একটু শান্তিতে বসে টেলিভিশন দেখছিলেন বা গান শুনছিলেন। কিন্তু শান্তিতে কী আর কিছু করার জো আছে! মশার উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ। অথচ দেখুন আপনার পাশেই আপনার ছোট বোনটি বসে পড়ছে যে আপনাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে –“মশা কি শুধু তোকেই কামড়ায়?”
এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় অনেককেই। আবার অনেকের কাছে এসব কথাকে হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু সত্য এটিই যে মশা কিছু মানুষকে একটু বেশিই কামড়াতে পছন্দ করে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে একজনের প্রতি মশা বিশেষভাবে আকর্ষণ বোধ করে। গবেষণায় আরো জানা গিয়েছে, মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ অন্যান্যদের চেয়ে বেশি মশার আক্রমণের শিকার হন। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ আপনাকে বলে যে তাকে কখনোই মশা কামড়ায় না, তাহলে বুঝবেন তিনি আপনার সাথে ভাব নেয়ার চেষ্টায় মিথ্যা বুলি আওড়াচ্ছেন।
মশা মানুষকে কেন কামড়ায়?
মশা ক্ষুধার্ত থাকে বলে মানুষের রক্ত খুঁজে বেড়ায়, এমন ধারণা একেবারেই সত্যি নয়। মানুষকে কামড়ায় স্ত্রী মশা বা মশকী, তবে তা খেয়ে দেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হবার জন্য নয়; বরং তা তাদের ডিম উৎপাদন এবং সেগুলোর পুষ্টির জন্য। সবল বংশধর জন্ম দিতে লাল রক্ত আবশ্যক। পুরুষ মশা ফুলের নির্যাস খেয়েই বাঁচতে পারে।
মশা কীভাবে কামড়ায়?
মশার এমন একটি হুল রয়েছে যেটি মানবদেহে, যে ইনজেকশন ফোটানো হয় তার সুঁইয়ের মতো, যা সহজেই আপনার কৈশিক জালিকার মধ্যে প্রবেশ করাতে পারে। তো মশকী আপনার ত্বকে সফলভাবে ল্যান্ডিং করার পর তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হুলের সাহায্যে কয়েক মুহূর্ত সময় নেবে আপনার কৈশিক নালির ঠিক কোন স্থানে সেটি ঠিকঠাক ফোটানো যায় এবং পাওয়ামাত্রই ফুটিয়ে দেবে। হুল ফোটানোর সাথে সাথেই মশকী তার মুখের লালা নিঃসরণ করে যা মানুষটির দেহে রক্তপাত হতে দেয় না। এভাবেই মশকী নিঃশব্দে অজস্র জীবাণুও আপনার দেহে ঢুকিয়ে দিতে পারে। যা-ই হোক, এরপর রক্ত চুষে সরাসরি পেটে নিয়ে যায় এবং সেখানেই আপনার রক্ত পরিপাক হয়ে তৈরি করবে মশকীর ডিম।
মশা কীভাবে খবর পায়?
মশার মাথায় যে দুইটি অ্যান্টেনা রয়েছে, তা নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের প্রতি সংবেদনশীল। এবং এই রাসায়নিক পদার্থটি আপনার ত্বকেই রয়েছে। মশা তার অ্যান্টেনার দ্বারা প্রায় ১১৫ ফুট দূরত্বে থেকেও সংকেত পেয়ে যায়। সংকেত পেয়েই চলে আসে আপনার টানে।
মশা কেন কিছু মানুষকে বেশি কামড়ায়?
