যখন আপনি একা, আপনি কী চান আর কেন চান এই ধরনের চিন্তা-ভাবনাগুলোর দায়ভার কেবলমাত্র আপনার। কিন্তু যখন আপনি কোনো সম্পর্কে জড়াবেন, আপনার একা থাকাকালীন চিন্তা-ভাবনাগুলো সেসময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধরনের কাজ করি না। কিন্তু সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটি হলো, আমরা অনেকে বুঝতেই পারি না যে, মনের অজান্তে আমরা প্রতিনিয়ত সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি করতে পারে এমন ধরনের কাজ করে চলছি।
আমরা সবাই-ই ভুল করি, তবে সেগুলোর একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে। এখন যদি ক্রমাগত ভুল করে যেতেই থাকি অথবা সম্পর্কে দূরত্ব ও ভাঙ্গন সৃষ্টি করে এমন ধরনের অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ না করতে পারি, তবে একটা সময় সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য। আসলে সম্পর্ক কেবল এক অপরকে দামী দামী উপহার দেওয়া কিংবা লোক দেখানো ‘আইডিয়াল কাপল’ এর ভূমিকায় অভিনয় করে যাওয়া নয়। বরং একটি সম্পর্ক সুন্দর আর মাধুর্যমণ্ডিত তখন হবে, যখন একে অপরের প্রতি আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া আর বিশ্বাস এর জায়গাগুলো অটুট থাকবে।
সব সময় ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা
বর্তমান সময়ে স্মার্ট ফোনটাকে আমরা আমাদের জীবনের একটি অংশ বানিয়ে ফেলেছি। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থানের মতো এটিও জীবনধারণের একটি মৌলিক চাহিদায় রূপান্তরিত হয়েছে।
এটা সত্যি, কিছু কিছু সময় হয়তো ফোন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, কারণ কাজ অপেক্ষা করে থাকবে না আপনার জন্য। কিন্তু যদি এমন হয়, আপনি সব সময় ফোনের পিছনেই পড়ে আছেন, তাহলে এটা খুব বাজেভাবে আপনার সঙ্গীর উপর প্রভাব ফেলবে এবং তাকে ভাবতে বাধ্য করবে যে, সে আপনার কাছে কাক্ষিত নয়। যখন দুজন একসাথে থাকবেন, চেষ্টা করবেন অন্য সবকিছু দূরে রেখে দুজন একান্তে সময় কাটাতে। মনে রাখবেন, সঙ্গীর সাথে সময় কাটানোর মুহূর্তে যদি আপনি আপনার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করেন, তাহলে সে নিজেকে উপেক্ষিত ও অবহেলিত ভাববে। যদি একান্তই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে সঙ্গীর কাছে অনুমতি নিন এবং তাকে বুঝিয়ে বলুন।
অন্যদের সাথে নিজেদের সম্পর্কের তুলনা করা
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তেমনই তাদের চিন্তা ভাবনাগুলোও আলাদা। ঠিক একইভাবে প্রতিটি সম্পর্কের ধরনও আলাদা। আপনি যদি প্রতিনিয়ত অন্যদের সাথে নিজেদের সম্পর্কের তুলনা করতে থাকেন, তাহলে সম্পর্কে বিতৃষ্ণা চলে আসতে বাধ্য। দুজন মানুষ একটি সম্পর্কে থাকার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, একজন আরেকজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। যখনই আপনি আপনার সঙ্গীকে কিংবা আপনাদের সম্পর্ককে সমালোচনায় নিয়ে আসবেন, তখন আপনার সঙ্গী ভাবতে শুরু করবে, আপনি তার সাথে সুখী নন। মনে রাখা দরকার, সবসময় আমরা বাইরে থেকে যা দেখি, তা সত্যি না-ও হতে পারে। প্রতিটা সম্পর্কেই টানাপোড়েন থাকে। তাই বাইরের চাকচিক্য দেখে নিজেদের ভেতরের শান্তি নষ্ট করবেন না।
সঙ্গীকে বাইরের লোকের সামনে হেয় করা
দুজন মানুষ যখন একসাথে পথ চলা শুরু করে, তখন একে অপরের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও অপারগতা ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে যায়, আর এটাই স্বাভাবিক। আপনারা একসাথে থাকা অবস্থায় একজন আরেকজনের দুর্বলতা নিয়ে মজা-ঠাট্টা করতে পারেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একগাদা বাইরের লোকের সামনে অথবা পরিচিত কেউ বা কাছের কোনো বন্ধুর সামনে যদি আপনি একইভাবে আপনার সঙ্গীর অসহায়ত্ব নিয়ে মজা করতে যান, সেটা হিতে বিপরীত হবে।
সঙ্গীর পরিবার নিয়ে সমালোচনা করা
