এইতো ১২ দিন আগের কথা। রুমি-রোমেলের (ছদ্মনাম) ঘর আলো করে জন্ম নিল একটা ছোট্ট ফুটফুটে শিশু। পরিবারে হৈ হৈ ব্যাপার নবজাতকের জন্ম উপলক্ষে। কিন্তু এতো আনন্দের মাঝে একজন কেমন যেন নীরব, কেমন যেন বিরক্ত, চেহারায় হতাশা প্রবল। সে আর কেউ নয়, নবজাতক সন্তানের জন্মদানকারী মা, রুমি! বাচ্চাকে খাওয়ানো তো দূরের কথা, কোলে পর্যন্ত নেন না তিনি। এর ভেতর একদিন ফুটফুটে বাচ্চাটিকে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছেন। ভাগ্যিস তখন কাজের মেয়েটা দেখে ফেলে বাঁচিয়েছিল বাচ্চাটিকে!
সাধারণত বাচ্চা জন্মদানের প্রথম দু’সপ্তাহের মধ্যে মায়ের ভেতর এরকম অস্বাভাবিক আচরণ, হতাশা ইত্যাদি এক মারাত্মক মানসিক রোগের লক্ষণ। একে পোস্টপারটাম সাইকোসিস বা প্রসব-পরবর্তী মনোব্যাধি বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগকে মাতৃকালীন ডিপ্রেশনের সাথে তুলনা করলেও দুটি বিষয় এক নয়। পোস্টপারটাম সাইকোসিসকে এক প্রকারের বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলা চলে।
খুবই কমসংখ্যক মহিলা যারা মা হয়েছেন তাদের ভেতর এই মনোব্যাধি দেখা যায়। নগণ্য হলেও মারাত্মক এই মানসিক রোগে নতুন মা হওয়া ১,০০০ জনের ১/২ জনের মধ্যে দেখা যায় (২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী)।
পোস্টপারটাম সাইকোসিসের লক্ষণ
পোস্টপারটাম সাইকোসিস রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হয়। সাধারণত বাচ্চা হবার দু’সপ্তাহ পর লক্ষণগুলো শুরু হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চা জন্মের ২-৩ দিন পরেই দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে খারাপ লক্ষণগুলো ২ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা যায়। আর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে প্রায় ৬ মাস লেগে যায়। লক্ষণগুলো নিম্নরূপ,
- হঠাৎ করেই বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলার চিন্তা বা যেভাবেই হোক ক্ষতি করার ইচ্ছা মাথায় আসবে।
- বিভ্রম (Delusion)- এমন কিছু বিশ্বাস করা শুরু করবে, যার বাস্তবতা নেই ।
- হ্যালুসিনেশন- এমন কিছু দেখবে বা শুনবে, যা আসলে নেই।
- বাচ্চার সাথে আবেগীয় কোনো বন্ধন তৈরি করতে পারবে না।
- খুব দ্রুত মুড পরিবর্তন হওয়া।
- চেহারার কোনো আবেগের অভিব্যক্তি ঘটবে না।
- আগের মতো ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভব করবে না।
- সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করবে।
- ক্ষোভ এবং হঠাৎ রেগে যাওয়া।
- আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কারণ তিনি ভাবেন অন্যদের বা বাচ্চার তাকে দরকার নেই।
- ঘুমে ব্যাঘাত। স্বাভাবিক কারণে মায়েদের ঘুমে যেমন ব্যাঘাত ঘটে তেমনটা নয়।
- অকারণেই ভয় পাওয়া
- অস্থিরতা
- ডিপ্রেশনে থাকা; কারও সাথে কথা বলবে না, অকারণেই কাঁদবে বা উদ্বিগ্ন থাকবে।
রিস্ক ফ্যাক্টর
যেসব মায়েদের আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশের ক্ষেত্রে পোস্টপারটাম সাইকোসিস দেখা দিতে পারে। আর যেসব মায়েদের বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকে, তাদের প্রায় ৩৭ শতাংশের ক্ষেত্রে পোস্টপারটাম সাইকোসিস মারাত্মক রূপ নেয়। তবে যাদের কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল না তবে তাদের বংশের কারও যেমন মা বা বোনের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৩% সম্ভাবনা রয়েছে। ১৬নং ক্রোমোজোম জোড়ায় নির্দিষ্ট এক জিনের মিউটেশনের কারণে বংশগতভাবে এটি আসতে পারে।
তবে অদ্ভুত হলেও সত্যি, আক্রান্ত মায়েদের অর্ধেকের ক্ষেত্রেই কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে না। এসব ক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসবের সময়ের জটিলতা বা সিজারিয়ান সেকশন, বাচ্চা ছেলে নাকি মেয়ে, কতদিন ধরে গর্ভবতী ছিলেন, ওষুধের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলোই মুখ্য। এছাড়াও রয়েছে আরও না জানা অনেক কারণ।
কেন হয়?
এখনও পোস্টপারটাম সাইকোসিসের নির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করা সম্ভব হয়নি। তবে যেগুলোকে এর জন্য দায়ী করা হয় সেগুলো হলো,
- বাচ্চা জন্মের সময় হঠাৎ হরমোন নিঃসরণে যে পরিবর্তন আসে তার প্রভাব।
- নিজের কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে, বিশেষ করে বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হয়ে থাকলে।
- পরিবারের কোনো সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে, বিশেষ করে পোস্টপারটাম সাইকোসিস থাকলে।
- বাচ্চা প্রসবের সময় কোনো ভীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকলে, যেমন- প্রচন্ড বেদনা বা দীর্ঘ গর্ভকালীন অবস্থা ইত্যাদি।
- আশানুরূপ বাচ্চা না হওয়া (গায়ের রঙ বা লিঙ্গ ইত্যাদি)।
- পূর্বে গর্ভধারণের সময় হতেই পোস্টপারটাম সাইকোসিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে।
কীভাবে এর ঝুঁকি কমানো যায়?
যারা হাই-রিস্কে রয়েছেন তাদেরকে গর্ভধারণের শুরু থেকেই বিশেষ যত্নে রাখতে হবে। গাইনী ডাক্তারের পাশাপাশি নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শেও রাখতে হবে।
বাচ্চা জন্মদানের আগেই নিজেকে বুঝুন এবং পরিবারের সকলের সাথে কথা বলুন। বাচ্চাটি আপনি এবং আপনার পরিবার আসলেই চাচ্ছেন কিনা, চাইলে তাকে সুন্দর পৃথিবীতে আনতে এবং লালন-পালনে পুরোপুরি প্রস্তুত কিনা এবং গর্ভকালীন মায়ের সেবা সুনিশ্চিত কিনা- বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে নিতে হবে।
মোট কথা, পরিবার পরিজনকে সচেতন থাকতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত।
চিকিৎসা
পোস্টপারটাম সাইকোসিসের ক্ষেত্রে খুব দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা জরুরি। মারাত্মক মানসিক রোগ হওয়া সত্ত্বেও এটি সারিয়ে তোলা সম্ভব। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করাও লাগতে পারে। থাকতে হতে পারে ওষুধ গ্রহণের কড়া নিয়মের মধ্যে।
মেডিকেশন
তিন ধরনের ওষুধের যেকোনো একটি বা দুটি বা সবক’টি লাগতে পারে:
- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা বিষন্নতারোধক ওষুধ (ডিপ্রেশন লেভেল কমাতে)
- অ্যান্টিসাইকোটিক (ম্যানিয়া বা বিভ্রম এবং হ্যালুসিনেশন হলে)
- মুড স্ট্যাবিলাইজার (ঘনঘন মুড পরিবর্তন হওয়া কমাতে)
সাইকোলজিক্যাল থেরাপি
ওষুধের পাশাপাশি থেরাপিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আমাদের চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি এবং আচরণ একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত, তাই নেগেটিভ চিন্তা এবং অনুভূতির সাথে নেগেটিভ আচরণের দুষ্টচক্র চলতেই থাকে। মনোবিজ্ঞানীগণ এক্ষেত্রে তাই কোগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি দিয়ে থাকেন। এই থেরাপিতে রোগীকে তার সমস্যা সমাধানের জন্য আচরণ এবং চিন্তার পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। রোগী ইতিবাচক উপায়ে চিন্তাগুলোকে ছোট ছোট করে বুঝতে সাহায্য করে যাতে রোগী নিজেই নিজের নেতিবাচক সমস্যার সমাধানে আসতে পারেন। সাধারণত সপ্তাহে দু’বার থেরাপিস্ট এ থেরাপি দিয়ে থাকেন।
ইলেক্ট্রো-কনভালসিভ থেরাপি
এটির ব্যবহার নেই বললেই চলে। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপের দিকে গিয়ে থাকলে ব্যবহার করা হতে পারে। তবে বাংলাদেশে এর ব্যবহার একেবারেই নেই।
সহযোগিতা
চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা খুবই দরকারি একজন পোস্টপারটাম সাইকোসিসে আক্রান্ত মায়ের জন্য। কথা বলতে পারেন আক্রান্ত অন্য মায়েদের সাথে। আর আপনার সঙ্গীর আচরণে যদি পোস্টপারটাম সাইকোসিসের লক্ষণ দেখতে পান তাহলে-
- অহেতুক কথা কাটাকাটিতে না গিয়ে শান্ত থাকুন এবং সাপোর্ট দিন।
- বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করুন।
- ঘুমাতে দিন যতটা চান।
- বাচ্চার দেখাশোনা করায় এবং রাতের বেলা খাওয়ানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহায্য করুন।
- বাসায় শান্ত পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
- এসব কিছুর পাশাপাশি নিজের দিকেও খেয়াল রাখুন।
চিকিৎসা গ্রহণ করলে মারাত্মক লক্ষণগুলো ২ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে চলে যায় এবং সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভে ৬-১২ মাস লেগে যেতে পারে। যত দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে সুস্থতা আসবে তত দ্রুত।
মা এবং সন্তানের স্বর্গীয় সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে সচেতন হতে হবে সকলকে। বাংলাদেশে এখনও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে অবহেলা করানো হয়। এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে পোস্টপারটামে আক্রান্ত মাকে ‘জিনের আছর’ বলা হয় এবং নানা কুসংস্কার মানা হয়। এতে মৃত্যু ঘটে অনেক মায়ের ও নবজাতকের। তাই পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতাই পারে মা ও সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।