বুড়িগঙ্গা নদীকে ঢাকার ঐতিহ্য বললে বোধকরি একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। স্কুল-কলেজের রচনায় একটি বাক্যের অবতারণা অতি সাধারণ ছিল- “ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত”। সে জমানার বুড়িগঙ্গা আর আজকের জমানার বুড়িগঙ্গাকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। আজ ঢাকা শহরে দূষণের আরেক নাম বুড়িগঙ্গা। পরিবেশ দূষণ বলতে সামগ্রিকভাবে আমরা যা নির্দেশ করে থাকি কিংবা যা আলোচনা করে থাকি, তার মাঝে পৃথকভাবে নদী দূষণ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে বৈকি।
গ্রিন হাউজ গ্যাস আর পরিবেশ দূষণ সরাসরি যুক্ত। গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণে নদী দূষণ কতটা ভূমিকা রাখছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নদী পরিষ্কার কীভাবে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।
চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অভ হংকং-এর জিওগ্রাফি অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ডেরিক ইয়ুক ফো লাই। নদী বিষয়ক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে তিনি বলেন,
গ্রিন হাউজ গ্যাস বলতে মূলত আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, এবং নাইট্রাস অক্সাইডকে বিবেচনা করে থাকি। দূষিত নদী থেকে সংগৃহীত পানির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, হংকংয়ের নদীগুলোতে এই তিনটি গ্যাসের পরিমাণ অত্যধিক। আশ্চর্যজনকভাবে একাধিক নমুনায় বায়ুতে এসব গ্যাসের উপস্থিতির চেয়ে ৪.৫ গুণ বেশি পাওয়া গেছে নদীর পানিতে।
অধ্যাপক লাইয়ের গবেষণা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নদী দূষণ সরাসরি ভূমিকা রাখছে। এ গবেষণা প্রকল্পের অধীনে হংকংয়ের যতগুলো নদীকে তালিকাবদ্ধ করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাদের প্রতিটির ক্ষেত্রেই প্রায় একই চিত্র পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ, বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের উপস্থিতির একটা বিশাল অংশের উৎস দূষিত জলাশয়।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের অত্যধিক উপস্থিতির পেছনে সাধারণ কিছু কারণ ছাড়াও নদীর দূষিত পানি থেকে আগত গ্যাসের ভূমিকাও আছে। গবেষণার তথ্য থেকে সুপারিশ করা হয়, নদীর পানির গুণগত বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে নদী তীরবর্তী বাস্তুসংস্থানের উন্নতি ঘটবে, যার কারণে পরিবেশ দূষণের হারও হ্রাস পাবে।
নদী দূষণের একাধিক কারণ রয়েছে। নদীর পাশেই গবাদি পশুর খামার গড়ে তুললে সেখাসে বসবাসরত প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ প্রায় সময় নদীতে গিয়ে পড়ে। বিভিন্ন পুরনো ভবনের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার নকশা এতটাই মান্ধাতা আমলের, যার কারণে দূষিত পানি সরাসরি নদীর পানিতে মেশে। বিভিন্ন স্থাপনায়, কলকারখানায়, নগরে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ, এবং দুর্বল যে শোধনের আগেই সেসব বর্জ্যের জায়গা হচ্ছে নদীর পানিতে। এমনসব কারণে হংকংয়ের অত্যধিক মাত্রায় দূষিত নদীগুলোতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস- তিনটির উপস্থিতি সাধারণ নদীগুলোর চেয়ে যথাক্রমে ২.২, ১.৫, ৪.০ গুণ বেশি ছিল।
বেলজিয়ামের ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টোরাল গবেষক লং টুয়ান হাওয়ের নেতৃত্বে নদী দূষণ সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়। প্রকল্প শেষে দেখা যায়, দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে নদীসমূহের গ্লোবাল ওয়ার্মিং পটেনশিয়াল (GWP) দশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। নদীর পানির গুণমান যখন গ্রহণযোগ্য মাত্রা থেকে দূষিত মাত্রায় নেমে যায়, তখন পানিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেনের পরিমাণ শতকরা ১০ গুণ এবং নাইট্রাস অক্সাইডের মাত্রা শতকরা ১৫ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে।
গ্রিন হাউজ গ্যাসগুলো সাধারণত কার্বন কিংবা নাইট্রোজেন ভিত্তিক হয়ে থাকে। কোনো বিশুদ্ধ নদীতে যখন মানববর্জ্য, পয়োবর্জ্য, গবাদি পশুর খামারের উচ্ছিষ্ট, কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি এসে মিশে, তখন নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রে বসবাসরত অণুজীবের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে এই বর্জ্যে থাকা নাইট্রোজেন ও কার্বনগুলো গ্রিন হাউজ গ্যাসে রূপান্তরিত হয়। বিশেষত কোনো জলাশয়ে দূষণের কারণে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পেলে অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়াগুলো (যাদের দেহে অবাত শ্বসন ঘটে) বিভিন্ন জৈব পদার্থ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং মিথেনের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে ডিনাইট্রিফায়িং ব্যাকটেরিয়াগুলো নাইট্রেটকে নাইট্রাস অক্সাইডে পরিণত করে।
বিভিন্ন দেশে পরিচালিত একাধিক গবেষণা থেকে এতটুকু অন্তত দাবি করা যায়, পরিবেশ দূষণে সাধারণভাবে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের পাশাপাশি এখন থেকে নদী দূষণের প্রতিও দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। নদী দূষণের কথা যদি আলোচনার বাইরে রাখাও হয়, তাতেও প্রচলিত নানারকমের উৎস থেকে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে যে ভয়ংকর আকারে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, সেটিরই উল্লেখযোগ্য কোনো সমাধান আমরা পাইনি এখন পর্যন্ত। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিজ্ঞানীদের সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে হবে।
ফিনল্যান্ডের অ্যালটো ইউনিভার্সিটির ওয়াটার অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট রিসার্চ গ্রুপের সদস্যরা ২০১১ সালে একটি জরিপ চালান। এ জরিপ মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ কোনো স্বাদু পানির জলাশয়ের তিন কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করেন। অত্যধিক নগরায়নের ফলে গ্রামের সংখ্যা এবং আয়তন, দু’টোই কমছে। অন্যদিকে নগরাঞ্চলের বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিকভাবেই নতুন বসতি স্থাপন, কলকারখানার বৃদ্ধি ইত্যাদি সবকিছু গড়ে উঠছে জলাশয়ের আশেপাশে। জনবসতি ক্রমেই জলাশয়ের অধিক নিকটবর্তী হচ্ছে। শহরাঞ্চলের ক্রমশ বৃদ্ধির দরুন মিউনিসিপ্যাল বর্জ্যের শতকরা ৮০ ভাগ সরাসরি কোনো না কোনো জলাশয়ে গিয়ে বিমুক্ত হচ্ছে। এসব বর্জ্যের অধিকাংশই আসে অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য, কৃষিজ পণ্যের (সার, কীটনাশক) উচ্ছিষ্ট, এবং সঞ্চিত পলি থেকে।
পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, গ্রিন হাউজ গ্যাস সমস্যা যা-ই বলা হোক না কেন, এসবের সমাধানে নদীকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা এখন অবশ্য কর্তব্য। নদী পরিষ্কারের মাধ্যমে নদীর পানির বিশুদ্ধতা স্বাভাবিক মাত্রার যত কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তত কম গ্রিন হাউজ গ্যাস পাওয়া যাবে। নদীর পানিতে দূষণের মাত্রা সহনীয় হলে দূষক দ্রব্যের কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি গাস উৎপাদনের সুযোগটুকুই থাকবে না। গবেষণাও বলছে, ইতোমধ্যে দূষিত নদীর পানি পরিষ্কারের পর পানিতে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
তাহলে নদী পরিষ্কারই কি একমাত্র সমাধান? একটু সূক্ষ্মভাবে ভাবলেই বোঝা যাবে, পৃথিবীতে যে পরিমাণ নদী রয়েছে সেগুলোকে দু’দিন পরপর পরিষ্কার করা কিছুটা হলেও স্থূল সমাধান। কারণ এতে করে একদিকে পরোক্ষভাবে দূষণকে আরও উৎসাহিত করা হবে। যতই দূষিত হোক নদী, পরিষ্কারের পথ তো খোলা রয়েছেই। এর চেয়েও বরং আরও টেকসই সমাধানের পথ হচ্ছে, সর্বনিম্ন দূষণের দিকে নজর দেওয়া। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম- এ মূলনীতি সামনে রেখে জীবনযাত্রা চালিয়ে নিলে সবকিছুই সহজতর হতে বাধ্য।