অটিজম– স্নায়বিক গঠন ও বিকাশে অস্বাভাবিকতার ফলে দেখা দেওয়া ব্যাধি, যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে ব্যক্তির মানসিক বিকাশের ওপর। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ যেমন- কথোপকথন, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে, পাশাপাশি তার মানসিক ও ভাষাগত দক্ষতায়ও ঘাটতি থাকতে পারে।
ব্যক্তিভেদে অটিজমের বিভিন্ন রকম উপসর্গ দেখা দেয় এবং উপসর্গের তীব্রতাও একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়ে থাকে। দেখা যায়, কোনো অটিস্টিক শিশু হয়তো সামান্য সাহায্য ও প্রশিক্ষণ পেলেই সমস্যাগুলো অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পারে, আবার কাউকে হয়তো পুরোপুরিই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। উপসর্গের এমন ভিন্নতার কারণে বর্তমানে ‘অটিজম’ শব্দটির পরিবর্তে ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন ধরনের উপসর্গের এই জটিল সন্নিবেশকে তুলে ধরার জন্যেই অটিজম সচেতনতার প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘পাজল রিবন’কে। অটিজমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের অভিজ্ঞতা অন্যজনের তুলনায় বেশ আলাদা, পাজলের বিচিত্র সব রং ও আকৃতি সেই বৈচিত্র্যেরই চিহ্ন বহন করে। আর রিবনের উজ্জ্বল রংগুলোর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, “অটিজম মানেই হতাশা নয়”।
অটিজম শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত থাকলেও এই ব্যাধিটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা হয়তো অনেকেরই নেই। যে কারণে আমাদের সমাজে অটিজম সম্বন্ধে ভুল-শুদ্ধ বিভিন্ন রকমের ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে এই লেখায় এমনই কিছু ধারণার সত্যাসত্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
অটিজম একটি মানসিক রোগ
অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়, এটি একটি স্নায়বিক গঠনগত সমস্যা, যাতে ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিভিন্ন তথ্যকে স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্নভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষের তুলনায় অটিস্টিকদের আচরণে বেশ ভিন্নতা দেখা যায়। এটা ঠিক যে, অটিজমের পাশাপাশি তাঁদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মনোবৈকল্য, অ্যালেক্সিথাইমিয়া (আবেগ অনুভব ও প্রকাশে সমস্যা) অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যাও উপস্থিত থাকতে পারে। কিন্তু অটিজম নিজে কোনো মানসিক রোগ নয়, এটি জেনে রাখা জরুরি।
অটিস্টিক ব্যক্তিরা নির্বোধ
অটিস্টিক মানুষেরা অন্যদের সাধারণ কথোপকথন ও ইশারা বুঝতে বা কোনো নির্দেশ পালন করতে বেশ সমস্যা বোধ করেন। কথাচ্ছলে উপমা বা ব্যঙ্গোক্তির ব্যবহার তারা বুঝতে পারেন না, বরং সেগুলোকে আক্ষরিক অর্থে ধরে নেন। যেমন- কেউ যদি একজন অটিস্টিক ব্যক্তিকে বলেন “আরে, এটা তো পানির মত সোজা”, ঐ অটিস্টিক ব্যক্তিটি তখন হয়তো ‘পানি’ শব্দটি নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবেন, খুঁজতে শুরু করবেন যে আশেপাশে পানি কোথায় আছে।
অটিস্টিক শিশুদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কোনো কোনো বিষয়ে তারা আশাতীত ভাল ফলাফল করছে, আবার কোনোটিতে ফলাফল খুবই হতাশাজনক। এ ধরনের খাপছাড়া বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকেই অটিস্টিকদের ভুল বোঝেন এবং তাদের নির্বোধ ভেবে বসেন। কিন্তু আসলে অটিস্টিকদের সমস্যা বুদ্ধিস্বল্পতা নয়, বুদ্ধি ব্যবহার করতে পারার সীমাবদ্ধতাই তাদের সমস্যা, আন্তরিক পরিচর্যার মাধ্যমে যা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। অবশ্য অটিস্টিকদের মধ্যে অটিজমের পাশাপাশি বুদ্ধিগত দুর্বলতা দেখা দিতে পারে, তাই বলে বুদ্ধিগত দুর্বলতা অটিজমের লক্ষণ- এমনটা বলা যাবে না।
