অন্ধকার আফ্রিকার অন্ধকার সভ্যতা। মানুষ এখানে পশ্চাদপদ, সভ্যতা তার অনুন্নত। আফ্রিকা মহাদেশের সিংহভাগ মানুষ আজও বাস করে দারিদ্র্যসকাশে; তাদের দিন কাটে অনাহারে, কারো বা রাত পোহায় অর্ধাহারে, কেউ বা অভ্যাসের দাস (আমাদের সাপেক্ষে) উদ্ভট ধরণের খাদ্যাহারে। বাদুড় আফ্রিকার অনেক অঞ্চলের ‘প্রিয়’ খাবার। বুশমিট হিসেবে আফ্রিকার বাজারগুলোতে রীতিমত বাদুড় বিক্রি করা হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ফলাহারী বাদুড়েরা (Fruit Bat) ভয়ংকর ইবোলা ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক। মূলত বাদুড় থেকে এই ভাইরাস মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীতে সংক্রমিত হয়।
নদীর নামে নামাঙ্কিত এক প্রাকৃতিক মারণাস্ত্র
১৯৭৬ সালে এই ভাইরাসটি বিজ্ঞানীদের নজরে আসে যখন আফ্রিকার দুটি অঞ্চলের মানুষ একইসাথে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। একটি বর্তমানের দক্ষিণ সুদান ও অন্যটি গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর (তৎকালীন জায়ারে) ইয়ামবুকু গ্রাম। শেষোক্ত গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইবোলা নদীর নাম থেকে নামকরণ করা হয় এই ইবোলা ভাইরাসের।
‘৭৬ সালে ইবোলা ভাইরাসের সেই আঘাতে (বর্তমানের) দক্ষিণ সুদানে রোগাক্রান্ত মানুষের অর্ধেকের বেশিই মারা গিয়েছিল। ইয়ামবুকু গ্রামে মৃত্যুর হার ছিল আরো ভয়াবহ। সেখানে আক্রান্ত একশজনের ভিতর ৮৮ জনই মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়! ¹
ইবোলারা পাঁচ জন
ইবোলা ফিলোভিরিডি (Filoviridae) পরিবারের সদস্য। এখন পর্যন্ত এই পরিবারে আছে পাঁচ প্রজাতির ইবোলা ভাইরাস।
- Ebola virus (Zaire ebolavirus)
- Sudan virus (Sudan ebolavirus)
- Taï Forest virus (Taï Forest ebolavirus, আগে এটি Côte d’Ivoire ebolavirus নামে পরিচিত ছিল)
- Bundibugyo virus (Bundibugyo ebolavirus)
- Reston virus (Reston ebolavirus)
এদের মধ্যে কেবল রেস্টন ভাইরাসটি মানুষকে ছেড়ে দেয়। এরা মানুষ বাদে অন্য প্রাণীদের (এই যেমন শূকরদের) আক্রান্ত করায় ব্যস্ত থাকে। ²,³
শান্ত সুনিবিড় বসতে, কীভাবে ইবোলা আসে মানুষেতে
একজন ইবোলা আক্রান্ত মানুষ তার জনপদের জন্য হুমকিস্বরূপ। যে মানুষটা হয়তো ছিল পরিবারের মধ্যমণি; ইবোলার করাল থাবায় সেই হয়ে ওঠে আপনজনদের জন্য মহাবিপদ, শনি। ইবোলায় আক্রান্ত মানুষ কী বেঁচে থাকা কী ওপারেতে থাকা- দুই অবস্থাতেই অন্য সুস্থ মানুষদের জন্য ক্ষতিকর। তার রক্ত, ঘাম, লালা থেকে শুরু করে বমি, মলমূত্র, বুকের দুধ, শুক্রাণু সবই ইবোলার জীবাণু বহন করতে সক্ষম। তবে শর্ত হল এই দুষ্ট ভাইরাসটিকে অন্য যেকোনো সুস্থ মানুষের চোখ, মুখ, নাক, ত্বক (বিশেষত ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক) ও যৌনাঙ্গ দিয়ে সরাসরি দেহে প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু এই শর্তও বা কম কীসে!
