তাবত দুনিয়া যখন করোনাভাইরাসের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করে মুক্তির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে, একমাত্র প্রকৃতিই তখন মুক্তির আনন্দে হেসে উঠেছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের কম-বেশি সব শহরই লকডাউনের কারণে অচল অবস্থায় রয়েছে। মানুষের গৃহবন্দী হওয়ার সাথে সাথেই প্রকৃতি যেন তার আপন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। প্রকৃতি নিজেই যেন সবুজায়নের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। চারদিকেই এখন শুধু সবুজের সমারোহ। শুধু যে উদ্ভিদরাজিই নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করে চলেছে, তা-ই নয়; সেই সাথে প্রাণীকূলও হেসে উঠেছে মুক্তির স্বাদ পেয়ে। সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন প্রাণীর পদচারণা এখন নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে গিয়েছে।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে মানুষের কার্যক্রম লাঘব হওয়া এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দূষণের মাত্রা কমে যাওয়া। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের কক্সবাজারে আগে যেখানে বালুর সাগর ছিল, সেখানে সৈকতের অনেক জায়গাতেই জানা-অজানা অনেক গাছ দেখা যাচ্ছে। রঙ-বেরঙের বাহারি ফুলের কারণে সৈকতের পরিবেশই পাল্টে গিয়েছে। এমনকি সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে একদল ডলফিনের জলকেলি এখন নিয়মিত দৃশ্য। রাতারাতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত বদলে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সৈকতে মানুষে পদচারণা কমে যাওয়া। মানুষ না যাওয়ার কারণে সৈকত এখন প্লাস্টিকসহ যাবতীয় সকলপ্রকার বর্জ্য থেকে মুক্ত।
পাশাপাশি, নৌযানগুলোর উপস্থিতি কমে যাওয়ায় একদিকে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ যেমন তীরবর্তী হচ্ছে, তেমনি তাদের শিকার করতে ডলফিনগুলোও সৈকতের পার্শ্ববর্তী হচ্ছে এবং নিরিবিলি পরিবেশের কারণে আপন খেলায় মেতে উঠছে। আবার ধরা যাক ভেনেটিয়ান ক্যানেলের কথা, যার পানি এখন এতটাই স্বচ্ছ যে, মাছ পর্যন্ত দেখা যায়। এর কারণ মূলত- বোট ট্রাফিক কমে যাওয়ায় তলানি বা সেডিমেন্ট এখন তলদেশে বসে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। ফলে, পানি স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে। কলকারখানা এবং নৌযানগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ থাকায় পানি দূষণ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই জলজ পরিবেশেও আসছে বিশাল পরিবর্তন।
বিশ্বের প্রায় সব বড় শহরের পাশাপাশি পর্যটন শহরগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা শব্দদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্ণনামতে গোটা ইউরোপ জুড়ে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ শব্দ দূষণের কারণে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। শব্দ দূষণ যে শুধু মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে তা-ই নয়, এটি প্রাণীকূলের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। যেমন- বাংলাদেশের সামুদ্রিক কাছিমের জন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কিছু নির্দিষ্ট স্পট রয়েছে, যেখানে মা কাছিমেরা ডিম পেড়ে যায়। অভয়ারণ্য হওয়া সত্ত্বেও শব্দ দূষণের কারণে এবং লোকদের আনাগোনার জন্য অনেক কাছিমই ডিম না পেড়েই চলে যেত। কাছিম ছানারা ডিম ফুটে বের হয়ে সাধারণত সমুদ্রের পানিতে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়।