মশার কামড় খেয়ে অতি মাত্রায় অতিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর। গবেষণায় বেশ কিছু ফ্যাক্টর পাওয়া গিয়েছে যেগুলো মশাকে আকর্ষণের পেছনে বিশেষভাবে দায়ী। সেরকমই কিছু ফ্যাক্টর হলো- ডিএনএ এর নির্দিষ্ট জিন, রক্তের গ্রুপ, দৈহিক তাপমাত্রা এবং ঘাম, কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা, পরিহিত পোশাকের ধরন, ত্বকের কিছু ব্যাক্টেরিয়া, ত্বকে উৎপন্ন কিছু রাসায়নিক পদার্থ গর্ভধারণ ইত্যাদি।
তাহলে চলুন ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক।
নির্দিষ্ট জিন
মানুষের ক্রোমোজমে ডিএনএ’র মাঝে রয়েছে অসংখ্য জিন, যেগুলো তারা পেয়ে থাকেন বংশগতভাবে। গায়ের নির্দিষ্ট গন্ধ নির্ধারণকারী জিন মশার কামড়ের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে জানা গিয়েছে। সাধারণত যমজ বাচ্চাদের উপর গবেষণা করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসা (যেহেতু যমজ বাচ্চাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রায় কাছাকাছি হয়)।
রক্তের গ্রুপ
মশা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের মানুষের প্রতি। এ পর্যন্ত যতগুলো গবেষণা হয়েছে, প্রায় প্রতিটিতেই জানা গিয়েছে মশার কাছে সবচেয়ে প্রিয় রক্ত হলো ‘ও’, যার কারণে সবচেয়ে বেশি মশার কামড়ের শিকারও ‘ও’ রক্তের গ্রুপের নিরীহ মানুষগুলো। সবচেয়ে কম মশার কামড়ের শিকার ‘এ’ রক্তের গ্রুপের মানুষজন। আর ‘বি’ রক্তের গ্রুপের ব্যক্তিরা আছেন এই দুই গ্রুপের মাঝামাঝি।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা
বার্গার, পিজ্জায় ব্যবহৃত চিজ বা সসের জন্য যেমন আপনি বারবার খেয়ে থাকেন, তেমনই আপনার ত্যাগকৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের টানে মশা বারংবার আপনাকে কামড়াতে আসে। মশকীর দেহে ম্যাক্সিলারী পাল্প নামক একটি অঙ্গ রয়েছে, যেটি দ্বারা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধ নিতে পারে ১১৫ ফুট দূর থেকেই। কার্বন-ডাই-অক্সাইড যত বেশি ত্যাগ করবেন, মশার কামড় খাওয়ার প্রবণতা তত বাড়বে। খুব স্বাভাবিকভাবেই যার স্বাস্থ্য বেশি ভালো, তাদের নিঃশ্বাসের সাথে এ গ্যাস বেশি নিঃসরিত হবে কম স্বাস্থ্যবানদের তুলনায়। আর তাই শারীরিক স্থূলতাও মশার অতিরিক্ত আক্রমণের শিকার হবার একটি কারণ।
গর্ভধারণ
গর্ভবতী মহিলারা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বেশি মশার কামড় খেয়ে থাকেন। ২৮ সপ্তাহের অধিক গর্ভবতী মহিলারা অন্যদের চেয়ে বেশি মশার কামড়ের শিকার হয়ে থাকেন বলে গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। এর পেছনেও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণই দায়ী। তাছাড়া গর্ভকালীন দৈহিক নানা রাসায়নিক পরিবর্তন আসে, যেগুলোও এর পেছনে কাজ করতে পারে যা নিয়ে গবেষণা খুবই সীমিত।
ত্বকের ব্যাক্টেরিয়া
মানুষের ত্বকে একধরনের ব্যাক্টেরিয়া থাকতে পারে, যেগুলো ত্বকের নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের সাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে এমন এক গন্ধ সৃষ্টি করে, যা মশাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ
নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থগুলোর কাজ সম্পর্কে একটু বলে নেয়া যাক। প্রত্যেক মানুষের দেহে ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যেগুলো একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। মশার কামড় কম বা বেশি খাওয়ার সাথে এই গন্ধের খুব প্রভাব রয়েছে। ঘামের সাথে মানুষের দেহে ল্যাকটিক এসিড, অ্যামোনিয়া, ইউরিক এসিড ইত্যাদি নিঃসৃত হয় বিভিন্ন মাত্রায় এবং এগুলো পরস্পর মিশ্রিত হয়ে কখনো কখনো কারো কারো ক্ষেত্রে মশার জন্য লোভনীয় গন্ধের সৃষ্টি করে। যারা ব্যায়াম করেন বা ভারি কাজ করেন, তাদের দেহ থেকে অতিরিক্ত ল্যাক্টিক এসিড নিঃসৃত হয়। ফলে মশার আক্রমণের শিকার তারাও বেশি হন বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
পরিধেয় পোশাকের রঙ
মশকীর চোখ গাঢ় রঙের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। তাই নেভি-ব্লু, গাঢ় লাল বা এ জাতীয় পোশাক পরিধানে মশার আক্রমণের শিকার হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কীভাবে বাঁচবেন এই মশার আক্রমণ থেকে?
