নীলক্ষেতের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে শ্রাবণ। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে, বিকেলের অতি আরাধ্য ঘুমটাকে মাটি করে এখন তাকে বই কিনতে যেতে হচ্ছে। নতুন একটা অ্যাসাইনমেন্ট করতে দিয়েছেন স্যার। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই জমা দিতে হবে। পুরো সপ্তাহে আর একটুও ফুরসত মেলবে না ভেবে ওর মেজাজ আবারও সপ্তমে চড়ে গেলো।
দলগত অ্যাসাইনমেন্ট; পাঁচজনের একেকটি দল। স্যার দলগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন কাজের বিষয় বেছে নেওয়ার জন্য। চলচ্চিত্রের দিকে আগ্রহ থাকায় শ্রাবণ তার দলের সাথে শলাপরামর্শ করে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করবে বলে ঠিক করেছে। তাদের কাজ হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বানানো সিনেমাগুলোর বাস্তবতা বিশ্লেষণ।
ঝক্কির কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু দলগত অ্যাসাইনমেন্ট বলেই ভরসা পাচ্ছে সে। সবাই মিলে একটা বিশাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারবে ভেবে বেশ খুশিও লাগছে। কাকে কী কাজ ভাগ করে দেবে, মনে মনে তা হিসেব করতে করতে নীলক্ষেতের গলির ভেতর ঢুকে গেলো দলনেতা শ্রাবণ।
স্যার আবার মারাত্মক আন্তরিক অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। রাস্তাঘাটে সংশ্লিষ্ট কারও সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করেন,“কী হে, কাজ চলছে তো?” শ্রাবণকেও একদিন লাইব্রেরিতেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, “কাজ শুরু করেছ তো?”
ওদিকে শ্রাবণের দল ততদিনে একটা বাক্যও লেখেনি। তারপরও সে আকর্ণ হেসে জবাব দিয়েছিল,“হ্যাঁ, স্যার, একদম!” স্যার নিজে সবগুলো দলের সাথে বসেছিলেন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কথা বলার জন্য, পরামর্শ দেওয়ার জন্য। সচরাচর যেটা অন্য শিক্ষকেরা করেন না। স্যারের এত আন্তরিকতা দেখে স্যারের ওপর শ্রাবণের একটু বাড়তি শ্রদ্ধার উদয় হলো, সাথে কাজটা সুন্দরভাবে শেষ করার তাগিদও অনুভব করলো।
ফেসবুক মেসেঞ্জারে গ্রুপচ্যাট খুলে সবাইকে কাজ ভাগ করে দিলো শ্রাবণ। কাউকে দিলো চলচ্চিত্র রিভিউ লিখতে, আবার কাউকে বললো যুদ্ধের ইতিহাসটুকু তুলে আনতে। শেষমেশ যখন সবার কাজ একত্র করে সম্পাদনায় বসলো, তখন শ্রাবণের মাথায় হাত! বেশিরভাগ সদস্যই যেন দায়সারাভাবে কাজ সেরেছে। কারও লেখায় প্রচুর ভুল, কারও লেখায় তথ্যস্বল্পতা। কেউ বা আবার কুম্ভীলকবৃত্তি অবলম্বন করেছে।
দেখা গেল, যুদ্ধে নারী নির্যাতনের ওপর ফোকাস করার জন্য যে চলচ্চিত্রটি নির্বাচন করা হয়েছিল, তার সাথে নারী নির্যাতনের ইতিহাসকে মোটেই তুলনা করা যাচ্ছে না। পুরো অ্যাসাইনমেন্টটি পড়লে বোঝা যায়, দলের সদস্যদের মধ্যে কোনো কার্যকর যোগাযোগ ছিল না।
শ্রাবণ অ্যাসাইনমেন্টটি যেভাবে প্রত্যাশা করেছিল, তার সিকিভাগও হলো না। হতাশ হয়ে সে টেবিলে মাথা পেতে দিয়ে চোখ বুজতেই আন্তরিক, শিক্ষার্থীবান্ধব স্যারের সৌম্যকান্তি চেহারাটা ভেসে উঠলো।
সোশাল লোফিং কী?