শুধু একবার ভাবুন, কেউ আপনার বাবা-মাকে নিয়ে কটুকথা বলছে বা তাদের সমালোচনা করছে আপনার সামনেই, কেমন লাগবে আপনার? উত্তরটা আপনার মনের মধ্যে রাখুন। এখন আপনি যখন আপনার সঙ্গীর পরিবার নিয়ে কটুকথা বলবেন তখন যদি তাতে তিনি রেগে যান বা বিরক্ত হন, তবে এটা কি তিনি অন্যায় কিছু করলেন? এবার দুটো উত্তর একসাথে মিলিয়ে নিন।
আপনার সঙ্গীর পরিবারের কারও ব্যবহার বা কথায় যদি আপনি কষ্ট পান, তবে সেটা অবশ্যই আপনি আপনার সঙ্গীর সাথে আলোচনা করবেন। কিন্তু সেটা যেন সমালোচনা বা কটুকথার মধ্যে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। আপনার সঙ্গী হয়ত আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসেন, কিন্তু কোনো সন্তানই বাবা-মায়ের সমালোচনা শুনতে ভালোবাসবে না।
সঙ্গীর প্রতি পর্যাপ্ত ভালোবাসা প্রকাশ না করা
‘ভালোবাসা’, ছোট্ট চার অক্ষরের এই শব্দটাই সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের ও মানসিকতার দুজন মানুষকে একত্রে মায়া-মমতায় বেঁধে রাখে। সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া মানেই যদি ভাবেন আর নতুন করে ভালোবাসা দেখানোর প্রয়োজন নেই, তাহলে আপনি ভুল বিশ্বাস নিয়ে জীবনযাপন করছেন। এই যে অহরহ সব সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে, এর পেছনের একটি অন্যতম কারণ কিন্তু এই ভুল বিশ্বাস। যদি প্রতিটা মানুষ সম্পর্কের শুরুতে যে ভালোবাসা এবং একে অপরের প্রতি অসীম টান থাকে। সেগুলো যদি সম্পর্কে থাকার সময়েও প্রকাশ করতে পারতো, তাহলে সম্পর্কগুলো হয়তো হুট করেই শেষ হয়ে যেতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পর্কে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে যা পাওয়া যায় তা হলো, একে অপরের প্রতি ভালোবাসাহীনতার অনুভূতি। সম্পর্ক প্রাণবন্ত রাখতে মাঝেমধ্যে সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা জাহির করতে ভুলবেন না।
ঘরের ঝগড়া পরকে জানানো
কোন সম্পর্কে ঝগড়া হয় না বলুন? যেখানে নিজের বাবা-মায়ের সাথে মতের মিল না হওয়ার কারণে মনোমালিন্য হয়, সেখানে আপনার সঙ্গীর সাথে মতের মিল বা অন্য কোনো কারণে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হবে না, এটা অসম্ভব। সম্পর্কে থাকার সময়ে ঝগড়া হবে, মান-অভিমান হবে আর এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেই মান-অভিমান যদি আপনি ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন, তাহলেই বিপদ। একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন সবসময়, যতক্ষণ ঝগড়া বা মান-অভিমান আপনাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, ততক্ষণ সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ আপনাদের নিজেদের হাতে থাকবে। আর যখনই পরিবার বাইরের কারও সামনে যদি এসব উঠে আসে, ঠিক তখনই সম্পর্কের কোমল সুতোটা কিন্তু তৃতীয় পক্ষের হাতে চলে যাবে।
সঙ্গীকে আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা
এই পৃথিবীতে সর্বগুণ সম্পন্ন মানুষ খুঁজতে যাওয়া বোকামি। কারণ কেউ ভুল ত্রুটির বাইরে নয়, সবারই কোনো না কোনো দুর্বল দিক থাকে। সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টিকারী সবচেয়ে ভয়ানক অভ্যাসটি হলো, সঙ্গীকে এমন কিছুতে পরিবর্তনের চেষ্টা করা যা আসলে সে নয়ই। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে আপনি যাকে আপনার সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সেই তাকেই আপনি পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন, ব্যাপারটা হাস্যকর নয়? হ্যাঁ, হয়তো আপনি চাপ দিয়ে বা আবেগতাড়িত করে তাকে নিজের ইচ্ছেমত করে নিতে পারবেন কিন্তু সেটা সাময়িক সময়ের জন্য। আর সেই অল্প সময়ের জন্যই আপনি খুব সহজেই আপনার সঙ্গীকে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, সে যা তাতে আপনি সন্তুষ্ট নন। একটা সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরাতে আপনার এই আচরণই কি যথেষ্ট নয়?
