৮৪২ বছর আগের এক জুন মাসের কথা। ১১৭৮ সালের ১৮ই জুনের ভ্যাপসা গরমের এক সন্ধ্যা ছিল সেটা। ঘটনাস্থল উত্তর ইংল্যান্ডের কেন্ট শহরের ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রাল। গির্জার সন্ন্যাসীরা তাদের সন্ধ্যার প্রার্থনা শেষ করে বাইরে খোলা মাঠে একটু বাতাস খেতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ তারা খেয়াল করলেন আকাশের চাদের কিছু একটা হয়েছে।
সেই সন্ধ্যায় আকাশে এক ফালি চাঁদ ছিল। নতুন চাঁদের মতো ছোট এক চিলতে অংশ প্রায় খাড়াভাবে আকাশে ঝুলে ছিল। উপর এবং নিচে, গরুর শিংয়ের মতো দুইটা অংশ দেখা যাচ্ছিল।
এরই মধ্যে সন্ন্যাসীরা দেখলেন, চাঁদের উপরের ফালির অংশটা দুই ভাগ হয়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, সে দুই ভাগের মাঝখান থেকে একটি জ্বলন্ত মশাল বেরিয়ে আসলো। স্ফুলিঙ্গ এবং ধোয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো চাঁদ জুড়ে। চাঁদটা বেশ কিছুক্ষণ সাপের মতো পাক খেয়ে মোচড়ামুচড়ি করলো। চাঁদের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পুরা অংশ ছাই রঙের হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ এই অবস্থায় থাকার পরে চাঁদ আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল।
ক্যাথিড্রালে তখন আবাসিকভাবে অনেক সন্ন্যাসী বাস করতেন। তারা নিয়মিত উপাসনা করতেন এবং ধর্মীয় গবেষণা করতেন। আমাদের দেশে যেমন সোমপুর বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চর্যাপদ লিখে গেছেন, প্রায় সে রকম ব্যবস্থা। ইংরেজি সাহিত্যে চর্যাপদের মতো তুলনীয় সাহিত্য হলো The Canterbury Tales, লিখেছিলেন Geoffrey Chaucer, যাকে ইংরেজি সাহিত্যের জনক বলা হয়। ক্যান্টারবেরি টেলস লেখা হয়েছিল ১৩৮৭ সালে। সেই ক্যান্টারবেরি টেলসের ২০০ বছর আগের ঘটনা ছিল এই চাঁদের বিস্ফোরণ।
চার্চে ক্রনিকলার নামে একটা পোস্ট ছিল। উল্লেখযোগ্য সকল ঘটনার সাল তারিখ সহ রেকর্ড রাখতো। ১১৭৮ সালে ক্যান্টারবেরি চার্চের ক্রনিকলার ছিলেন Gervasus Cantuariensis। তিনি এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার ক্রনিকলে।
দীর্ঘদিন এই ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৯৫০ এর পরে যখন একের পর এক রকেট চাঁদে যাওয়া শুরু করলো, তখন চাঁদের পৃষ্ঠের প্রচুর ছবি বিজ্ঞানীদের হাতে আসে। দেখা গেল, সেখানকার মাটিতে প্রচুর খাদ বা গর্ত রয়েছে। লাখ লাখ বছর ধরে অনেক গ্রহাণু বা ধূমকেতু চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে এই গর্ত করেছে বলে ধারণা করা হয়।
মহাশূন্যে প্রচুর গ্রহাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই গ্রহাণুরা হলো বিভিন্ন ধূমকেতু বা অন্যান্য গ্রহের অবশিষ্ট অংশ। বৃহস্পতি আর মঙ্গল গ্রহের মাঝে এই গ্রহাণুর সংখ্যা অনেক বেশি। এই অঞ্চলকে এ্যস্টেরয়েড বেল্ট বলে। এরা সূর্যের চারদিকে নিজের কক্ষপথে ঘোরে। তবে মাঝে মাঝেই তাদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে অন্যদিকে চলে আসে। পৃথিবীর আশেপাশেও মাঝে মাঝে গ্রহাণু চলে আসে। এগুলো বিভিন্ন আকারের হতে পারে। কয়েক সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এই গ্রহাণুরা ঢুকে পড়লেই বাতাসের সাথে ঘষা খেয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। গ্রহাণুগুলো পুড়ে যায়, পৃথিবীর মাটিতে ছাই হয়ে পড়ে যায়। আকাশে মাঝেই মাঝেই এ রকম কিছু সময়ের জন্য আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এদেরকেই উল্কা আঞ্চলিক ভাষায় তারা খসা বলে।