উপরের ঘটনাটি কল্পনাপ্রসূত হলেও বাস্তবে দলগত কাজের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই এরকম সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। দেখা যায়, একটি দলগত কাজে কিছু মানুষ কাজ না করার প্রবণতা দেখান বা কম কাজ করে সটকে পড়ার পাঁয়তারা করেন। আবার একই ধরনের কাজ তিনি যখন একা করেন, তখন তিনি নিজের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে,“দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ”। এই কথাটিতে যে বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হলো একতা। অর্থাৎ দলবদ্ধ হয়ে একটি কাজ করলে তার ফল যা-ই হোক, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। বরং, একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারাটাই আসল কথা।
কিন্তু এই প্রবাদের মামুলি অর্থের বাইরে আরেকটা গূঢ় অর্থও বের করা যায়। দশজন যখন এক হয়ে কাজ করে, তখন হারের মধ্যেও লজ্জা নেই- ঠিক এ কথাটা চিন্তা করেই কারো ভেতরের জিগীষা, বা জয়ের আকাঙ্ক্ষা মরে যেতে পারে। সে তখন ভাবতে পারে, এ কাজে ব্যর্থ হলেও সমস্যা নেই, সে ব্যর্থতার দায়ভার পুরো দলের ওপরই তো বর্তাবে।
আর এ চিন্তার কারণেই একটি দলে কাজ করা কোনো লোক তার কাজের ক্ষেত্রে কম উদ্যম দেখাতে পারে। মানুষ যখন একা কাজ করে, তখন সে যতটা যত্নের সঙ্গে সেই কাজটি করে, ঠিক একই কাজ যখন সে দলগতভাবে করে, তখন তার কাজটির পেছনে প্রচেষ্টা যথেষ্ট কমে যায়। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায় এই সমস্যাটির নাম- সোশাল লোফিং।
গবেষণা
দলে কাজ করার সময় ব্যক্তির কম খাটার এই প্রচেষ্টা রিঙ্গেলম্যান ইফেক্ট নামেও পরিচিত। দলগত কাজের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, কোনো নির্দিষ্ট কাজের সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন। দলের প্রতিটি সদস্যের সমন্বিত মেধা, পরিশ্রম, দক্ষতা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে কোনো কাজের শতভাগ সাফল্য লাভই হচ্ছে দলগত কাজের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, দলগত কাজ করার সময় দলের কিছু সদস্যদের কাজ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ আদায় করা অনেক সময় সম্ভবপর হয় না। ১৯৩৬ সালে ফরাসি কৃষিবিজ্ঞানী ম্যাক্স রিঙ্গেলম্যান সর্বপ্রথম সোশাল লোফিং নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি একদল লোককে একটি রশি টানার খেলায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এরপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা করে রশি টানতে দেন।
তিনি দেখলেন, যখন দু’জন লোক একসাথে রশি টানছে, তখন তারা যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করছে, নিজে স্বাধীনভাবে টানার সময় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ শক্তির প্রয়োগ করেছে। এছাড়া দলে সদস্যের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেয়েছে, সদস্যদের কার্যকরী শক্তি প্রয়োগের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে।
কয়েক দশক পরে, ১৯৭৯ সালে সোশাল লোফিং নিয়ে আরেকটি গবেষণা সম্পাদিত হয়। তিনজন গবেষক একদল শিক্ষার্থীকে হাততালি ও চিৎকার দিতে বলেন। দলগত হয়ে হাততালি দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা যতটা জোরে তাদের হাত চাপড়েছিল, এককভাবে হাততালি দেওয়ার সময় তার পরিমাণ ছিল আরও বেশি।
আরেকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের চোখ বেঁধে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে দেওয়া হয়। তাদেরকে চিৎকার করতে বলা হয় এবং একইসাথে জানানো হয়, অন্যরাও তাদের সাথে চেঁচাতে থাকবে। যদিও বাকিদের চিৎকার করতে বলা হয়নি।
এই পরীক্ষায় দেখা যায়, যখন অংশগ্রহণকারীরা ভেবেছিল তারা দলের সাথে চেঁচাচ্ছে, তারা যে পরিমাণ জোরে চেঁচিয়েছিল, তা এককভাবে চেঁচানোর সময় সৃষ্ট আওয়াজের চেয়ে কম ছিল। অর্থাৎ এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ যখন দলের সাথে কাজ করে, তখন সচেতন বা অবচেতনভাবে সে কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেয় বা কমিয়ে দিতে চায়।
কেন ঘটে সোশাল লোফিং?
