আমাদের দেশে ‘ছেলেধরা’ নামে একটি বিষয় খুব করে প্রচলিত আছে। এই ছেলেধরারা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। কথিত আছে, পাচারকৃত সেসব শিশুদের মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে গিয়ে উট দৌড়ের জকি বা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়সওয়ার বানানো হয়। যেসব শিশু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জকি হিসেবে কাজ করে তাদের বেশিরভাগই হয় পাচারকৃত আর বর্তমানে সমগ্র দুনিয়াতে বিনোদনের জকি হিসেবে কাজ করছে যেসব শিশু তাদের প্রায় সকলেই কাজ করছে স্বেচ্ছায়। তারা জানেও না কীভাবে তারা মিটাচ্ছে অন্যের বিনোদনের খোরাক।
ভোগের সংস্কৃতি
যেকোনো সমাজের মানুষের আচার-আচরণ, ভাষা, বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, নৈতিকতা বোধসহ সমাজ জীবনে বসবাসের জন্য ব্যবহৃত প্রতিটি বিষয়বস্তুর সহযোজনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে তার সংস্কৃতি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ব্যক্তি নিজেই তার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ব্যক্তির চালচলন, কথাবার্তা, আচরণের মাধ্যমে তার সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা সাধারণত গুরুজনকে ‘আপনি’, ঘনিষ্ঠজনকে ‘তুমি’ এবং বয়োঃকনিষ্ঠদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে থাকি। এটিই আমাদের সংস্কৃতি। পূর্বে পরিবারের সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়েদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবে এমনটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে সন্তানদের সাথে পিতা-মাতার ঘনিষ্ঠতার দরুন তা ’তুমি’তে পরিণত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক, লেখক ড. গোলাম মুর্শিদ বলছেন, ‘সংস্কৃতি একটি প্রবাহমান নদীর মতো’। অর্থাৎ নদী যেমন সর্বদা প্রবাহমান তেমনি সংস্কৃতিও নদীর মতোই প্রবাহমান। সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতিও বদলে যায়। যেকোনো নতুন কিছুকে যদি একটি অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের অংশ করে নেয় তবে কালের বিবর্তনে তা সে সংস্কৃতির অংশ হয়ে যেতে পারে। সে কারণেই তাদের মূল টার্গেটে রয়েছে শিশুরা। কেননা আজকের শিশুদের যা শেখানো হবে সামনের সময়ে তারা সে পথেই এগুবে। তাই যদি আজকের শিশুদের মধ্যে ভোগের একটি সংস্কৃতি তৈরি করা যায় তাহলে তো কথাই নেই!
শিশু পৃথিবীর সকল জটিলতাকে সাথে নিয়ে জন্ম নেয় না। জন্মানোর পর ধীরে ধীরে সেগুলোর সাথে পরিচিত হয়। তাই তুলনামূলক প্রাপ্ত বয়স্কের তুলনায় তার স্বার্থবোধ কম থাকে। তারা তাকেই ভালো বলে, যা কিছুকে তারা ভালভাবে গ্রহণ করতে শেখে। যা কিছুকে অপছন্দ করে তাকে বলে খারাপ। কোমলমতি শিশুদের এই সরলতা কর্পোরেট গ্যাংদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে শিশুদের সারল্যকে ব্যবহার করে সার্বিক সারলিকীকরণের বাণিজ্য চলছে। নিষ্পাপ শিশুদের মাধ্যম করে চলছে মানুষের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা। কারণ একটাই, মুনাফা! তাই বিজ্ঞাপন দেখে বাবা-মায়ের ছোট্ট শিশুটিকেও পেয়ে বসছে স্টারডমের নেশা। টেলিভিশন চিত্রের পণ্যটির চাহিদা