বাংলাদেশে যদি একটি জরিপ করা যায় কতজন ডাল খান তার ওপর, তাহলে নব্বই শতাংশ জনগণই বলবেন তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ডাল থাকে এটি মোটামুটি নিশ্চিত। দৈনিক আমিষের চাহিদা পূরণে ডালের তুলনা নেই। মাছ, মাংস কেনার সামর্থ্য যাদের নেই, তারাও তাদের আমিষের চাহিদা ডাল খেয়ে পূরণ করতে পারেন। তাইতো ডালকে ‘গরিবের মাংস’ বলা হয়। কিন্তু এই ডাল ভক্ষণ যদি হয় পঙ্গুত্বের কারণ? অথবা শেষ পরিণতি যদি হয় মৃত্যু?
মসুর ডাল, মুগ ডাল ইত্যাদির মতো একটি ডাল হলো খেসারি। Fabaceae পরিবারের Papillionaceae উপ-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Lathyrus প্রজাতির কয়েকটি উদ্ভিদের বীজ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে পঙ্গু হবার ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো খেসারি, যা ডাল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং আলজেরিয়ায় এ ডালের প্রচলন সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন এবং অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা যায়। এই ডালে বেটা-অক্সালিক-অ্যামাইনো-এল-অ্যালানিন এসিড (BOAA) নামক উত্তেজক নিউরোটক্সিন রয়েছে, যা স্নায়বিক পঙ্গুতা বা প্যারালাইসিসের জন্য দায়ী। এই রোগকে ল্যাথাইরিজম বলা হয়। শুধু মানুষেরই নয়, ঘোড়া এবং গবাদি পশুকেও দীর্ঘদিন ধরে এই শস্য খাওয়ালেও আক্রান্ত হতে পারে।
কীভাবে জানা গেল?
‘ভাবপ্রকাশ’ নামক অতি প্রাচীন এক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে খেসারি ডালে পঙ্গুতা এবং প্রদাহ সম্পর্কে। আবার খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে হিপোক্রিটাসও বলে গিয়েছেন, “কোনো কোনো ডাল মানুষের জন্য বিষাক্ত”। ১৮৩৩ সালে ভারতে এক জরিপে দেখা যায় যেসব খরা এলাকা স্নায়বিক পঙ্গুতার প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব এলাকার মানুষের প্রধান খাদ্যই খেসারি। তবে এতো তথ্য থাকা সত্ত্বেও এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে অনেক পরে। ১৮৭৩ সালে ইতালির কান্তানি নামের এক ব্যক্তি এ রোগকে ‘ল্যাথাইরিজম’ নাম দেন।
প্রাদুর্ভাব
খেসারির ডাল এমন এক শস্য যা বন্যা বা খরা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেই টিকে থাকতে পারে। তাই কিছু উন্নয়নশীল দেশে দুঃস্থ জনগণের জন্য এই ডাল বেঁচে থাকার প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭০ সালে ইথিওপিয়ার গোন্ডার অঞ্চলে মহামারী দেখা দিয়েছিল এবং ১ শতাংশ মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাদ্যাভাবে খেসারি দৈনিক খাবার হিসেবে আফগানিস্তানে গ্রহণ করা হতো এবং ল্যাথাইরিজম মহামারী আকারে দেখা দেয়। আফগানিস্তানে দুর্ভিক্ষের কারণে খাদ্য তালিকায় খেসারি আনা হচ্ছে, যা যেকোনো মুহূর্তে ল্যাথাইরিজমের মহামারী সৃষ্টি করতে পারে।
খেসারি ডাল খেলেই যে ল্যাথাইরিজম হয়ে যাবে তা নয়। খেসারি ডাল, খেসারি থেকে তৈরি আটা ইত্যাদি যদি দৈনিক খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধাংশ থাকে এবং টানা তিন থেকে ছয় মাস গ্রহণ করা হয় তাহলে ল্যাথাইরিজম হবার ঝুঁকি প্রায় ৮০ শতাংশ।
কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
মহিলাদের চেয়ে পুরুষের আক্রান্ত হবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে যাদের বয়স মোটামুটি ২৫-৪০ এর মধ্যে।
রিস্ক ফ্যাক্টর
- অপরিপক্ক এবং সিদ্ধ ডাল খেলে
- খেসারি গাছের অংশসহ রান্না করে খেলে
- রক্তের গ্রুপ ‘ও’ (+ বা -) হলে।
লক্ষণ
ল্যাথারিজমের লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই শুরু হয়। প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো:
- হাঁটতে অসুবিধা হওয়া
- অসহনীয় ব্যথা
- পা অবশ হয়ে যাওয়া বা ঐরূপ অনুভূতি
ধীরে ধীরে মাংসপেশির অসাড়তা শুরু হয়, যা কোনোভাবেই ঠিক হয় না। এরপর শুরু হয় অঙ্গ-সঞ্চালন অক্ষমতা এবং অনিয়ন্ত্রিত কম্পন। এছাড়া হাঁটুবন্ধনে ব্যথা হতে পারে, ভারি হয়ে যেতে পারে এবং পেশি টেন্ডন শক্ত হয়ে যেতে পারে।
ল্যাথাইরিজমের ধরণ
দুই ধরনের ল্যাথাইরিজম দেখা দিতে পারে- অ্যাঞ্জিওল্যাথাইরিজম এবং অস্টিওল্যাথাইরিজম।
অ্যাঞ্জিওল্যাথাইরিজম
ল্যাথাইরিজমে শুধুই পঙ্গু হয়ে যায় তা নয়, আকস্মিক মৃত্যুও ঘটতে পারে যদি অ্যাঞ্জিওল্যাথাইরিজম হয়ে থাকে। কেননা এক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্বারা অ্যাওর্টার স্থিতিস্থাপকতা পরিবর্তিত হয়ে ‘অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম’ হতে পারে।
অস্টিওল্যাথাইরিজম
এক্ষেত্রে দৈহিক কঙ্কাল গঠনে বাধা সৃষ্টি হয়, ফলে হাড় এবং তরুণাস্থি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে এবং দেহ অদ্ভুত গড়নে রূপ নেয়। বাচ্চারা এতে আক্রান্ত হলে কঙ্কাল গঠনে এবং মস্তিষ্কের গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
প্রতিকার
ল্যাথাইরিজম সাধারণত ভালো হয় না। তবে টলপেরিসনের মতো মাংসপেশি শিথিল করার ওষুধগুলো অসাড়তা কিছুটা কমাতে পারে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত এর জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ সম্পর্কে জানা যায়নি।
প্রতিরোধ
ল্যাথাইরিজম প্রতিরোধের প্রধান উপায় হতে পারে খেসারি ডাল খাওয়া বন্ধ করা। তবে এতে করে হিতে বিপরীতও হতে পারে। বন্যাদুর্গত এবং খরা অঞ্চলে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে সহজেই ল্যাথাইরিজম প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
- ভালো করে পানিতে ফুটিয়ে বা গরম পানি দিয়ে বারবার ধুয়ে বিষাক্ত ভাবটা কমিয়ে আনা যায়;
- ১৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ১৫-২০ মিনিট ভেজে নিলে ৮০ শতাংশ বিষাক্ত রাসায়নিক মুক্ত হয়ে যায়;
- সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে রান্নার আগে সেই পানি ফেলে তারপর ভালভাবে রান্না করলে ৯০ শতাংশ বিষাক্ততা কমে যায়।
প্রতিরোধের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে খেসারি চাষ করা হবে এর পুষ্টিগুণের জন্য, কিন্তু সেটা হবে এর বিষাক্ততা দূর করে। এক্ষেত্রে জিনগত পরিবর্তন আনতে পারলে নিরাপদ খাদ্যশস্য হিসেবে কম দামে সহজেই সর্বস্তরের মানুষ গ্রহণ করতে পারবেন।
খেসারি ডাল কি ল্যাথাইরিজমের একমাত্র কারণ?
২০১৩ সালে ভারতের দু’টি প্রতিষ্ঠান, ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স এবং বেনারাস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, এর স্নায়ুবিশারদগণ একটি গবেষণা চালান এ বিষয়ে। তারা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন ল্যাথাইরিজমের একমাত্র কারণ ডাল খাওয়া হতে পারে না। ড. বিজয় নাথ মিশ্র এর তত্ত্বাবধানে এ গবেষণা চালানো হয়। গবেষক দলটি প্রায় ৬০০ জনের উপর গবেষণা করেন যাদের মধ্যে ৫০০ জনই নিউরোলজি বহির্বিভাগের রোগী ছিলেন এবং তারা ছিলেন উত্তর প্রদেশ ও বিহারের অধিবাসী। বাকি ১০০ জন ছিলেন এমন রোগী, যাদের খেসারি ডাল খাবার খাওয়ার রেকর্ড রয়েছে এবং ল্যাথাইরিজমের রোগী হিসেবে আগেই শনাক্ত হয়েছেন।
দেখা গেল, ঐ ১০০ জন এমন পরিবারে বাস করতো যেখানে ৫-১৫ বছর ধরে খেসারির ডাল প্রতিদিন খেয়ে এসেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ৮২ জনেরই কোনো স্নায়বিক বা ক্লিনিক্যাল ডিজঅর্ডার নেই। গবেষণায় আরো দেখা যায়, ৬০০ জনের মধ্যে ৪% রুটিন করে খেসারির ডাল গ্রহণ করেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, খেসারির ডাল খাবার পাশাপাশি অপুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব এবং এরূপ আরো কিছু ফ্যাক্টর একত্রিত হলে ল্যাথাইরিজমে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। গবেষক দল আরো বলেন, মানবদেহের X ক্রোমোসোম এই ল্যাথাইরিজম রোগের প্রতিরোধে কাজ করে, তাই নারীদের চেয়ে পুরুষেরাই বেশি আক্রান্ত হয়।
ভারতে প্রায় ৫৫ বছর খেসারি নিষিদ্ধ ছিল। সেই ১৯৬১ সালে পক্ষাঘাতের কারণ উল্লেখ করে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল যা ২০১৬ সালে তুলে নেয়া হয়। বাংলাদেশে এখন খেসারি ডাল খাবার প্রবণতা কমে গিয়েছে। তবে গবাদি পশুকে খাদ্য হিসেবে এখনো এটি দেওয়া হয়। আরো তথ্যপূর্ণ গবেষণা প্রয়োজন ল্যাথাইরিজম নিয়ে। তাহলেই নেয়া যেতে পারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।