গ্রীষ্মপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। খুব ছোটবেলা থেকেই গরম আবহাওয়ার সাথে আমরা বেশ মানিয়ে নিয়েছি এবং বলতে গেলে আমরা গরমেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাংলা বছরের শুরুটাও হয় গ্রীষ্মকাল দিয়ে। শীতের জীর্ণতাকে কাটিয়ে সবাই বেশ অপেক্ষা করে গ্রীষ্মের জন্য। খুব সম্ভবত বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালেই সবচেয়ে বেশী পরিমাণে মিষ্টি ফল পাওয়া যায়। আর এজন্যই গ্রীষ্মকালকে আমরা মধুমাস বলি। কিন্তু সেই মধুমাস আর নেই। আবহাওয়ার গত কয়েক বছরে যে পরিবর্তন এসেছে তা বেশ অস্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক জনজীবনে বেশ প্রভাব ফেলছে। আর গত কয়েক দিনে সারাদেশে তাপমাত্রার যে বিপর্যয়, তাতে অবস্থা বেশ অসহনীয় ও ভয়ানক পর্যায়ে চলে গেছে।
অতিরিক্ত গরমের কারণ
সম্প্রতি তাপমাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে বৃদ্ধি ছাড়াও অধিক পরিমাণে গরম অনুভূত হচ্ছে। এর পিছনে বিশেষ কারণ হচ্ছে বছরের ঠিক দুই সময় পৃথিবী বিষুব রেখায় সূর্য বরাবর অবস্থান করে। এতে সূর্যরশ্মি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে পড়ে। ফলে বেশী গরম অনুভূত হয়। বছরের এই দুই সময় হচ্ছে মে মাসের ২২-২৮ এবং সেপ্টেম্বর ২২-২৮ থেকে। এই সময় দিন রাত সমান থাকে। বর্তমানে “মে-ইকুইনক্স” চলছে। এজন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী মাত্রায় গরম অনুভূত হচ্ছে।
গরম আবহাওয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাদের জন্য
- ৬০ বছরেরও বেশি বয়স্ক মানুষ
- ১০ বছরের নিচে শিশু
- দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছেন মানুষ, উদাহরণস্বরূপ হার্ট বা শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস রোগী
- যারা সরাসরি সূর্যের নিচে বা গরম এবং কম বাতাসযুক্ত এলাকায় কাজ করেন
তাপ সংক্রান্ত অসুস্থতা
গরমের ফুসকুড়ি
এটি গরমে আর্দ্র আবহাওয়ায় অত্যধিক ঘামের কারণে হয়ে থাকে এবং বিশেষ করে ছোট শিশুদের মাঝে বেশী দেখা যায়। সাধারণত যারা ঘনবসতিপূর্ণ এবং স্যাতস্যাতে এলাকায় বসবাস করেন, গরমে তাদের উচিত ঘরে বাতাস চলালের ব্যবস্থা করা।
ডিহাইড্রেশন
শরীরে পানির পরিমাণ অন্যান্য তরল পদার্থ থেকে কমে গেলে ডিহাইড্রেশন হয়। গরমে প্রায় সকলেরই কম বেশী ডিহাইড্রেশন হয়।ডিহাইড্রেশনের ফলে শরীর ভারসম্য বজায় রাখতে পারেনা এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে যে কেউ দুর্বল বোধ করেন। তাৎক্ষণিকভাবে চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
হিট ক্র্যাম্পস
শরীর থেকে অধিক পরিমাণে পানির সাথে লবণ বের হয়ে যাওয়ার কারণে হাত ও পায়ের পেশী ক্র্যাম্প করে। হিট ক্র্যাম্প হচ্ছে হিট এক্সশনের প্রথম ধাপ। হিট এক্সশন হচ্ছে অতিরিক্ত গরমে থেকে সৃষ্ট আরেক ধরনের অসুস্থতা। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে হিট এক্সসশনের কারণে অনেক সময় হঠাৎ করে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়।
হিট স্ট্রোক
যখন শরীরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না এবং তাপমাত্রা ৪০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছে যায়, তখন যে কেউ হিট স্ট্রোক করতে পারেন। তাপ সম্পর্কিত এটি সবচেয়ে গুরুতর অসুস্থতা এবং এটি জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলো
- ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা এর চেয়ে বেশী জ্বর
- চামড়া লাল হয়ে যাওয়া
- শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া
তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ রোগীকে ঠান্ডা কোন জায়গায় রেখে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক করতে হবে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে অবশ্যই মিষ্টি বা স্যালাইন দিতে হবে। এতে দ্রুত সুগার লেভেল বেড়ে যাবে।