তৈরি হচ্ছে তার নিজের মধ্যেও। মুনাফাবাজরা বুঝে গেছেন যে, প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও শিশুরা পারে না। তাই বাবা-মায়েদের বাধ্য হয়েই শিশুর আবদার পূরণ করতে হয়। তাদের চোখে একটি শিশুর জন্ম মানেই একটি ভোক্তারও জন্ম। শিশুদের মধ্যে ভোগের সংস্কৃতি চালু করতে পারলেই তা চলবে আরও যুগ-যুগান্তর ধরে। এতে লাভবান হবে মুনাফাবাজরাই। তাই টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন মানেই শিশুদের ছড়াছড়ি।
শিশুদের পণ্যায়ন ও পরিণতি
টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বিভিন অনুষ্ঠানে প্রচারিত হচ্ছে রিয়েলিটির শো’র নামে বিভিন্ন নাচ-গানের অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে প্রতিভা বিকাশের নামে চলছে শিশুদের অবাধ পণ্যায়ন। অভিভাবকরা মনে করছেন, আমার সন্তান নাচ-গান নিয়ে ব্যস্ত থাকুক, তাহলেই হয়তো সে রাজনীতি কিংবা মাদকমুক্ত থেকে ভালো থাকবে। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ঘটছে তার উল্টোটাই। শিশুদের মধ্যে তৈরিকৃত প্রতিযোগিতার নেশা অনেক ক্ষেত্রে বিধ্বংসী রুপ ধারণ করছে। কেউ কেউ মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে।
শিশুদের নাচ-গান করতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই তৈরি হয় যখন তা বাণিজ্যিক উদ্দেশে করা হয়। শিশু যখন প্রাপ্তবয়স্ক কোনো নায়িকার পরিবর্তে নিজেকে উপস্থাপন করে কোনো গানের দৃশ্যায়নের ছলে, তখন তা যাদুর বাক্সের সামনে উপবিষ্ট বাকি শিশুদেকেও প্রভাবিত করে। শিশুরা তখন নায়ক কিংবা নায়িকার জায়গায় নিজেকে ভাবতে চায় এবং প্রাপ্তবয়স্কের স্থলে শিশুর উপস্থাপনের ফলে সেই ভাবনা শিশুর মধ্যে স্থায়ী হবার সুযোগ পায়। এসবের বাইরেও দর্শক মাতানোর জন্য কখনো করা হয় কঠোর সমালোচনা, যার স্নায়ুচাপ সহ্য করতে পারে না অনেক কোমলমতি শিশুই। পশ্চিমবঙ্গের শিঞ্জিনী সেনগুপ্ত এমন এক প্রতিযোগী যিনি বিচারকের কঠোর সমালোচনা সইতে না পেরে হারিয়েছিলেন মানসিক ভারসাম্য। এছাড়া বিভিন্ন স্টুডিওতে অনেক প্রতিযোগীর আত্মহত্যার চেষ্টার মতো ঘটনাও রয়েছে প্রচুর।
রিয়েলিটি শোগুলোতে শিশুদেরকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলার চেষ্টার ফলে তাদের মধ্যে অল্প বয়সেই তৈরি হচ্ছে যৌনবোধ। অল্প শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষেরা শিশুদের মাধ্যমেই মেটাতে চাইছেন তাদের সুপ্ত অভিলাষ। ফলস্বরূপ পূর্বের যেকোনো সময়ের চাইতে শিশু ধর্ষণের পরিমাণ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীদের তো আগে থেকেই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেই তালিকায় বর্তমানে শিশুদেরও কাজ করতে হচ্ছে মুনাফার জকি হিসেবে।
তার মানে কি শিশুদের নাচ-গান শেখা উচিত নয়? উত্তরটি অবশ্যই ‘উচিত’। শিশুরা অবশ্যই তাদের পছন্দমতো নাচ-গান শিখবে। কিন্তু যখনই তা হয়ে যায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তখনই তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অস্ট্রেলিয়ান এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব রিয়েলিটি অনুষ্ঠান দেখার ফলে শিশুদের জীবন স্বাভাবিক শিশুদের মতো থাকে না, তাদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়সেই জন্মায় যৌনতার অনুভূতি, যা যেকোনো শিশুর জন্যই ক্ষতিকর এবং বিপদজনক। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুরা নাম, খ্যাতি, পণ্যকেই নিজেদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ভাবতে শুরু করে, যার ফলে ব্যহত হয় তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