মহাশূন্যে বাতাস নেই। এ কারণে সেখানে প্রচণ্ড গতিতে গ্রহাণুগুলো চললেও আগুন ধরে না। পৃথিবীর পৃষ্ঠের কয়েক কিলোমিটার উপর পর্যন্ত বায়ুমণ্ডল আছে। এর মধ্যে প্রচণ্ড গতি নিয়ে কোনো বস্তু ঢুকে পড়লে বাতাসের সাথে ঘর্ষণে অনেক তাপ উৎপন্ন হয়। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আছে প্রচুর। প্রচুর তাপ আর অক্সিজেন মিলিয়ে গ্রহাণুটায় আগুন জ্বলে ওঠে।
তবে মাঝে মাঝে কিছু বড় আকারের গ্রহাণুও ঢুকে পড়ে। তারা এতই বড় হয় যে আগুন ধরে গিয়ে পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে যায় না। কিছু অংশ মাটি পর্যন্ত চলে আসে। মাটিতে আছড়ে পড়ে তার মধ্যে গর্ত বা ক্র্যাটার তৈরি করে।
গত কয়েক কোটি বছরে পৃথিবীতে প্রচুর ধূমকেতু বা গ্রহাণু এসেছে। অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেসব গর্তের অধিকাংশই পূরণ হয়ে গেছে প্লেট টেকটোনিক্স সক্রিয়তার কারণে কিংবা বায়ুপ্রবাহ বা জলীয় স্রোতের কারণে। তবে এখনো অনেক গর্তের আলামত আছে। মেক্সিকোর Chicxulub crater এ রকম একটা বড় গর্ত, যেখানে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে একটা বড় গ্রহাণু এসে আছড়ে পড়েছিল। এর ফলে ডাইনোসর সহ পৃথিবীর অধিকাংশ জীব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
তবে চাঁদে যেহেতু কোনো বায়ুমণ্ডল বা অক্সিজেন নেই, তাই চাঁদে উল্কা বা গ্রহাণু ঢুকে পড়লে আগুন জ্বলে। সরাসরি পৃষ্ঠে পড়ে গর্ত তৈরি করবে। আর চাঁদে যেহেতু কোনো বায়ুমণ্ডল নেই, পানি নেই, নদীর স্রোত নেই, প্লেট টেকটোনিকস নেই তাই এর ক্রেটারগুলো বছরের পর বছর প্রায় অবিকৃত অবস্থাতেই থাকে।
চাঁদের উত্তর পূর্ব অংশে ২২ কিলোমিটারের একটা ক্র্যাটার পাওয়া গেল। মধ্যযুগের জ্যোতির্বিদ জিওর্দানো ব্রুনোর নাম অনুসারে এর নাম রাখা হলো জিওর্দানো ব্রুনো ক্র্যাটার। ১৯৭৬ সালে জিওলজিস্ট Jack B. Hartung খেয়াল করলেন, এই ক্র্যাটারের অবস্থানের সাথে ক্যান্টারবুরির সন্ন্যাসীদের পর্যবেক্ষণ মিলে যায়। একটা ধূমকেতু বা গ্রহাণু যদি চাদের খুব কাছে আসে, সেক্ষেত্রে সন্ন্যাসীরা দুইটা চাঁদ ভেবে ভুল করতে পারেন। কিংবা চাঁদ দুই ভাগ হয়ে গেছে ভেবেও ভুল করতে পারেন।
গ্রহাণুটা চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ার পরে প্রচুর পাথর-খণ্ড ও ধুলোবালি বাতাসে উড়ে। সন্ন্যাসীদের পরবর্তী বিবরণ (পুরা চাঁদ ধুলোয় ঢেকে গিয়ে ছাই বর্ণ হয়ে গিয়েছিল) এর সাথেও সেটা মিলে যাচ্ছে। যথেষ্ট বড় আকারের ধূমকেতু যদি চাঁদকে আঘাত করে, তাহলে সেটা তার নিজের কক্ষপথ থেকে একটু সরে যাবে। চাঁদ মোচড়ামুচড়ির ব্যাখ্যা সেটাই হতে পারে।
তবে এই হাইপোথিসিসের কিছু ত্রুটি রয়েছে। যেমন-
