১.
নারীদের অবস্থান এখনও পিছুটানে আছে, তা সত্যি নয়। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে, সাফল্যের জোয়ারে। আর বৈশিষ্ট্যগতভাবে নারীরা ‘গোছানো’ বলেই কি না, সবকিছুতেই তাদের সাফল্য বেশি। নারীরা পাতাল জয় করছে, আকাশ ফুঁড়ে উড়ছে মহাকাশের অজানা প্রান্তরে। শিক্ষায়, আবিস্কারে, চিকিৎসায় লেখাচ্ছে নতুন ইতিহাস। যান্ত্রিকতা, নগরায়ন কিংবা শিল্পবিপ্লবের পরও একটা জিনিসের চাহিদা কিন্তু কমছে না। সেটি খাদ্য। অথচ, পুরো বিশ্ব এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাড়ছে সঙ্কট। তারপরও, খাদ্য উৎপাদন তথা কৃষিতে নারীদের অবদান অসামান্য। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন সঙ্কটে নারীরাই হয়ে উঠছেন ত্রাতা। খাদ্য নিরাপত্তার যুদ্ধেও তাদের লড়াই চোখে পড়ার মতোই।
পরিসংখ্যান বলছে, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ মিলিয়ে কৃষিতে নারী কৃষকের হার ৪৩ শতাংশ। তাদের পরম যত্নে, পরিচর্যায় আঙ্গিনায় বেড়ে উঠছে শাকসবজি। পরিবারের সদস্যদের সাথে ক্ষেতে ফসল বুনছে, ফসল কাটছে। শুধু তা-ই নয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবহনেও নারীরা এগিয়ে আছে পুরুষের মতোই। শুনলে অবাক হতে হয়, বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়, তার মোট ৮০ শতাংশ আসে পারিবারিক কৃষি থেকে। আর শুরু থেকেই, পারিবারিক কৃষিতে নারীর জয়জয়কার। সূর্যোদয়ের পর গৃহস্থালির কাজ, রান্না ছাড়াও পরিবারের শিশু, বয়স্ক এবং অসুস্থ সদস্যদের দেখভালের পরও কৃষিতে নারীরা যেভাবে সরাসরি অংশ্রগ্রহণ করে চলেছে, তাতে খাদ্য নিরাপত্তায় নারীর অবদান মায়ের মতোই।
ফিলিপাইনের চালের মুক্ত বাজারে অংশগ্রহণ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ২০১৮ সালে দেশটিতে যখন চালের মূল্য বৃদ্ধি পেল, তখন সরকার ‘রাইস টেরিফিকেশন ল’ পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে কার্যত বাইরে থেকে চাল আমদানির সকল বাধা শেষ হয়। আমদানিও হয় বিপুল পরিমাণ। যেহেতু ফিলিপাইনের প্রধান কৃষিপণ্য চাল এবং প্রধান খাবারও ভাত, তাই বিপাকে পড়ে ধানচাষীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদেরকে ধান চাষ বাদ দিয়ে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকতে হয়। দেশটির কৃষকদের বড় একটি অংশ নারী হওয়ায়, তাদেরও সংগ্রাম করতে হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে। পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা এই সংগ্রামের পথিক হয়ছে। সে কারণেই, দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন বাজার দখলের মতো নতুন ধরনের ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি নিয়ে নারীরাই সাফল্য দেখিয়েছে।
গ্রামীণ অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য বিশ্বব্যাপী অকাট্য বাস্তবতা। কিন্তু পারিবারিক কৃষি এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে কাজ করেছে। এমন প্রমাণ দিচ্ছে তাইওয়ান। দেশটিতে পারিবারিক কৃষি পারিবারিক বন্ধনের নতুন দ্বারপ্রান্ত খুলে দিয়েছে। বাড়ছে ঐক্য, স্থানীয় পর্যায়ে সবাই মিলে সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখতে পারছে। এই কৃষির মাধ্যমেই তাদের মধ্যে লিঙ্গ সমতার অনুশীলন হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের কাছে নারীদের সম্মান বাড়ছে, নতুন প্রজন্মও শিখছে নারীর প্রতি নতুন ধারণা নিয়ে।
একই ঘটনা বাংলাদেশেও। এ দেশের অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রতি বছর বাড়ছেই। শহরমুখো হতে গিয়ে, নারীরা আসছে শিল্পখাতে। তারপরও, নারীদের প্রধান কাজের খাত এখনও কৃষি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লাখ। এর মধ্যে নারী ১ কোটি ৫ লাখের বেশি। যদিও জাতীয়ভাবে নারী কৃষকদের ‘কৃষক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তারপরও এই সংখ্যাটা অনেক। কৃষিকাজের ২১টি ধাপের মধ্যে নারীরা ১৭টি ধাপের কাজ করে। তবুও নারীরা কৃষক হতে পারেননি। বাড়ির আঙ্গিনায় শাকসবজির চাষ কিংবা গবাদিপশুর যত্ন থেকে শুরু করে, ক্ষেতের ফসল বোনা, কাটা এবং পরিবহন; সবকিছুতেই নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ রয়েছে। এসব নারী কৃষকরা খাদ্য উৎপাদন নিয়ে লড়ছে, দেশের কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিচ্ছে।
২.
খাদ্য সঙ্কট প্রতিরোধে বাংলাদেশি নারীরাও কম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় না। তবে ‘নারী’ বলেই কি না, বারবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বেরিয়ে আসে নতুন দিনের পথ ধরে। ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি স্বীকার। যার ধারাবাহিকতায়, দেশের নিম্নাঞ্চলগুলোতে প্রতি বছর বন্যা, নদী ভাঙনের মতো ঘটনা ঘটে। ফসলের ক্ষেত, বাজার সবকিছুই তখন পানির নিচে। তারপরও, নারীরা ঠিকই নিজেদের মতো করেই বন্যা পূর্ববর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শুকনো কাঠ, চাল, ডাল, শুকনো খাবার; সবকিছুরই অগ্রীম জোগাড় রাখে। এই দুর্যোগের সময়েও পরিবারের সদস্যের মুখে খাবার তুলে দেয়।
পাহাড় অঞ্চল; বিশেষত থানচি, সাজেক, রুমা এলাকায় যে বছর জুমে ইঁদুরের আক্রমণ হয়, ফলন ভালো হয় না তখন খাদ্য সঙ্কটে পড়ে স্থানীয়রা। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের ত্রাণ সামগ্রী দুর্গম এলাকাতে যতক্ষণে পৌঁছে, ততদিন না খেয়ে থাকলে মারা যেতে পারে কয়েক শত মানুষ। এমন সময়ে তাদের খাবারের তালিকায় থাকে বন্য ফল, সবজি বিশেষ করে আলু। বেশিরভাগ সময়ে নারীরাই এগুলো জোগানের ব্যবস্থা করেন।
দুর্ভাগ্য এই যে, সারাবিশ্বে সহস্র কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাওয়া এসব নারী কৃষকরাই ভুগছে থাকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়, অপুষ্টিজনিত সমস্যায়। সামাজিক অবস্থান, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব; সবকিছুই নারীর পুষ্টিবিষয়ক সঙ্কটের জন্য দায়ী। বিশ্বজুড়ে গর্ভবতী মোট নারীর ৫০ শতাংশই রক্তশূন্যতায় ভুগছে। অনুন্নত দেশগুলোতে অন্ততপক্ষে ১২০ মিলিয়ন নারী স্বল্প ওজনের সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই দক্ষিণ এশিয়ার।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন, দারিদ্রতার হার বৃদ্ধি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা; সবকিছু মিলিয়েই ক্রমশ খাদ্য সঙ্কট বাড়ছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই হার আরও বিপদজনক হবে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে নারী ও শিশু। এখনও বাংলাদেশের ৬০ ভাগ নারী অপুষ্টিজনিত জতিলতায় ভুগছে। সাধারণ স্বাস্থ্যজ্ঞানের ব্যাপারে বেশিরভাগেরই নেই কোনো ধারণা। গর্ভবতী নারীদের খাদ্যাভ্যাস, কিশোরীর নারীস্বাস্থ্য; সবকিছুতেই ‘অবহেলা’ প্রকট। যে কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ নারী ভোগেন রক্তশূন্যতায়। দেশজুড়ে এই এর অঙ্ক শতকরা ৪৪ শতাংশ। এসব নারীরা বোঝেন না, সাধারণ খাবার ও পুষ্টিকর খাবারের মাঝে মূল ব্যবধান কতটা। যদিও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সেই অগ্রগতির পরও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবার তলানিতে।
৩.
দেশের অর্ধেকের বেশি নারী অপুষ্টিতে ভুগছে বলেই কি না, খর্বতা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। হাওড় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কম ওজন এবং খর্বাকৃতির বাচ্চার জন্ম হয়। শুধু হাওড় অঞ্চলই নয়, দেশব্যাপীই এই সমস্যা প্রকট। যদিও ১৯৯৭ সালে ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির ছিল, সেখানে ২০১৮ সালে তা নেমে আসে ৩১ শতাংশে। তারপরও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে খর্বাকৃতির শিশু জন্মের হার এখনও বেশি। কারণ একটাই, তাদের মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। শহর অঞ্চলে নিম্ন আয়ের নারীরা নিজেদের জন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারে না। তাই শহরেও নারীর স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
পারিবারিক কৃষি নারীর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের জন্য কোনো মজুরির ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানাচ্ছে, কৃষিকাজকে নারীর প্রত্যাহিক কাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে তাদেরকে মজুরী দেওয়ার কথা চিন্তা করা হয় না। নারীর অধিকার মানে শুধু নারীর নির্যাতন বন্ধ নয়, বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে স্বীকৃতি দেওয়া। আর খাদ্য নিরাপত্তায় যখন নারীরাই সবচেয়ে বেশি শ্রম দিচ্ছে, তখন তাদের জন্যই থাকুক আগামীর সম্ভাবনা। এখনই সময় সঠিক উদ্যোগ নেওয়ার এবং তা বাস্তবায়ন করার। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও এজন্য এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন সরকারি সরক্ষা বলয় কর্মসূচিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে নারীরাই যে কৃষিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে।
দেশে এখনও খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এ ব্যাপারে একটি খসড়া প্রস্তুতের কাজ চলছে। যা আইন হিসেবে প্রণয়ন করা সম্ভব হলে যেসব গোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তারা উপকৃত হবে। শুধু তা-ই নয়, দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি কাজ করা সম্ভব হবে। যেহেতু নারীরা দেশের কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখছে, তাই তাদের মতামত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারলে উদ্যোগটি সফল হবে। যে দাবিগুলো সামনে আনতেই হবে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১। নারী কৃষককে রাষ্ট্রীয় ‘স্বীকৃতি’ প্রদান এবং নারীর অবদানের মূল্যায়ন। কৃষি বাজেটে নারী কৃষক প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ।
২। কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে ভূমিতে নারী কৃষকের মালিকানা নিশ্চিতের ব্যাপারটি স্পষ্ট করতে হবে।
৩। নারী কৃষকদের পণ্য বিক্রিতে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, প্রণয়ন করতে হবে বাজার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিমালা।
৪। নারী কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের সাথে পুরুষের যে বিশাল মজুরী বৈষম্য তা বন্ধ করতে হবে।
৫।দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিসত্বর খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রয়ণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে কৃষকদের গুরুত্ব দিতে হবে।