সমন্বয়হীনতা: মনস্তাত্ত্বিকরা মনে করেন, দলগত কাজ ব্যর্থ হওয়ার একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে দলের সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আন্তঃব্যক্তিক ও দলগত যোগাযোগ বৈকল্যের কারণে এই সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়।
দলের আকার: দলের আকার বড় হলে সোশাল লোফিংয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ, দলে সদস্য সংখ্যা বেশি হলে সবার কাজের ওপর নজরদারি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে অনেক সদস্য নিজেকে গুটিয়ে নিলেও তা টের পাওয়া যায় না।
মোটিভেশন বা প্রণোদনার অভাব: দলের সদস্যদের মধ্যে কাজ সম্পর্কে কোনো উৎসাহের ঘাটতি থাকলে তা সোশাল লোফিং ডেকে আনতে পারে। যদি কোনো সদস্য তার কাজ সম্পর্কে অনিচ্ছুক থাকেন, তাহলে তিনি সে কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনা করার প্রেরণা পাবেন না। আবার কোনো সদস্য যদি মনে করেন, কাজটি করে শুধু শুধু তার সময় নষ্ট হবে, তাহলেও তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে কম সচেষ্ট হবেন।
নিজের অবদানে অবহেলা: দলের কোনো সদস্য যদি মনে করেন, তার কাজ দলের সামগ্রিক সফলতা বা ব্যর্থতার ওপর কোনো ভূমিকা রাখবে না, তাহলে তিনি কাজ করতে অনুৎসাহিত বোধ করবেন। আমরা দেখি, অনেক মানুষই মনে করেন যে, তাদের ভোট দেওয়া বা না দেওয়ার মধ্যে কিছু যায় আসে না। এ ধরনের মানুষেরা মনে করেন, তাদের একটি ভোট কী-ইবা এমন প্রভাব ফেলবে! ফলে তারা একটি বৃহৎ সোশাল লোফিংয়ের অংশ হয়ে যান।
সাক্ষীগোপাল: দলগত কাজের সময় ব্যক্তি অনেক সময় নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট নামে পরিচিত এই সমস্যায় দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট কাজের সময় যদি আশেপাশে ঐ কাজটি করায় সমর্থ অন্য কোনো লোক উপস্থিত থাকে, তাহলে ব্যক্তি তখন কাজটি সম্পাদন করতে সাহায্যপ্রদানে কিছুটা অপারগতা প্রকাশ করে। এই সমস্যাটি ডিফিউশন অভ রেসপন্সিবিলিটি নামেও পরিচিত।
রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে বেশিরভাগ মানুষের দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট, যেখানে সবাই মনে করে, অন্য কেউ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসবে! দলগত কাজের সময় দায়িত্বের প্রতি এ ধরনের অনীহা সৃষ্টি হলে সোশাল লোফিংয়ের উদ্ভব হয়।
অন্যকে দেখে প্রভাবিত হওয়া: দলের কোনো সদস্য যদি মনে করেন অন্য সদস্য বা সদস্যরা কাজে ফাঁকি দেবে বা দিচ্ছে, তাহলে তিনি নিজেও কাজ কম করার চেষ্টা করবেন। এ সমস্যাটি সাকার ইফেক্ট নামে পরিচিত। আবার বিপরীতভাবে, যদি দলের অন্য সদস্যরা অতিরিক্ত সাফল্য লাভ করে, তাহলে কম দক্ষতাসম্পন্ন সদস্য ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগতে পারেন। ফলে, তার কাছ থেকে বেশি কাজ আদায় করা সম্ভব হয় না, যা সোশাল লোফিং সৃষ্টি করে।
কমানোর উপায়
সোশাল লোফিং হ্রাসের জন্য গবেষকরা কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন।
- দলের প্রতিটি সদস্যের কাজের ওপর নজর রাখতে পারলে সোশাল লোফিং কমানো যেতে পারে।
- সদস্যদের এমন কাজ দিতে হবে, যা তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ববাহী ও তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। সদস্যদের এমন কোনো কাজ দেওয়া উচিত নয়, যাতে তারা নিজেদেরকে হেয় মনে করে।
- দলের সদস্যের মধ্যে উত্তম ও কার্যকর যোগাযোগ বজায় রাখতে হবে। সদস্যরা যেন একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন না হন।
- সদস্যদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের মধ্যে কাজ ভাগ করা উচিত। যে যে কাজের জন্য দক্ষ, তাকে সে কাজ করতে দিতে হবে। আর প্রত্যেক সদস্য যেন মনে করে, তার নিজের অংশটি দলের সামগ্রিক কাজে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
- দলের আকার ছোট রাখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ দলের আকার বড় হলে সদস্যদের দায়িত্ববোধ কমে যায়। একটি আদর্শ দলের সদস্যসংখ্যা কত হওয়া উচিত, তা নিয়ে মতভেদ আছে। অ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস আদর্শ দল তৈরিতে দুটো পিৎজার ওপর ভরসা করেন। ‘টু পিৎজা রুল’ নামে পরিচিত এই নিয়মে বলা হয়, যদি দুটো পিৎজা দিয়ে আপনার দলের সদস্যদের ঠিকমতো আপ্যায়ন করতে না পারেন, তাহলে আপনার দলের আকার আসলেই বড়। সাধারণত তিন থেকে নয়জনের সদস্যের একটি দলে সোশাল লোফিং কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- দল ও সদস্যদের কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকলে সদস্যরা কাজ করার অনুপ্রেরণা পায়।
- সদস্যদের জন্য কোনো পুরস্কার বা প্রেষণার ব্যবস্থা থাকলে, তারা উৎসাহের সঙ্গে কাজ করবে।