আমরা, সভ্য সুশীল সমাজের অধিবাসীগণ যখন নির্বিচারে বন-জঙ্গল উড়িয়ে দিয়ে দিব্যি সুখে দিন কাটাচ্ছি, তখন ফরিদপুরের এক সাধারণ রিকশাচালক সামাদ শেখ ওরফে গাছ সামাদ কীভাবে কোথায় একটি গাছ লাগানো যায়, সে চিন্তা করছেন। আমাদের বড় বড় রাজনীতিবিদগণ যখন একের পর এক ভয়াবহ সমরাস্ত্র তৈরি করে পৃথিবীকে ধুলিসাৎ করার পরিকল্পনা করছেন, তখন আসামের এক মহিষপালক যাদব পায়েং ভাবছেন, কীভাবে লাগানো গাছগুলোকে পোকামাকড় এবং মানুষের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
আজ আমরা দেখবো গাছ সামাদ এবং যাদব পায়েংদের মতো সাধারণ মানুষগুলো তিলে তিলে কত অসাধারণ কিছু করে ফেলতে পারেন।
গাছ সামাদ, একজন রিকশাচালকের গল্প
গাছ সামাদের প্রকৃত নাম আবদুল সামাদ শেখ। ফরিদপুর জেলা শহরে তার জন্ম, পেশায় একজন রিকশাচালক। সারাদিন রিকশা চালিয়ে প্রায় ১০০ টাকা আয় করতেন। আর দশজন শ্রমজীবী মানুষের মতোই দিন আনে দিন খায় অবস্থা। টাকা পেয়ে সবাই যখন আগে বাজারে যেত, সামাদ শেখ তখন নার্সারিতে যেতেন। উদ্দেশ্য, গাছের চারা কেনা। প্রতিদিন অন্তত একটি হলেও চারা কিনতেন তিনি। চারা কেনার পর বাকি যে টাকা থাকতো, তা দিয়ে পরিবারের জন্য চাল-ডাল কিনতেন। এমন অনেক দিন গিয়েছে, সামাদ শেখের পরিবারে ভাত জোটেনি। কিন্তু একটি চারা সামাদ শেখ ঠিকই কিনেছেন। মাঝে মাঝে স্ত্রী জরিনা বেগমের নিষেধ সত্ত্বেও সামাদ শেখ গাছ লাগিয়ে গিয়েছেন প্রতিদিন।
১২ বছর বয়স থেকে প্রকৃতিকে ভালোবেসে, গাছপালা, পশু-পাখিকে ভালোবেসে গাছ লাগানো শুরু করেছেন। সেই থেকে আমৃত্যু প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে গাছ লাগিয়েছেন তিনি। দিনে একটি করে গাছ না লাগালে সামাদ শেখ ঘুমুতে পারতেন না। এমনই নেশা, এমনি ভালোবাসা তার গাছের জন্য। শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি সামাদ শেখ, গাছের নিয়মিত পরিচর্যাও করেছেন। পানি এবং জৈব সার দিয়ে গাছগুলোকে একদম নিজের সন্তানদের মতো আদরে বেড়ে তুলেছেন। চারাগাছ যাতে গরু-ছাগলে খেতে না পারে, তাই গাছের চারপাশে বেড়া লাগিয়ে দিতেন তিনি।
সামাদ শেখের নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। ফরিদপুর ডেপুটি কমিশনারের অফিসের একটি জমিতে পরিবার নিয়ে থাকতেন। তাহলে গাছ লাগাতেন কোথায়? তিনি সাধারণত সরকারি জমিতে গাছ লাগাতেন, যাতে কেউ বিনা অজুহাতে গাছ কাটতে না পারে। ১২ বছর বয়স থেকে গাছ লাগানো শুরু করে জীবদ্দশায় কমপক্ষে ১৭,৫৩২টি গাছ লাগিয়েছেন তিনি!
ফরিদপুর শহরের অনেক রাস্তায় আছে তার লাগানো গাছ। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাগিয়েছেন কাঁঠাল গাছ। কারণ কাঁঠাল ছিল সামাদ শেখের অত্যন্ত পছন্দের একটি ফল। গাছ পাগল এই মানুষটার কয়েকটা গল্প শোনাই। তাহলেই বুঝবেন কেন তাকে ‘গাছপাগল’ বলা হতো।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেয়া হয় তাকে। সেদিন সামাদ শেখকে ঢাকায় আসতে হয় বলে তিনি গাছ লাগাতে পারেননি। মনের এই দুঃখের কথা তিনি জানান পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে। সম্পাদক সাহেব তার দুঃখ দূর করতে রাতেই একটি চারা নিয়ে আসেন সংবর্ধনাস্থলে।
শারিরিক অবস্থার অবনতি হলে এ বছরের ১লা জুলাই তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকালে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দেখা গেল, সামাদ শেখ হাসপাতালের চত্বরে একটি গাছ লাগিয়েছেন এবং তাতে পানি দিচ্ছেন। গাছপাগল এই মানুষটি এ বছরের ১২ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
একা হাতে একটি বিশাল বনভূমি তৈরি করেছেন যে মানুষটি
১৯৭৯ সালের কথা। সদ্য মেট্রিক পাস করা ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে জেগে ওঠা একটি চরে দাঁড়িয়ে আছে। চরের মাটিতে ছড়িয়ে আছে শত শত মৃত সাপ। বানের জলে ভেসে আসা সাপগুলো চরে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সদ্য জেগে ওঠা বিরান সেই চরের বালি সূর্যের তাপে তেতে ওঠায় সাপগুলো মারা যায়। সে বছর আসামে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বানের জলে অনেক বন্য প্রাণী মারা গিয়েছে, নয়তো হয়েছে বাস্তহারা। ব্রহ্মপুত্র তখন বেশ আগ্রাসী নদী। এ কূল ভেঙে ও কূল গড়ে, চর জাগলে ভেসে যায়। ফলে চরগুলোর মাটি আলগা হয়ে পানির স্রোতে ভেসে যেত। এ কারণে কোনো উদ্ভিদ জন্মাতো না সেখানে।
বন্যপ্রাণীদের এই ভয়াবহ অবস্থা সেই কিশোরকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। মনে মনে এসব প্রাণীর জন্য একটি অভয়ারণ্য তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল সে। এই সিদ্ধান্তই তার জীবনটাকে আমূলে বদলে দিল। এজন্য ঘর ছাড়তে হলো, ছাড়তে হলো গ্রাম। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে সে শুরু করলো গাছ লাগানো। বিশাল সেই বিরানভূমিতে একা হাতে গাছ লাগিয়ে রীতিমতো একটি বনভূমি তৈরি করে ফেলল সে। তার সৃষ্ট এই বন ভারতের জাতীয় বনের প্রায় দ্বিগুণ। ৫৫০ হেক্টরের বিশাল এই বনভূমিতে বিচরণ করে চিতাবাঘ, গণ্ডার, ১০০ এর বেশি হরিণ, বাঁদর আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। প্রতি বছর প্রায় ১০০ হাতির একটি দল এই বনভূমিতে বিচরণ করতে আসে, বছরের ৬ মাস সময় এখানেই বাস করে তারা।
১৬ বছর বয়সী সেই কিশোর যাদব পায়েং আজ ৫৪ বছর বয়সী একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। যাদব পায়েং-এর জন্ম আসামের জোরহাট উপজেলার মিশিং সম্প্রদায়ে। পুরো নাম যাদব মোলাই পায়েং। সবাই তাকে মোলাই বলে ডাকে। তার নামানুসারে বনের নামকরণ করা হয় ‘মোলাই কাথোনি’ অর্থাৎ মোলাইয়ের ঘর। বর্তমানে যাদব তার পরিবার নিয়ে মোলায় কাথোনিতেই বাস করেন। প্রায় ৫০টির মতো গরু-মহিষ আছে তার। এদের দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন আর বনের দেখাশোনা করেন যাদব।
মোলাই নিয়মিত গাছের যত্ন করেন, পানি দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত মাটিতে পিঁপড়া, কেঁচো ইত্যাদি পোকামাকড় ছেড়ে দেন। এতে মাটি নরম হয় এবং এসব পোকামাকড়ের দেহ নিঃসৃত রাসায়নিক উপাদান গাছের বৃদ্ধির জন্য ভালো। প্রতিদিন বনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে দেখাশোনা করেন তিনি। কোন গাছের কী অবস্থা, কোনো প্রাণী আহত হলো কিনা কিংবা বনের কোথাও কেউ গাছপালা কাটছে কিনা সব খবরই মোলাই রাখেন। এজন্য কোনোদিন কোনো আর্থিক সহায়তা তো দূরে থাক, উৎসাহটুকুও পাননি। বরং গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছেন অবহেলা। শুধু মাত্র উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই সৃষ্টি করেছেন এমন বনাঞ্চল।
বন যত বড় হচ্ছিলো, যাদব পায়েংকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছিলো। যেমন- মোলাই কাথোনিতে চরতে আসা হাতির দল গ্রামবাসীদের ক্ষেত খামার নষ্ট করে দিয়ে চলে যেত। এতে গ্রামবাসীরা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, তারা যাদবের বন উজাড় করে দেবে বলে হুমকি দিত। যাদব সেই হুমকিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে একটি বুদ্ধি বের করলেন। তিনি জানতেন, হাতি কলাগাছ পছন্দ করে। যাদব বেশি করে কলাগাছ লাগালেন বনে। ব্যস, হাতির দল কলাগাছ পেয়ে সন্তুষ্ট, তাই ক্ষেত খামারের দিকে পা বাড়ালো না তারা আর।
আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন যাদব, যার সমাধান আজ পর্যন্ত করতে পারেননি। সেটি হলো বনের গাছ কেটে ফেলা। যাদব ‘মোলাই কাথোনি’তে অনেক সেগুন ও মেহগনি গাছ লাগিয়েছিলেন। যার বাজার মূল্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। জানবেনই বা কীভাবে, বৃক্ষপ্রেমী মানুষের তো আর অর্থপ্রেম নেই। কিন্তু অর্থলোভী মানুষ জানে সেসব গাছের মূল্য। ফল যা হবার তাই হলো। প্রায়ই বনের গাছ কেটে নিয়ে যেতে চায় তারা। অর্থলোভী এই মানুষগুলো শুধু গাছ কেটে ক্ষান্ত হতো না, বন্যপ্রাণীদের উপরও হামলা করতো। খুব স্বাভাবিকভাবে এত বড় বন যাদবের একার হাতে রক্ষণাবেক্ষণ করা খুব কঠিন ছিল। তাই গাছ কাটা ও বন্যপ্রাণী হত্যার ব্যাপারে বন মন্ত্রণালয়কে জানান তিনি। তারা প্রথমে কর্ণপাত না করলেও পরবর্তীতে আরো কিছু দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে সেখানে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দিয়েছে।
যাদব পায়েংকে আবিস্কার করেছেন ভারতীয় ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার জিতু কালিতা। ২০১০ সালে ছবি তোলার জন্য মোলাই কাথোনির রুক্ষ চরে এসে পৌঁছান তিনি। চরে নেমেই খেয়াল করলেন, খানিকটা দূরে বেশ ঘন বন। তিনি ভাবলেন, এমন রুক্ষ চরে বন এল কোথা থেকে! তারপর ধীরে ধীরে আবিস্কার করলেন যাদবকে। পত্রিকায় আর্টিকেল লিখলেন যাদবকে নিয়ে। একটি ডকুমেন্টারিও তৈরি করলেন তাকে নিয়ে।
২২ শে এপ্রিল ২০১২ সালে, বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদব পায়েংকে একটি সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে তিনি বলেন, “আমার বন্ধুরা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, শহরে বাস করে। আমি আমার সাধ-স্বপ্ন সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি এই বনটার জন্য। আজ এই বন আমার ঘর। আজকের এই সংবর্ধনা, এই পুরস্কার আমার সম্পদ। আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একজন মানুষ।” ২০১৩ সালের অক্টোবরে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সুধির কুমার তাকে ‘ভারতের বনমানব’ (Forest Man of India) উপাধি দেয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী পদক দেয়া হয় তাকে। এত এত পদক আর সম্মাননার পরও যাদবের একটাই স্বপ্ন, মৃত্যুর আগে ভারতে মোলাই কাথোনির মতো আরও বন তৈরি করে যাবেন।
একজন মানুষের একার পক্ষে পুরো সমাজটা বদলে দেয়া সম্ভব না। কিন্তু একজন মানুষের প্রতিদিনকার ছোট ছোট কাজ একদিন একটা বিশাল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। সামাদ কিংবা যাদবরা খুব সাধারণ মানুষ। পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা এবং সবুজের প্রতি ভালোবাসা থেকে আপাত চোখে আসাধ্যকে সাধন করেছেন তারা। প্রতি দিন না হোক, আমরা কি পারি না প্রতি মাস কিংবা প্রতি বছরে অন্তত একটি করে গাছ রোপণ করতে?