মানুষের প্রতিদিনকার কাজের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হলো সড়ক। চাই বা না চাই, এই একটি জিনিসের ব্যবহার মানুষকে করতে হবেই। পুরকৌশল বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পরিবহন প্রকৌশল। এই বিষয়ের ভিতরে আছে সড়কের নিরাপত্তা, সড়ক ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা, সড়ক ব্যবহারের এবং নকশার কৌশলাদি, রক্ষণাবেক্ষণ, সড়কের সাথে জড়িত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই প্রকৌশল বিষয়ের উপর গবেষণা অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। এই বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের সড়কের প্যাটার্ন। একটি আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের প্যাটার্ন কেমন হবে সেটাই হচ্ছে এ শাখার মূল আলোচ্য বিষয়। এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণার কারণে বিভিন্ন নকশার সড়কের ব্যবহার উন্নত বিশ্বে শুরু হয়ে গেছে।
যেকোনো এলাকার সড়কের প্যাটার্নকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: নিচের ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে কোন জায়গা থেকে ভ্রমণ শুরু করলে লোকাল রোড ধরতে হবে। এই রোড কালেক্টরে গিয়ে মিলিত হয়। কালেক্টর দিয়ে ঐ আবাসিক এলাকার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যাবে। কিন্তু অন্য কোনো এলাকায় যেতে হলে কালেক্টর দিয়ে আর্টারিয়াল রোডে গিয়ে উঠতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের সড়কের নকশার মধ্যে প্রধান তিনটি প্যাটার্ন নিয়ে এখন আলোচনা করা যাক।
গ্রিড আয়রন সড়ক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই ধরনের সড়কের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। মূলত সহজ নকশা, নিরাপদভাবে মানুষ ও পণ্য বহনের জন্য আদর্শ এবং কোথাও যাওয়া কিংবা আসার জন্য কম সময় নেয় দেখেই এই ধরনের নকশা প্রকৌশলীদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। যদিও যুদ্ধের পরে এই নকশার বিপক্ষে অনেক কথা হয় এবং অন্য ধরনের নকশার প্রস্তাব করা হয় [১]।
গ্রিড আয়রন সড়কের অনেকগুলো ইন্টারসেকশন থাকে। প্রকৌশলগত দিক দিয়ে এ ধরনের সড়কের উপকারিতা হচ্ছে যদি রাস্তার কোনো অংশে গাড়ির সমাবেশ বেশী হয়ে যায় বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে বা রাস্তা মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে, তখন ট্রাফিক খুব সহজে অন্য রাস্তা ধরে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। এতে গাড়ির চালকদের উপর মানসিক চাপ কমে যায় এবং অপরিচিত জায়গায় খুব সহজেই গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু এ ধরনের নকশার সমস্যা আছে। গ্রিড আয়রন সড়কের জন্য আবাসিক এলাকায় প্রশস্ত জায়গার প্রয়োজন হয়। এই প্রশস্ত জায়গাটিকে আবার এই নকশার সবগুলো রাস্তার জন্য সমানভাবে ভাগ করতে হয় যাতে করে গাড়ি কিংবা রিকশা যেকোনো রাস্তা যেকোনো সময় ব্যবহার করতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, এই ধরনের নকশায় অনেকগুলো ইন্টারসেকশন থাকে। যেকোন রাস্তায় এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। তাই যত কম পারা যায়, এ ধরনের নকশা এড়িয়ে চলা তত ভাল। এতে গাড়ির দুর্ঘটনা, পথচারী পারাপারের সময় দুর্ঘটনা কম ঘটে। আবার গাড়ির গতি এবং চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রায় প্রতিটি ছেদ এলাকায় সিগনাল বসাতে হয়, যা খরচ সাপেক্ষ এবং এজন্য উক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ জনবলের প্রয়োজন হয়, যা বিভিন্ন সময়ে যোগান না-ও দেয়া যেতে পারে [২]।
গ্রিড আয়রন সড়কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে এই নকশা ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করে। Through vehicles নামে পরিবহন প্রকৌশলে একটি কথা আছে। যেসব গাড়ি সামনে জ্যাম বা অন্য ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে ভেবে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে আবার আগের রাস্তায় মিলিত হয়, সেগুলোকে বলা হয় Through vehicle। প্রধান রাস্তায় যদি এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, তখন অনেক গাড়ি আবাসিক এলাকার শাখা রাস্তাগুলো দিয়ে যায়। যে কারণে আবাসিক এলাকার স্কুল জোন, শপিং জোন, হাসপাতাল জোনগুলোতে জ্যাম লেগে যায়। এতে ভ্রমণের সময় বেড়ে যায়। ঢাকায় উত্তরা এলাকাতে এই সমস্যা প্রকট। ট্রাফিক সিগনাল সেবা অত্যন্ত দুর্বল হবার কারণে সময়ে সময়ে এই সমস্যা অসহ্য হয়ে যায় [৩]।
লুপ এবং ললিপপ সড়ক
এ ধরনের সড়কগুলো অনেকটা বক্ররেখাবেষ্টিত পথ এবং লুপের সমন্বয়ে নকশা করা হয়। এই ধরনের নকশা এখন উন্নত দেশগুলোতে ব্যাবহার করা হচ্ছে, কারণ এই সড়কগুলো আবাসিক এলাকায় গাড়ির সীমিত প্রবেশ নিশ্চিত করে এবং অনেকটা বাধ্য করে। এ ধরনের সড়কে Through vehicle যাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। নকশার কারণে লোকাল ট্রাফিক তাদের গতি কমাতে বাধ্য হয়।
এই ধরনের নকশায় খরচ অনেক কম, কারণ জায়গা কম প্রয়োজন হয় এবং গাড়ির চলাচল কম থাকে বলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও কম দরকার পড়ে। গ্রিড আয়রন নকশার থেকে প্রায় ৫০% কম খরচ হয় ললিপপ নকশায় [৪]। আবার এ ধরনের নকশায় রাস্তার প্রস্থ, ফুটপাথের প্রস্থ ইত্যাদিও কম হয়ে থাকে।
ললিপপ নকশার রাস্তা যে কমিউনিটির মধ্যে তৈরি হয়, সেসব জায়গায় স্কুল, হাসপাতাল, শপিংমল ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে, যার কারণে ভ্রমণের সময় কমে যায়।
আরেক ধরনের রাস্তা আছে যেখানে Cul-de-sac লুপ ব্যবহার করা হয়। ১৯২৮ সালে নিউজার্সিতে Cul-de-sac প্রথম ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের রাস্তায় জায়গা কম লাগার সাথে সাথে ইউটিলিটি; যেমন: পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনে ২৫% কম খরচ লাগে।
এ ধরনের সড়কের সমস্যাও আছে। যেমন: বাসা থেকে গাড়িতে করে প্রধান রাস্তায় ওঠার জন্য সময় বেশী লাগে, কারণ কালেক্টর হয়ে, আর্টারিয়াল দিয়ে প্রধান রাস্তায় উঠতে হয় [৩]।
উন্নত দেশের গবেষণা কি বলে?
গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে যে, গ্রিড নকশার রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলোতে লুপ নকশার রাস্তা থেকে ৫৭% বেশী দুর্ঘটনা ঘটে। লুপ কিংবা ললিপপ জাতীয় নকশার রাস্তার মিড ব্লক জায়গাগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশী থাকে। অপর পক্ষে Cul-de-sac এবং ললিপপ দুটোর সমন্বয়ে তৈরি রাস্তায় দুর্ঘটনা গ্রিডের তুলনায় ৮৫% কম হয় [৫]।
Property Damage Only (PDO) জাতীয় দুর্ঘটনা লুপ বা ললিপপ নকশা ব্যবহার করলে কমে যায় কিন্তু গাড়ি-পথচারি বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কারণ বাঁকা রাস্তায় প্রায়ই অপর দিক দিয়ে আসা কোনোকিছু দেখতে অসুবিধা হয়। আবার কম গতির এলাকা দেখে মানুষের ভিতরও নিজের নিরাপত্তার বিষয় কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, যে কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাব্যতা বেড়ে যায়। তাই পথচারীদের জন্য লুপ বা ললিপপ কম নিরাপদ। গাড়ি চালকদের দৃষ্টিরেখা ও দূরত্ব এবং চালকের দুর্ঘটনা বুঝতে পারার অনুভূতি প্রতিক্রিয়া সময়– এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ললিপপ বা লুপ নকশায় মাথায় রাখতে হবে। কারণ গবেষণায় এরকম সম্ভাব্যতা দেখা দিয়েছে যে, লুপ বা ললিপপ জাতীয় রাস্তায় চালকের প্রতিক্রিয়া সময় অনেক সময় হ্রাস পেয়ে যায়। কিন্তু বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা এ ধরনের নকশায় অনেক কম থাকে [২]।
প্রধান দুটি সড়ক প্যাটার্ন নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল। নকশা করার সময় ঘুরে ফিরে এ দুই ধরনের রাস্তাই নকশা করা হয়, কিন্তু এর মধ্যে অনেক সময় কিছু আঙ্গিক পরিবর্তন আনা হয়, যা জায়গার উপর এবং সেখানকার ট্রাফিক ফ্লো’র উপর নির্ভর করে। আমাদের দেশেও লুপ এবং ললিপপ রাস্তা তৈরি করা যেতে পারে। এতে যানজটের পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যাবে বলে ধারণা করা যায়। বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় যেখানে স্কুল, কলেজ, অফিস ইত্যাদি বেশী পরিমাণে থাকে, সেসব জায়গাগুলোতে লুপের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তবে একবার গ্রিডে নকশা হয়ে গেলে এবং আশেপাশে দালানকোঠা তৈরি হয়ে গেলে এখানে পরিবর্তন আনা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাই কোনো প্রজেক্টের পরিকল্পনা পর্যায়ে রাস্তার নকশায় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। যে জায়গায় টাউন প্ল্যান করা হচ্ছে, সেই জায়গার উপর এবং উক্ত জায়গার কিংবা আশেপাশের ট্রাফিক ফ্লোয়ের উপর প্রাথমিক জরিপ করার পর গ্রিড, ললিপপ নাকি লুপ নকশা করা হবে, তা খুব সহজে বের করা যায়।
তথ্যসূত্র
[১] Wolfe, C. 1987. Streets Regulating Neighborhoods Form: A Selective History. In A. Moudon (Ed.), Public Streets for Public Use. New York: Van Nostrand Reinhold Co., Inc.
[২] Rifaat, S. M., 2012. Street Pattern and Traffic Safety. LAP LAMBERT Academic Publishing GmbH & Co. KG, Germany.
[৩] Marshall, S. 2005. Street Patterns, Spon Press, 2 Park Square, Milton Park, Abingdon, Oxon.
[৪] Kattan, L. 2009. Toolbox for alleviating traffic congestion, Traffic Engineering and Operations, University of Calgary.
[৫] Ben-Joseph, E., 1995a. Livability and safety of suburban street patterns: A comparative study. Berkeley Institute of Urban and Regional Development and University of California Institute of Transportation Studies Working Papers 641, April 1995.