অটিস্টিক ব্যক্তিরা সকলেই অসাধারণ প্রতিভাবান হয়ে থাকেন
‘রেইন ম্যান (১৯৮৮)’ চলচ্চিত্রে রেমন্ড নামক অসামান্য প্রতিভাবান অটিস্টিক চরিত্রটিকে আমরা যেমন দেখেছি, তাতে অনেকেরই মনে হতে পারে যে, অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সকলেই বুঝি এমন অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী হয়ে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, কেবল ১০% অটিস্টিক মানুষের মধ্যে এমন প্রতিভা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, স্বাভাবিক মানুষদের মধ্যে যে সম্ভাবনা মাত্র ১%। এ ধরনের প্রতিভাবানদের একেকজনের একেকটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখা যায়। কেউ গাণিতিক হিসেবে দক্ষ হন, বড় বড় সংখ্যার গুণ, ভাগ কিংবা বর্গমূল অনায়াসেই তারা নির্ণয় করে ফেলতে পারেন। কেউ প্রখর স্মরণশক্তি কাজে লাগিয়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের সব খুঁটিনাটি মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গেঁথে নিতে পারেন। কাউকে আবার সত্তর-আশি বৎসর আগের একটি তারিখ দিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সেদিন কী বার ছিল, সেকেন্ডের মধ্যে তার সঠিক জবাব দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারেন। একইভাবে কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজানো, কেউবা ছবি আঁকায় পেশাদার শিল্পীদের মত দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকেন কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই। এমন অসাধারণ প্রতিভার সঙ্গে অটিজমের যোগসূত্র আদৌ আছে কি নেই, তা নিশ্চিতভাবে এখনও জানা যায়নি। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকলেও সেগুলো প্রতিপাদনের মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অটিস্টিক ব্যক্তিরা কর্মজীবনে সফল হতে পারে না
অটিস্টিকদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে কাজ করতে সীমাবদ্ধতা থাকলেও এমন অনেক পথ খোলা রয়েছে, যেখানে তারা সফলভাবে কাজ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় জায়গা করে নেওয়া আমেরিকান অধ্যাপিকা টেম্পল গ্র্যান্ডিন, ২০০২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. ভার্নন স্মিথ, সঙ্গীতশিল্পী সুসান বয়েল, অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পী স্যার অ্যান্থনি হপকিন্স, ২০০৭ সালে প্রকাশিত বেস্টসেলার বই ‘Look me in the eye’ এর লেখক জন এলডার রোবিসন, পোকেমন নির্মাতা সাতোশি তাজিরি সহ আরও অনেকে। তারা প্রত্যেকেই অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের ভুক্তভোগী। তথাপি তারা তাদের সীমাবদ্ধতাকে জয় করে জীবনে শুধু সফলই হননি, বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনও করেছেন।
সুতরাং কেউ অটিস্টিক হওয়া মানেই যে তিনি কাজকর্মে অক্ষম, তা নয়। সঠিক দিকনির্দেশনা ও যত্নের সঙ্গে চেষ্টা করা হলে তারাও সফল হতে পারেন। এজন্যে শিশুকালেই যত দ্রুত সম্ভব তার অটিজমের ধরন এবং বিশেষ ঘাটতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা দরকার। যাতে তার অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যত্ন, শিক্ষা এবং পরিচর্যা যথাসময়ে শুরু করা যায় এবং সামাজিক ও কর্মজীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যে সে প্রস্তুত হতে পারে। কাউন্সেলর স্টিফেন বোর্গম্যান সাইকোলজি টুডেতে লেখা তার আর্টিকেলে অটিস্টিকদের পেশা নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছেন।
প্রথমেই তিনি জোর দিয়েছেন ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা যাচাইয়ের ওপর। অটিস্টিকদের মধ্যে দেখা যায়, কারো হয়তো কল্পনাশক্তি প্রখর, আবার কেউ হিসেব-নিকেশে পটু, কারো সামাজিক পরিমণ্ডলে কথোপকথন চালিয়ে নিতে সমস্যা হয়, কারো ঘাটতি স্মরণশক্তিতে। কারো আই.কিউ. স্বাভাবিক বা তার থেকেও বেশি, আবার কারো আই.কিউ. বেশ কম। কারো কারো আবার নির্দিষ্ট কিছু উদ্দীপনা পেলে উত্তেজিত হয়ে পড়ারও প্রবণতা থাকে। তাই একজন অটিস্টিক ব্যক্তির জন্যে উপযুক্ত পেশা ও কর্মক্ষেত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা দরকার।
অটিস্টিক ব্যক্তিরা অসামাজিক
অটিজমে ভুগতে থাকা অনেক শিশুই সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় আগ্রহী। তারা বন্ধুত্ব করতে চায়, কিন্তু মূলত সামাজিক দক্ষতার অভাবে এতে উদ্যোগী হয় না বা হতে পারে না। অন্যান্য শিশুরা যেমন বয়স বাড়ার সাথে নিজে নিজেই আশেপাশের মানুষদের আচরণ, আবেগ, কথাবার্তার ধরণ, শরীরি ভাষা থেকে অনেক কিছু বুঝে নিতে শেখে, অটিস্টিকদের বেলায় এই শেখার মধ্যে বেশ ঘাটতি থেকে যায়। ধরা যাক, কয়েকজন শিশু একত্র হয়ে খেলাধুলা করছে। হঠাৎ একজন শিশুকে পড়ে যেতে দেখে অন্য শিশুরা চমকে উঠলো। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলো, কেউ বা সমবেদনা জানালো। কিন্তু সেখানে কোনো অটিস্টিক শিশু থাকলে তার হয়তো এসবে কোনো ভ্রূক্ষেপই থাকবে না, সে আনমনে খেলতে থাকলো বা শিশুটিকে পড়ে যেতে দেখে হেসে উঠলো। এতে স্বভাবতই আমাদের মনে হবে, শিশুটির মধ্যে কি বোধবুদ্ধি বা সহানুভূতি বলে কিছু নেই? অথবা সে কি জানে না, কোন পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করতে হয়? এখানে আমাদের বোঝা দরকার যে, অটিস্টিক শিশুটি নিজে তার এমন আচরণের জন্যে দায়ী নয়, তার মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার কারণেই তার আচরণ এমন। “কেউ পড়ে গেলে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়া উচিত, ব্যথা পেয়েছে কিনা জানতে চাওয়া উচিত”– এই প্রতিক্রিয়াগুলো অন্য দশজন শিশু বয়স বাড়ার সাথে তার আশপাশ থেকে নিজে নিজে শিখতে পারলেও অটিস্টিক শিশুরা তা পারে না বলেই ঠিকঠাক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না।
এ ধরনের শিশুদেরকে ধৈর্য সহকারে সামাজিক দক্ষতার শিক্ষা দেওয়া হলে এবং সেগুলো প্রয়োগের সুযোগ করে দিলে তারাও যথাযথ আচরণ করতে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তবে কোনো অটিস্টিক শিশু যদি সামাজিক মেলামেশায় একেবারেই আগ্রহী না হয়, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে জোরাজুরি করা উচিত হবে না। সাধারণত অটিস্টিক ব্যক্তিদের মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে বড় দল গঠনের প্রবণতা তেমন দেখা ষায় না। হাতেগোনা দু’তিনজন কাছের বন্ধুকে নিয়েই গড়ে ওঠে তাদের বন্ধুজগৎ।
অটিজমের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, উপসর্গের তীব্রতা অনুযায়ী রয়েছে এর রকমফের। তাই ঢালাওভাবে এই অবস্থাটির সম্পর্কে কোনো সার্বজনীন ধারণা পোষণ করলে, সেটি ভুল হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
অটিজম কোনো রোগ বা অক্ষমতা নয়, বরং একে বিশেষ ধরনের সক্ষমতা বলা চলে। সেই সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। তাই অটিস্টিক ব্যক্তিদেরকে ভয় না করে তাদেরকে কাছে টেনে নিতে হবে, ঘৃণাভরে দূরে না সরিয়ে তাদের সাথে মিলেমিশে থাকতে হবে। প্রত্যাখ্যান নয়, সমর্থন দিতে হবে। তবেই তারা তাদের সামর্থ্যগুলোর পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন।