করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীনের সাফল্য অভূতপূর্ব। সারা বিশ্ব যখন করোনভাইরাসের মহামারি মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে তখন চীন সেটিকে ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল?
১. কার্যকর লকডাউন
উহান থেকে যখন এই ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে তখন জানুয়ারির ২৩ তারিখেই চীনের সরকার সেই এলাকাকে লকডাউন করে দেয়। জনসমাগম, স্কুল, কলেজ এমনকি পরিবহন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ শুরু করে সেদিন থেকেই। পরদিন পুরো হুবেই (Hubei) রাজ্যের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। খাদ্য এবং জরুরী স্বাস্থ্যসেবা বাদে অন্য প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দ্রুত বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৬ কোটি লোককে ঘর থেকে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয় জানুয়ারীর ২৪ তারিখেই।
জানুয়ারির ২৪ তারিখে করোনা আক্রান্তদের সেবা দেওয়ার জন্য ১০ দিনে হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয় চীন সরকার। ২৫ হাজার বর্গ মিটারের সেই হাসপাতালে ১০০০ শয্যা প্রস্তুত করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
২. আক্রান্তদের আলাদা করতে হবে
একই সাথে যাদের মধ্যেই করোনা সংক্রমণের ন্যূনতম লক্ষণ দেখা দিয়েছে তাদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নেওয়া হয়। এদেরকে জিমনেশিয়াম, স্টেডিয়াম, বড় হলকক্ষে আলাদা করে রাখা হয়। যারা কোনো কারণে রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদেরকেও কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।
লকডাউন এলাকার বাইরে প্রতিটি শহরে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখে, জনসমাগম হতে পারে এমন স্থানে সার্বজনীন তাপমাত্রা নিরীক্ষণ (Universal Temperature monitoring) ব্যবস্থা চালু করে। থার্মাল স্ক্যানারে কোনো ব্যক্তির দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলেই তাকে আলাদা করে নেওয়া হয়। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে সামান্য লক্ষণ দেখা দিয়েছে এমন ব্যক্তিদেরও বাছাই করা হয়। মাস্ক পরিধান এবং হাত ধোঁয়ার ব্যাপারেও কড়াকড়ি জারী করা হয়।
৩. প্রযুক্তির ব্যবহার
উপদ্রুত হতে পারে এমন এলাকায় লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে কোভিড-১৯ আছে কিনা সেই পরীক্ষা করা হয়। শনাক্তকৃত রোগীদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে চীন দ্রুতই করোনা মোকাবেলায় তাদের শক্ত প্রযুক্তি খাতকে বেঁছে নেয়। ভাইরাস নিয়ে গবেষণা, তার সম্পূর্ন জিনোম সিকোয়েন্স উন্মুক্ত করে দেয়। প্রচুর পরিমাণ প্রতিষ্ঠান এই ডাটা নিয়ে কাজ শুরু করে।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর বিগ ডাটাকে কাজে লাগিয়ে একটি বড় জনসংখ্যা থেকে সহজেই রোগীদের আলাদা করে নেওয়া যায়। চীনের টেক কোম্পানিগুলো মানুষদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘হেলথ রেটিং’ দেওয়া শুরু করে যা দেখে নির্ধারণ করা যায় ঐ লোকের কি কোয়ারেন্টিনে থাকা উচিত নাকি ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত। এ ধরনের সেবা প্রথমে হংঝু (Hangzhou) শহরে চালু হয় এবং তা ক্রমান্বয়ে দুইশো শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
চীনের মানুষকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে তাদের ভ্রমণ বিবরণী, স্বাস্থ্যের অবস্থা দিয়ে অনলাইন ফর্ম ফিলাপ বাধ্যতামূলক করা হয়। যেখানে তাদের সবাইকে তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে সবুজ, লাল আর হলুদ ‘কিউআর কোড’ দেওয়া হয়। লাল কিউআর কোড যাদের আসবে, তারা DingTalk এপ্লিকেশনের মাধ্যমে কোথায় যাচ্ছেন বলতে হবে, ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। বের হলেই পুলিশ পাকড়াও করবে।
হলুদ কিউআর যাদের তারাও থাকবেন সাত দিনের কোয়ারেন্টিনে। আর সবুজ যাদের তারা তাদের কিউআর কোড দেখিয়ে মাস্ক এবং অন্যান্য সতর্কতা নিয়ে চলাচল করতে পারবেন। ব্যস্ত শহরগুলোতে, শপিং মল, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকানে প্রবেশের মুখে তাপমাত্রা পরীক্ষার পাশাপাশি মোবাইলে কিউআর কোড পরীক্ষা করে ঢুকানো হয় মানুষকে।
চীন দীর্ঘদিন ধরেই ব্যস্ত রাস্তাঘাট, জনবহুল পার্ক এমনকি মলেও ক্যামেরার মাধ্যমে ফেসিয়াল রিকগনিশন নিয়ে কাজ করছিল। আসামী শনাক্ত থেকে শুরু করে সব কাজেই এই তথ্য ব্যবহার করে আসছে চীন।
চীনের উচ্চমানের ফেসিয়াল রিকগনিশন পদ্ধতি ভীড় থেকে মাস্ক না পরা ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম, এবং তাকে সতর্কবার্তা পৌঁছে দিতে পারে। একটি চাইনিজ প্রতিষ্ঠান মাস্ক ব্যবহারকারীদেরকেও ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে আলাদা করতে সক্ষম হয়, পাশাপাশি সেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পারে। পাশাপাশি চীন তাদের মানুষের চলাচল ঠেকাতে নববর্ষের ছুটি বাড়িয়ে দেয়।
৪. টেস্ট
চীনের প্রথম করোনাভাইরাস কেইসটি ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে যেটিকে উল্লেখ করা হয় রহস্যজনক সার্স-সদৃশ নিউমোনিয়া হিসেবে। এরপরই সারা বিশ্বে সেটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে বোঝা না গেলেও এটি হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানে ছড়িয়ে পড়ে। সেই দেশগুলোও মোটামুটি একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়। প্রচুর পরিমাণে সন্দেহভাজন মানুষকে টেস্ট করা শুরু করে, ১৯ মার্চ পর্যন্ত দেশটি প্রায় দুই লাখ নব্বই হাজার মানুষকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা জানতে টেস্ট করায়। এরমাঝে প্রতিদিন দশ হাজার টেস্ট করানো হয় বিনামূল্যে।
আক্রান্তদের তিনভাগে ভাগ করে সংকটাপন্নদের বিশেষায়িত হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে, আশঙ্কাজনক রোগীদেরকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে আর লক্ষণ আছে কিন্তু প্রকট হয়ে উঠেনি এমন রোগীদের নিজেদের ঘরেই কোয়ারেন্টাইন থাকার পরামর্শ দেয়। চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো এই পদ্ধতিতে করোনাকে প্রাথমিক মোকাবেলা করেছে। চীন শুরু থেকেই সামাজিক দূরত্বের উপর গুরুত্ব দিয়েছে, বিশেষ করে জনবহুল এলাকা, বাজার, রাস্তাঘাট বন্ধ করে ছুটি দীর্ঘায়িত করায় এটি ফলপ্রসূ হয়েছে।
৫. শক্তিশালী নজরদারী নেটওয়ার্ক
চীনের এই ভাইরাস মোকাবেলার পিছনে অন্যতম বড় অবদান রাষ্ট্রজুড়ে এর ব্যাপক নজরদারী নেটওয়ার্ক। এই নজরদারী নেটওয়ার্কের আওতায় থাকে প্রতিটি মানুষ, একজন ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা নজরদারীর আওতায় পড়বেই। পাশাপাশি চীনের বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো সরকারকে তথ্য দিতে বাধ্য।
আর এইসব কোম্পানিগুলোর ডাটা ভাণ্ডারে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের যাতায়াত, আর্থিক লেনদেনের তথ্য, ভ্রমণ ইতিহাসের যাবতীয় তথ্য আছে। চাইলেও একজন চীনা নাগরিক আক্রান্ত এলাকা থেকে এসে ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারবেন না। জ্বর বাধিয়েছেন, রাস্তায় বেরোলেই ক্যামেরা, থার্মাল ডিটেক্টর ধরে ফেলবে। আপনার চেহারা সংরক্ষিত আছে ডাটাবেজে সেখান থেকে খুঁজে বের করে ডাক্তারই ধরে নিয়ে যাবে কোয়ারেন্টিনে। এছাড়াও রয়েছে রোবট নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা, বিগ ডাটা এনালাইসিস, এভাবে চীন সরকারের এই ব্যাপক নজরদারী এবং কার্যকর লকডাউন চীনকে বড় দুর্যোগকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
৬. সার্সের অভিজ্ঞতা এবং চীনের দক্ষ স্বাস্থ্য খাতের একসাথে ঝাপিয়ে পড়া
২০০৪ সালের সার্সের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই চীন ভাইরাল ফ্লু মোকাবেলায় গড়ে তুলেছিল বিশাল জনশক্তি, আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করা, কোয়ারেন্টিন করার জাতীয় পরিকল্পনা চীনের মাথায় ছিল আগে থেকেই। আর তাই সেই আক্রমণের পর থেকেই চীনের সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যখাতের গবেষণায় বিনিয়োগ করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, গবেষনায় গুরুত্ব দিয়েছে ব্যাপকভাবে।
ফলে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স, টেস্ট কিট তৈরি, মোকাবেলা, দক্ষ ডাক্তারদের সম্মিলিত প্রয়াস পাওয়া গেছে। সারাদেশ থেকে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, পেশাদারদের একত্র করে তাদের বোর্ড গঠন করে এবং কিছুক্ষেত্রে টেলিমেডিসিনের সহায়তা নিয়ে এই মহামারিকে মোকাবেলা সম্ভব হয়েছে। জ্যাক মা ফাউন্ডেশনের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ডাক্তারদের সাথে সরাসরি কাজ করেছে। এক হাসপাতালের রোগীকে সারিয়ে তোলার পর অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে অন্য হাসপাতালে, দ্রুত সময়ে তা পৌঁছে দিতে ডাক্তারদের নেটওয়ার্কিং, অভিজ্ঞতা বিনিময়ে কাজ করেছে প্রযুক্তি খাত। বাসায় থাকা রোগীদের কাছে পৌঁছে গেছে টেলিমেডিসিনের পরামর্শ। কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগীদের দেওয়া হয়েছে ভিডিও কনফারেন্স আর এপ্লিকেশনের মাধ্যমেই সেবা।
তবে পশ্চিমা বিশ্বে এই নজরদারীর ব্যাপারটি বেশ কঠিন, নাগরিকদের স্বাধীনতা সেখানে বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য সরাসরি সরকারকে দিতে বাধ্য নয়। নাগরিকের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন, স্বাস্থ্য কিংবা ভ্রমণের ইতিহাস সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সুতরাং চীন এই ভাইরাস মোকাবেলায় একটু বেশি সুবিধা পেয়েছে যেটি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নেই। তবে প্রযুক্তি খাতে পশ্চিমা বিশ্ব পিছিয়ে নেই, শুধু একটু অভিজ্ঞতার বিনিময় থামিয়ে দিতে পারে কোভিড-১৯কে।