অতিরিক্ত গরমে করণীয়
ঠান্ডা পরিবেশে থাকুন
ঘরে যথাসম্ভব ঠান্ডা পরিবেশে অবস্থান করুন। অপ্রয়োজনীয় কারণে দিনে, বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা বাইরে বের না হওয়া ভালো। বের হলে অবশ্যই ছাতা সাথে নিবেন। গরমে কালো রঙের ছাতা পরিহার করুন।
প্রচুর পানি পান করুন
সারা দিনে প্রচুর পানি পান করুন। বাইরে বের হওয়ার সময় পানি সাথে নিন। দিনে কমপক্ষে তিন লিটার পানি পান করুন।
আরামদায়ক পোশাক পরিধান করুন
গরমে আরামদায়ক পোশাক পরিধান করুন। বাচ্চাদের জন্য সুতির হাল্কা রঙের কাপড় নির্বাচন করুন। খুব গরমে কালো রঙ পরিহার করুন।
মৌসুমী ফল গ্রহণ করুন
প্রচুর পরিমানে ফল ও ফলের জুস খান। গরমের সময় টক ফল খুবই ভালো। কিন্তু যাদের নিম্ন রক্তচাপ, গরমের সময় তারা অতিরিক্ত টক খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
সবুজ সালাদ বা সবজি খান
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সবুজ সালাদ বা সবজি রাখুন। এতে শরীরে পানি ও খনিজের ঘাটতি হবে না এবং শরীর ঠান্ডা থাকবে।
অতিরিক্ত গরমে বর্জনীয়
সফট অথবা হার্ড ড্রিঙ্কস নেওয়া থেকে বিরত থাকুন
অতিরিক্ত গরমে সফট অথবা হার্ড ড্রিঙ্কস নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। ড্রিঙ্কস শরীরের পানিকে নিরূদিত করে যা শরীরে পানি স্বল্পতা তৈরী করে। এছাড়াও ঘন ঘন পানি পিপাসা পায় এবং গলা শুখিয়ে আসে। তাই গরমে সাময়িক তৃষ্ণা মেটাতে অবশ্যই ড্রিঙ্কস না।
পানি পানের সময় সতর্ক থাকুন
গরমের কারণে যেকোনো যায়গা থেকে পানি পান থেকে বিরত থাকুন। দূষিত পানি থেকে পানিবাহিত রোগ হতে পারে। এজন্য পানি পান করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। বাইরে পানি পান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মিনারেল ওয়াটার গ্রহণ করুন।
ফাস্টফুডকে না বলুন
ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবারকে না বলুন। ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবার শরীরের জন্য খারাপ। গরমে তেলে ভাজা বা রিচ ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। গরমে এ জাতীয় খাবার যত বেশী খাবেন, তত বেশী গরম লাগবে। সুতরাং এ ধরনের খাবার না খাওয়াই ভালো। স্ট্রীট ফুড বর্জন করুন অতিরিক্ত গরমে।
স্যালাইন খাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন
গরমের কারণে ঘরে থাকতে চাইলেও অনেকেই আছেন শারীরিক পরিশ্রম করেন। তাদেরকে কাজের জন্য বাইরে যেতেই হয়। অনেকেই আছেন দিন আনেন দিন খান। সেক্ষেত্রে যেন শরীরে পানি বা লবণের স্বল্পতা না হয় এই জন্য স্যালাইন খেতে পারেন। বাইরে চলাচলের সময় কাছে স্যালাইন রাখতে পারেন। যদি শরীর দুর্বল মনে হয়, সেক্ষেত্রে সাথে সাথে স্যালাইন খেয়ে নিতে পারেন। এতে দুর্বলতা কমবে।
প্যাকেটের গায়ে নির্দেশিত পরিমাণ পানির চেয়ে কম পানি দিয়ে স্যালাইন খাবেন না। শুধু স্যালাইন গুড়া খেলে বা কম পানি দিয়ে স্যালাইন খেলে লবণের ঘনত্ব বেড়ে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।
এই গরমে নিজের পাশাপাশি পরিবারের যত্ন নিন। বাইরে চলাফেলার সময় বয়স্ক এবং শিশুদের দিকে খেয়াল রাখুন এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে। কেউ অসুস্থ হলে সচেতনতার সাথে সিদ্ধান্ত নিন। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।
তথ্যসূত্র
১। healthdirect.gov.au/hot-weather-risks-and-staying-cool
২। scientificamerican.com/article/heat-wave-health/
৩। blog.thebathroomsink.com/2017/01/11/yes-to-sunscreen/
৪। scientificamerican.com/article/heat-wave-health/
৫। familydoctor.org/condition/heat-exhaustion-heatstroke/