আক্রান্ত ব্যক্তির ঘর্মাক্ত মুখে বুলিয়ে দেওয়া স্নেহের পরশ ইবোলাকে সুযোগ করে দেবে আরো একটি সুস্থ দেহে বংশবৃদ্ধির। আক্রান্ত মা তার দুধের শিশুকে অজান্তেই সংক্রমিত করে ফেলবে এই ভাইরাসে। ইবোলার যন্ত্রণায় টপটপ করে পড়া চোখের পানিও অন্য আরেকজনের যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য পোশাক, বিছানা, বালিশ, বইপত্র সবকিছু থেকে ইবোলা ছড়াতে পারে। তা-ও মন্দের ভালো যে, মিজেলস ভাইরাসের মতো ইবোলা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। 4 সেটা হলে আরো ‘খবর’ ছিল। ইবোলার প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকে এই রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত স্বাস্থ্যকর্মীরা। সূচের খোঁচায় একজন সুস্থ স্বাস্থ্যকর্মী ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে এরকম নজির আছে অনেক। প্রচণ্ড সতর্কতার সাথে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করা হয়। বায়োসেফটির সর্বোচ্চ লেভেলে ইবোলাকে নিয়ে গবেষণা করা হয়। 5,6
এতক্ষণ তো মানুষে মানুষে ইবোলা কাহিনী বলা হলো। এবার একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, বদের হাড্ডি ইবোলাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে কোন জন! বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত তথ্য বলে, বাদুর হল ইবোলার প্রাথমিক উৎস। 7 তবে বাদুড় এতটা ‘খারাপ’ (!) না; সে এটাকে তার বাস্তুসংস্থানের অন্যান্যদের মাঝে ‘উদার’ মনে ছড়িয়ে দেয়। আর তার গ্রহীতারা হলেন বানর, এপস, অ্যান্টিলপ, শিম্পাঞ্জি, গরিলারা। আর খাদ্যাভ্যাসে তো আফ্রিকার অধিবাসীরা (বিশেষত আদিবাসীরা) কিংবদন্তীতুল্য। তারা বেছে বেছে এদেরকেই খাবে। মূলত আফ্রিকানদের উদ্ভট বুশমিট প্রীতিই ইবোলাকে জনপদে নিয়ে আসার অন্যতম কারণ। তবে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের সাথে মশা বা অন্য পতঙ্গের কোন যোগসূত্র বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি।
কী কী লক্ষণে বোঝা যায় ইবোলাকে?
জ্বর আসে, হয় বমি। দুর্বল হয়ে যায় আদমি। অবসাদ আর ডায়রিয়াতে, মাথা ব্যথা থাকে সাথে। ব্যাখ্যাতীত রক্তক্ষরণ অকালে ঘটায় মৃত্যুবরণ।ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ২ থেকে ২১ দিনের ভিতর এসব লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। 8 রোগীর শরীরে র্যাশ উঠতে পারে, দেখা দিতে পারে কিডনিতে সমস্যা। 9 এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা যায়, ইবোলায় আক্রান্ত হলে রক্তে কমে যেতে পারে অণুচক্রিকার সংখ্যা। অণুচক্রিকাই কিন্তু আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।¹º
তথাপি, মরণই নয় সমাধান
ইবোলার আক্রমণ দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর মোটামুটি মানের একটা ধাক্কা দিয়ে যায়। শুক্রাশয়, চোখের ভেতর, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ইবোলার দীর্ঘকালীন উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ও ভ্রূণে ইবোলার অস্তিত্ব দেখা যায়। ¹¹ তবে এতকিছুর পরও ইবোলা এইডসের মতো নিশ্চিত মৃত্যুর কারণ নয়। হুম, এটা ঠিক যে, ইবোলা আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ থেকে আলাদা করে রাখা হয়। কিন্তু যথাযথ যত্নআত্তি আর সুচিকিৎসা পেলে এই রোগের রোগীরাও ভালো হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিডিসি (Centers for Disease Control and Prevention)-এর দেওয়া তথ্যমতে, ইবোলার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী সংস্থা এফডিএ (Food and Drug Administration) কর্তৃক অনুমোদিত কোনো ভ্যাক্সিন বের হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা বসে নেই। তাদের নিরন্তর চেষ্টা চলছে ইবোলাকে সম্পূর্ণ পরাভূত করার প্রয়াসে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে ইবোলার বিপরীতে ভ্যাক্সিনের প্রথম পর্যায়ের ট্রায়াল (Phase 1 Trial) চালানোর তথ্য প্রকাশিত হয়।
সিয়েরা লিয়নে ইবোলার বিপরীতে ভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়। Sierra Leone Trial to Introduce a Vaccine against Ebola (STRIVE) নামে চলা এই ট্রায়ালটি ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয়। প্রায় সাড়ে আট হাজারের উপর নিবেদিত প্রাণ মানুষ কাজ করে যাচ্ছে এই প্রোগ্রামে।
বারেবারেই হানা দেয় ইবোলা ভাইরাস