১১৭৮ সালের ১৮ই জুন চাঁদে যদি ধূমকেতু বা উল্কাপাত ঘটে, তবে প্রচুর পরিমাণে পাথর-খণ্ড চাঁদ থেকে ছিটকে মহাশূন্যে যাওয়ার কথা। এদের মধ্যে অনেক পাথর-খণ্ড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও পড়ার কথা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকলে বাতাসের প্রচণ্ড ঘর্ষণের কারণে আগুন জ্বলে উঠার কথা। যেটাকে উল্কাপাত বা প্রচলিত ভাষায় তারা খসা বলে। ১১৭৮ সালে এত বড় একটা ঘটনা চাঁদের বুকে ঘটলে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পৃথিবীতে অনেক বেশি উল্কাপাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। বাগদাদ, ভারত কিংবা চীনের কোনো লিখিত ইতিহাসেই সে সময়ে এমন কোনো উল্কা বৃষ্টির কথা পাওয়া যায়নি।
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাজাগতিক বড় কোনো ঘটনা (যেমন- চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, বা ধূমকেতুর আগমন) বিশ্বের সব জায়গা থেকেই কম বেশি দেখা যায়। একাধিক জাতির পুরনো ইতিহাস বা ছবিতে সে সকল ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীদের চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হতে দেখার ঘটনার বিবরণ আর কোথাও পাওয়া যায় না।
এসব দিক বিবেচনা করে ক্যান্টারবেরি সন্ন্যাসীদের ঘটনার আরেকটি নতুন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাখ্যাটা হলো- সে সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটা উল্কাপাত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের কেন্টের আকাশ থেকে দেখে মনে হয়েছিল, উল্কাটা ঠিক চাঁদ বরাবর ঘটেছে। এ কারণে ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীরা লিখেছিলেন, যে চাঁদে ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিশ্বের অন্য এলাকার মানুষ দেখেছে, চাঁদ থেকে বহুদূরে আকাশের অন্য জায়গায় একটা উল্কাপাত ঘটেছে। এ কারণে সেই গুরুত্বহীন ঘটনাটা কেউ আর লিখে রাখেনি।
২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টায় রাশিয়ার সেলিয়াবিনস্ক শহরের আকাশে ৬৬ ফুট ব্যাসার্ধের একটা গ্রহাণু আছড়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখছিল, হঠাৎ কোথা থেকে আকাশে একটা আগুনের গোলা আসছে, এবং সেটা ক্রমাগত বড় হচ্ছে । কয়েক সেকেন্ডের জন্য সূর্যের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতে পায় শহরবাসী। মাটিতে পড়েনি এটা, আকাশেই আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয় (মাটি থেকে ২৭ কিলোমিটার উপরে)। সেই বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে মানুষের কানে তালা ধরে যায়, শব্দের শক ওয়েভে বাসার জানালার কাচ বা দুর্বল কাঠামো ভেঙে যায়। এ ঘটনায় কেউই নিহত হয়নি, তবে সে সময়ে মানুষজন প্রচণ্ড আতংকিত হয়েছিল।
ইউটিউবে সে মুহূর্তের বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওগুলাতে দেখা যায়, গ্রহাণুটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পরে আকাশের কিছু অংশ ধোয়ায় ঢেকে গিয়েছিল।
১১৭৮ সালের ১৮ই জুন এ রকম ছোট কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিল এবং ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীরা সেটা দেখেই ভয় পেয়েছিলেন বলে অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের অভিমত।