জনপ্রিয় জাপানি অ্যানিমে সিরিজের চরিত্র রেটসুকো, যে চাকরি করে টোকিওর এক ট্রেডিং ফার্মের অ্যাকাউন্টিং সেকশনে। আর কর্মক্ষেত্রে রেটসুকো বিভিন্ন ধরনের অফিস পলিটিক্স, বুলিং এবং বৈষ্যমের শিকার হতে থাকে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের হয়রানি থেকে তার মাঝে তৈরি হয় বিষণ্ণতা এবং ক্ষোভ। কিন্তু এই ক্ষোভ কি শুধুই রেটসুকোর?
‘বুলিং’ শব্দটির সাথে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই পরিচিত। পরিবার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্নভাবে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে মানুষ। তবে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির মধ্যে ভয়াবহ একটি সমস্যা হচ্ছে- ওয়ার্কপ্লেস বুলিং, অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে হয়রানি।
কী এই ওয়ার্কপ্লেস বুলিং?
কর্মক্ষেত্রে একজন অফিস কর্মী যখন অন্য সহকর্মী কিংবা কয়েকজন সহকর্মীদের দ্বারা কোনোভাবে হেয়-প্রতিপন্নের শিকার তখন হয়, তখন একে ওয়ার্কপ্লেস বুলিং বলা হয়। বিশেষ কোনো ব্যক্তি কিংবা সহকর্মীকে বিভিন্নভাবে ছোট করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা কিংবা হেয়-প্রতিপন্ন করাই বুলিং। যেমন-
- কোনো কর্মীকে উদ্দেশ্য করে উস্কানিমূলক কথা বলা;
- জাতি কিংবা ধর্মকে কেন্দ্র করে কটূক্তি করা;
- কারো কোনো প্রতিবন্ধকতাকে নিয়ে বিদ্রূপ বা উপহাস করা;
- কাজের অযৌক্তিক সমালোচনা করা এবং তুচ্ছভাবে তুলে ধরার প্রবণতা;
- কাজের ব্যাপারে সঠিক নির্দেশনা কিংবা ডেডলাইন না দিয়ে সহকর্মীকে বিভ্রান্তিতে ফেলা।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের হয়রানি বা বুলিংয়ের মুখোমুখি হতে হয় একজন কর্মীকে। এবার একটু সবিস্তরে বলা যাক।
আমাদের দেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অফিস বুলিংয়ের শিকার হয়ে থাকে। বিদ্রুপ বা উপহাস, আক্রমণাত্মক ব্যবহার, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে উপেক্ষা করা কিংবা তার মতামত না নেওয়া, কারো ব্যাপারে আপত্তিকর মন্তব্য কিংবা বডি শেমিং অর্থাৎ শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মন্তব্য কিংবা কটূক্তিমূলক কথার মাধ্যমে বুলিং করা হয়, যা কর্পোরেট কালচারের অসুস্থ এক অংশ।
উপরোক্ত বিষয়াদি ছাড়াও উচ্চপদস্থ সহকর্মীর দ্বারা বিভিন্ন মানসিক হয়রানির শিকার হতে হয় অফিস কর্মীদের। যেমন- নিজের প্রাপ্তি বা কর্মক্ষেত্রে সফলতা অন্যের নামে চালিয়ে দেওয়া, কাজের চাপ কিংবা দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া, সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয়া, নির্ধারিত কাজের সময় ছাড়িয়ে অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করানো কিংবা ছুটির দিনে কাজের চাপ দিয়ে মানসিকভাবে হয়রানি করা।
বুলিংয়ের শিকার কারা এবং বুলিং করছে কে?
ম্যানেজার কিংবা উচ্চপদস্থ সহকর্মীদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হওয়া সাধারণ একটি দৃশ্য। প্রমোশন আটকে রাখা, ছুটি না মঞ্জুর করা, অন্য বিভাগে বদলি কিংবা চাকরিচ্যুত করার মতো বিভিন্ন ধরনের বুলিংয়ের শিকার হয় অফিস কর্মীরা। কিন্তু এই বুলিং বস কিংবা উচ্চপর্যায় থেকেই আসে তেমনটা নয়। অনেকসময় নিম্নপদস্থ ব্যক্তির দ্বারাও এই বুলিং হতে পারে।
যেমন-
- ম্যানেজারের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ;
- কাজ সম্পূর্ণ না করা কিংবা করতে অপারগতা প্রকাশ করা;
- ম্যানেজার কিংবা উচ্চপদস্থ ব্যক্তির ব্যাপারে গুজব ছড়ানো।
কর্মক্ষেত্রে হয়রানির ফলাফল
কর্মক্ষেত্রে হয়রানির প্রভাব একজন অফিস কর্মীর ওপর মানসিক এবং শারীরিক দু’ভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলাফলস্বরূপ হতে পারে-
- কাজে কিংবা অফিসের ব্যাপারে অনীহা কাজ করা;
- দুশ্চিন্তার কারণে উচ্চরক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসের মতো বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি;
- হীনম্মন্যতায় ও বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকা।
নেতিবাচক প্রভাব কি শুধু অফিস কর্মীরই?
না, অফিস বুলিংয়ের ফলাফল হিসেবে একজন কর্মীর উপর যেরুপ বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়, তেমনি অফিসের জন্যও এটি বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর ফলে-
১) একজন কর্মীর কাজের উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে, যা অফিসের জন্য নেতিবাচক।
২) বুলিংয়ের শিকার হওয়া কর্মী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে, যার ফলে আইনি জটিলতার সৃষ্টি হবে, যা অফিসের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক।
৩) কর্মীর কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারে উদাসীনতা। এর ফলে তার অনুপস্থিতি বৃদ্ধি এবং কাজের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেবে।
হয়রানির সম্মুখীন হলে করণীয়
আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ বিভাগ থাকে, যারা অফিস কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধাসহ এসকল বিষয়ে কর্মচারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হলে প্রথমেই তাদের জানাতে হবে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে অ্যান্টি-হ্যারেজমেন্ট পলিসি থাকে। তবে প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের পলিসি থাকুক কিংবা না থাকুক, কিছু উপায় অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। যেমন-
১) বুলিং কিংবা হয়রানিকারীর সাথে এ বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে হবে এবং এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বলতে হবে। তথাপি বুলিং বা হয়রানি যদি চূড়ান্ত পর্যায়ের হয়, তবে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজন হলে আইনি সহায়তা নিতে হবে।
২) অনেক ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ সহকর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে প্রমাণ (স্ক্রিনশট, ভিডিও কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী) কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
৩) বারবার এর শিকার হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে এবং বুলিংয়ের শিকার সহকর্মীর প্রতি সবার সহযোগিতামূলক আচরণ হতে হবে।
একটি সুস্থ এবং সুন্দর কর্মস্থল আমাদের কাজের সৃজনশীলতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় আর সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সৃষ্টি করে। প্রত্যেক অফিসে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি আবশ্যক। এছাড়াও আমাদের কথায় কিংবা কাজেও যেন এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত প্রকাশ না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।