শিশুদের দিয়ে কর্পোরেট ফায়দা লুটেরার দল সব জায়গাতেই পার পেয়ে যাচ্ছে এমন নয়। বিভিন্ন দেশে এর বিরুদ্ধে নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে হয়েছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। অস্ট্রেলিয়ায় শিশুদের পণ্যায়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা রয়েছে। শিশুদের অনুষ্ঠান প্রচারও সেই নীতিমালার আওতায় পড়ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, শিশুদের সম্প্রচারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রচারে কোনোভাবেই শিশুদের যৌনসামগ্রী হিসেবে প্রচার করা না হয় এবং এমন অস্বাভাবিক কোনো কিছু প্রদর্শন করা না হয় যা অন্য শিশুরা স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর প্রতিবাদ হচ্ছে। ভারতের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে দাবী উঠছে শিশুদের এসব প্রতিযোগিতায় অংশ না নেয়ার। বাংলাদেশেও প্রতিবাদ হচ্ছে, তবে সেই প্রতিবাদের জোরটা এখনও অনেক কমজোর। বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এসবের ব্যাপারে স্পষ্ট বিধিবিধান আরোপের কথা বলছেন। কিন্তু সংখ্যাটা নিতান্তই কম হওয়াতে তা এখনো সরকারের টনক নড়াতে ব্যর্থ।
শুরুতে সংস্কৃতির কথা বলছিলাম। সংস্কৃতি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষের আচার-আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। টেলিভিশন আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। প্রাপ্তবয়স্ক থেকে শিশু, সবাই বসছে এর সামনে। যা কিছু দেখছে তার প্রভাব তার ব্যক্তি জীবনেও পড়ছে। তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের মুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে সামনে আরও নৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর নিয়মিত কলাম লেখক ও সাহিত্যিক ফারুক ওয়াসিফ তার ‘বাসনার রাজনীতি কল্পনার সীমা’ বইতে বলছেন,
“ইতিহাসে স্বর্ণযুগ চিহ্নিত থাকে, কিন্তু আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের সূচনায় কোনো ঘণ্টা বাজে না। নীরবেই তা শুরু হয়ে যায়। এক চীনা জল্লাদের সাধনা ছিল, এমনভাবে মানুষের মাথা কাটা, যাতে তারা টেরও না পায়। বছরের পর বছর তিনি সূক্ষ্মভাবে মানুষের মাথা কাটার সাধনা চালিয়ে গেলেন এবং একদিন এত নিখুঁতভাবে একজনের মাথা কাটলেন যে হতভাগা লোকটি কিছু টের না পেয়ে প্রশ্ন করে, “কই আপনি তো কিছু করছেন না।” জল্লাদ মহাশয় সাধুপুরুষের মতো হেসে বললেন, “জনাব, মাথাটা একটু ঝাঁকান, টের পাবেন।” ঝাঁকুনি না খেলে আমরাও বুঝবো না, আমাদেরও মাথা বিনোদনের রেশমি সুতোর খাঁড়ায় কত সুকৌশলে কাটা পড়ছে”।
ফিচার ইমেজ – দ্য হলিউড রিপোর্টার
তথ্যসূত্র- বাসনার রাজনীতি কল্পনার সীমা, প্রবন্ধ: রিয়েলিটি শো, লেখক: ফারুক ওয়াসিফ, পৃষ্ঠা: ৩০-৩৪, প্রকাশ: ২০১৬, আগামী প্রকাশনী