কিন্তু পর্যটকের আনাগোনার জন্য বিভিন্ন হোটেলের বা রাস্তার আলো তাদেরকে প্রায়ই ভুল পথে চালিত করত, মানে তারা সমুদ্রের দিকে না গিয়ে উল্টো শহরের দিকে যাত্রা করত। খুব কম সংখ্যকই তাদের ভুল শুধরে আবার সমুদ্রে নামতে পারত। কিন্তু বর্তমানে মানুষের আনাগোনা না থাকায় এবং শব্দ দূষণ না থাকায় মা কাছিম যেমন নিশ্চিন্ত মনে ডিম পেড়ে যেতে পাড়ছে, কাছিম ছানারাও নির্বিঘ্নে সমুদ্রে যেতে পারছে। কাছিম ছানার এই অবাধ বিচরণ এই সৈকতকে এক অন্য সৈকতে পরিণত করেছে; অথচ আজ থেকে মাস কয়েক আগেও জায়গাটা কাছিম ছানার জন্য ছিল রীতিমতো মৃত্যুফাঁদ।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে আরোপিত লকডাউনের সবচেয়ে বড় সুফল বলা যায়, সমগ্র পৃথিবীর সব মানুষই এখন দূষণমুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে- সমগ্র পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ মারা যায় বায়ু দূষণের ফলে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে। শুধু তা-ই নয়, শহরে বসবাসকারী শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষ এমন বায়ুর সংস্পর্শে আসে, যা বায়ুমানের নিরাপদসীমার চেয়ে অনেক বেশি। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর অবস্থা এক্ষেত্রে আরো খারাপ, যেখানে ৯৮ শতাংশ শহরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার মধ্যে বায়ুমান রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির (সেন্টিনেল- ৫পি) উপগ্রহের পাঠানো তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে এশিয়া ও ইউরোপের শহর এবং শিল্পাঞ্চলগুলোতে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কম। যুক্তরাজ্যে ২৩ মার্চ দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার দু’সপ্তাহ পর কিছু কিছু শহরের নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের দূষণের মাত্রা ২০১৯ সালের সমসাময়িক সময়ের থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
তাছাড়া, নাসার তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে নিউ ইয়র্কসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব দিকের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড দূষণের পরিমাণ ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মাসিক গড়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম ছিল। চীন একাই এশিয়ার সমস্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের ৫০ শতাংশেরও বেশি নির্গত করে। এক টন কমানোর জন্য প্রতি বছর ৬২টি গাড়ি কমানোর প্রয়োজন, যা বর্তমানে মহামারির ফলে নির্গত হচ্ছে না। সুতরাং, এটা সহজেই অনুমেয় যে, গোটা চীন জুড়ে কমবেশি ১০ শতাংশ নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাস পাওয়া মানে প্রায় ৪৮,০০০ গাড়ি রাস্তায় না নামানোর সমতুল্য; তবে কিছু কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গমন, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে ২০১৯ সালের চেয়ে ৪০ শতাংশে হ্রাস পাওয়া মানে প্রায় ১,৯২,০০০টি গাড়ি অপসারণের সমান।
সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাস্টেইনেবিলিটি সায়েন্সের গবেষক কিম্বারলি নিকোলাসের মতে,
“বিভিন্ন কারণে নির্গমন কমে যাওয়াটা হল প্রথম বিবেচ্য বিষয়। যেমন, পরিবহন ব্যবস্থা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ২৩% করে থাকে। এই নির্গমনের মাত্রা কমে যাওয়া সেসব দেশে স্বল্পমেয়াদে হয়েছে, যাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, যেমন- লোকজনের নিজেদের ঘরে রাখার কারণে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ কমেছে। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলোর নির্গমনের মূল অবদানকারী হলো গাড়ি চালনা এবং বিমান চালনা, মোট পরিবহন খাতের যথাক্রমে ৭২ শতাংশ ও ১১ শতাংশ নির্গমন হয় এই দুটি থেকে।”
সাম্প্রতিককালের এই বায়ুমানের উন্নয়ন চিরস্থায়ী করতে গেলে জীবাশ্ম জ্বালানিকে নবায়নযোগ্য শক্তি এবং অন্যান্য অল্প-কার্বনযুক্ত শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করতে হবে। স্বল্প সময়ের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ কোভিড-১৯ এর কালো আকাশে এক চিলতে আলো হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য এটা আমাদের একটা বার্তা হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর, তথা প্রকৃতির যত্ন না নিতে পারা মানে কিন্তু নিজেদেরই যত্ন না নিতে পারা। পরিবেশ দূষণের কারণে সমগ্র পৃথিবীতে শুধু মানুষ যে মারা যাচ্ছে তা-ই নয়, নিত্য নতুন রোগ-ব্যাধিরও জন্ম হচ্ছে, যাতে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর দিকে নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে।