোগের প্রভাব দেখা যায় তা কিন্তু এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও সঠিকভাবে নেই। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতি, রোগীর ইচ্ছাশক্তি এবং মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ কাজে লাগিয়ে এই রোগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।