১৯৭৬ সালে আবিস্কারের পর থেকে প্রায় নিয়মিতই ইবোলার ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে মানুষকে। আর এর সিংহভাগ ঝড় বয়ে যায় আফ্রিকা মহাদেশের উপর দিয়ে। ১৯৯৪ ও ‘৯৬ সালে গ্যাবনে জোড়া আঘাত হানে ইবোলা; আক্রান্ত মানুষের অর্ধেকের বেশিই মারা যায় এর প্রকোপে। ১৯৯৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে শতকরা ৮১ ভাগ ইবোলা আক্রান্ত রোগী চলে যায় না ফেরার দেশে। ২০০৩ সালে কঙ্গোতে দু’বার হানা দেয় ইবোলা; মেরে ফেলে ৮০ শতাংশেরও বেশী আক্রান্ত মানুষকে। ২০১৪ সালে ইবোলা তার আন্তঃমহাদেশীয় যাত্রা শুরু করে। সে বছর ইবোলা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র (আক্রান্ত চারজনের মধ্যে একজন মারাও যায়), যুক্তরাজ্য ও স্পেনে। ২০১৫ সালে ইতালিতেও নিজের উপস্থিতি জানান দেয় বদমাশ ইবোলা। এখন পর্যন্ত এশিয়াতে ইবোলার প্রকোপ ধরা পড়েনি। তবে বাংলাদেশী এক প্রজাতির বাদুড়ে জায়ারে ও রেস্টন ইবোলা ভাইরাসের বিপরীতে এক ধরণের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। এ থেকে বিজ্ঞানীদের আশংকা যে, এশিয়াতেও ইবোলা ভাইরাসের বাহক বাদুড় থাকতে পারে। ¹²
প্রকৃতি আসলে মানুষের বন্ধু। তবে আমরা প্রকৃতির সাথে মিত্রতা করতে পারিনি। আর পারিনি বলেই আমাদের এত এত ভোগান্তি। আমাদের চারপাশের প্রতিবেশ এত এত কলুষিত। মানুষের অবিমৃষ্য আচরণ আর অন্যায় বিচরণ এই পৃথিবীকে ধীরে ধীরে করে তুলছে বসবাসের জন্য চরম প্রতিকূল। হয়তবা ইবোলা ভাইরাস কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের সমৃদ্ধির সোপান। হয়তো বা অপেক্ষাকৃত পশ্চাদপদ আফ্রিকার জনগণ উন্নত বিশ্বের তথাকথিত মানুষের কাছে গিনিপিগ তুল্য। তারপরও মানবতার প্রত্যাশা, আফ্রিকার দুঃখ ইবোলা ভাইরাস এক সময় মানুষের কাছে পদানত হবে; যেমন হয়েছে গুটিবসন্ত।
লেখাটিতে অনেক ভারবাহী কথা যুক্ত করতে হয়েছে বিধায় জায়গায় জায়গায় ক্ষেত্রবিশেষে কিছু রম্য শব্দ ব্যবহার করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। এই চেষ্টা কোনোভাবেই ইবোলা আক্রান্ত মানুষের দুঃখ, কষ্টকে খাটো করবার অভিপ্রায়ে নয়।
ফিচার ইমেজ- youtube.com
ফুটনোট:
- Laupland, K. B., & Valiquette, L. (2014). Ebola virus disease. Canadian Journal of Infectious Diseases and Medical Microbiology, 25(3), 128-129.
- Barrette, R. W., Metwally, S. A., Rowland, J. M., Xu, L., Zaki, S. R., Nichol, S. T., … & Sealy, T. K. (2009). Discovery of swine as a host for the Reston ebolavirus. Science, 325(5937), 204-206.
- Marsh, G. A., Haining, J., Robinson, R., Foord, A., Yamada, M., Barr, J. A., … & Rollin, P. E. (2011). Ebola Reston virus infection of pigs: clinical significance and transmission potential. The Journal of infectious diseases, 204(suppl_3), S804-S809.
- Verreault, D., Moineau, S., & Duchaine, C. (2008). Methods for sampling of airborne viruses. Microbiology and Molecular Biology Reviews, 72(3), 413-444.
- Günther, S., Feldmann, H., Geisbert, T. W., Hensley, L. E., Rollin, P. E., Nichol, S. T., … & Becker, S. (2011). Management of accidental exposure to Ebola virus in the biosafety level 4 laboratory, Hamburg, Germany. The Journal of infectious diseases, 204(suppl_3), S785-S790.
- Swanepoel, R., Leman, P. A., Burt, F. J., Zachariades, N. A., Braack, L. E., Ksiazek, T. G., … & Peters, C. J. (1996). Experimental inoculation of plants and animals with Ebola virus. Emerging infectious diseases, 2(4), 321.
- Leroy, E. M., Kumulungui, B., Pourrut, X., Rouquet, P., Hassanin, A., Yaba, P., … & Swanepoel, R. (2005). Fruit bats as reservoirs of Ebola virus. Nature, 438(7068), 575-576.
- Goeijenbier, M., Van Kampen, J. J., Reusken, C. B., Koopmans, M. P., & Van Gorp, E. C. (2014). Ebola virus disease: a review on epidemiology, symptoms, treatment and pathogenesis. Neth J Med, 72(9), 442-8.
- Feldmann, H., & Geisbert, T. W. (2011). Ebola haemorrhagic fever. The Lancet, 377(9768), 849-862.
- Laki, K. (1972). Our ancient heritage in blood clotting and some of its consequences. Annals of the New York Academy of Sciences, 202(1), 297-307.
- Wiwanitkit, V. (2016). Ebola and pregnancy. Obstetric Medicine: The Medicine of Pregnancy, 9(1), 50-50.
- Olival, K. J., Islam, A., Yu, M., Anthony, S. J., Epstein, J. H., Khan, S. A., … & Luby, S. P. (2013). Ebola virus antibodies in fruit bats, Bangladesh. Emerging infectious diseases, 19(2), 270.