অতিরিক্ত সন্দেহবাতিক স্বভাব
সম্পর্কের বুনিয়াদ হচ্ছে বিশ্বাস আর আস্থা। সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস, আস্থা আর শ্রদ্ধা বজার রাখুন। আপনার অতিরিক্ত সন্দেহবাতিক স্বভাব সম্পর্কে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে পারুক বা না-ই পারুক, সম্পর্কে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে পারবে এই নিশ্চয়তা শতভাগ। যদি সঙ্গীর আচরণ বা কাজ আপনার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে, তাহলে সরাসরি কথা বলা উত্তম, কমপক্ষে আপনার সঙ্গীকে বলার সুযোগ দিন।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ না করা
একটি সম্পর্ক নষ্ট করতে মৌনতাই যথেষ্ট। দিনের পর দিন দুজন মানুষ একসাথে থাকছেন, কিন্তু কেউ কারও মনের খবর রাখেন না, এটা আদৌও কি কোনো সুস্থ সম্পর্ক? আপনার সঙ্গীর আচরণ বা কোনো কাজ আপনার পছন্দ হচ্ছে আর আপনি সেটা মনের মধ্যে পুষে রেখে ভাবছেন, আপনার সঙ্গী কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির মাধ্যমে আপনার মনের কথা জানবে এবং নিজেকে শোধরাবে!
আপনার খারাপ লাগাগুলোকে মনের মধ্যে জমাট বাঁধতে দেবেন না। আপনি চুপ করে না থেকে যদি নিজের অনুভূতি সঙ্গীর সাথে ভাগাভগি করেন, তাহলে সবটা স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সবটা নিজের মধ্যে আটকে রাখলে কেবল দূরত্বই বাড়ে।
আপনি ক্ষমা করতে জানেন না
জীবনে চলার পথে ভুল সবাই করে। ভুল থেকেই মানুষ শেখে, কিন্তু আপনি যদি আপনার সঙ্গীকে ভুল থেকে শেখার সুযোগটাই না দেন, তাহলে সম্পর্ক টিকে থাকা অসম্ভব। আগে ক্ষমা করতে শিখুন, আজ আপনি ক্ষমা করলে, কাল আপনার কোনো অপরাধে সে আপনাকে ক্ষমা করবে। এভাবেই তো সম্পর্ক টিকে থাকবে।
আপনার অতিরিক্ত অভিযোগ করা স্বভাব
যা-ই ঘটুক না কেন, তার সম্পূর্ণ দায়ভার আপনার। অনেক সময় দোষটা আপনার সঙ্গীর উপর চাপিয়ে দিন, কোনো কিছু খারাপ ঘটেছে মানেই সব দোষ আপনার সঙ্গীর! আপনি তো কখনো কোনো ভালো কাজের বাহবা দিতে জানেনই না, উল্টো সব সময় দোষ খুঁজে বেড়ান। যদি এসব অভ্যাস ত্যাগ না করতে পারেন তাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল। আর যদি কোনোভাবে সম্পর্ক টিকে থাকেও, সেই সম্পর্কে কোনো সম্মানের জায়গা থাকবে না আপনার জন্য।
‘ভালোবাসা একদিনের নয়, ভালোবাসা চিরদিনের!’ কিন্তু এই কথাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে অহরহ সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে দেখি আমরা। ভাগ্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে গেলে পরস্পরের বোঝাপড়া এবং ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা খুব দরকার। সম্পর্কে একজন আরেকজনকে কোণঠাসা করে বেশিদিন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।