মশার কামড়ে বা কানের কাছে মশার অপ্রত্যাশিত গুণগুণ গানে অতিষ্ঠ হয়ে কামান না দেগেও করার আছে অনেককিছুই। মশার কামড়ে হতে পারে মারাত্মক সব রোগও। তা এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপায়ে নিতে পারেন কিছু ব্যবস্থা। যেমন-
- সর্বপ্রথম নিজের বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
- কেরোসিন তেল দিয়ে ঘর মুছতে পারেন।
- কতগুলো রসুন নিয়ে সেগুলোকে বেঁটে রস করে নিন। এরপর একটি স্প্রে বোতলে এর সাথে রসুনের রসের আনুমানিক পাঁচগুণ পানি মিশিয়ে নিন। এবার শরীরের যেখানে যেখানে মশা কামড়াতে পারে, সে স্থানগুলোতে স্প্রে করে নিন। এতে করে শুধু মশার হাত থেকে বাঁচতে পারবেন তা-ই নয়, যেকোনো রক্তচোষা পতঙ্গের হাত থেকে রেহাই পাবেন।
- অলিভ অয়েলের সাথে দারুচিনির পাতার তেল (বাজারে কিনতে পাওয়া যায়) মিশিয়ে মাখলেও ত্বকের প্রতি মশার আকর্ষণ কমে যাবে।
- ভ্যানিলা নির্যাস (এক্সট্রাক্ট) এবং অলিভ ওয়েল মিশিয়েও লাগাতে পারেন।
- গবেষণায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর হসেবে পাওয়া গিয়েছে পুদিনাপাতার তেল। তাছাড়া ৫-৬টি পুদিনাপাতা একবাটি পানিতে ডুবিয়ে রেখে দিতে পারেন ঘরের টেবিলের উপর। তিন-চারদিন পর পর পানি পরিবর্তন করলেই হবে।
- চা পাতা ব্যবহারের পর সেগুলো না ফেলে রোদে ভাল করে শুকিয়ে তারপর পুড়িয়ে ধোয়া দিন ঘরে। মশা পালাতে বাধ্য।
- ঘরের টবে লেমন গ্রাস লাগাতে পারেন। এটি একটি মশারোধক উদ্ভিদ।
- রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে কষ্ট হয়? তাহলে একটি কাজ করতে পারেন। আধ গ্লাস পানিতে কয়েক টুকরো কর্পূর দিয়ে খাটের নিচে রেখে দিন। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমান।
- ঘরের কোণায় কোণায় নিমপাতা রাখতে পারেন। মশা কম হবে এবং তেলাপোকা, ছারপোকা থেকেও রেহা পাবেন।
- পরিশেষে, মশার নজর এড়াতে হালকা রঙের পোশাক পরিধান করুন।
তারপরেও রয়ে যায় কিছু কথা
- নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের মানুষদের মশা বেশি কামড়ায়, এ তথ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য নয়। গবেষণাগুলোতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকায় পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দেহের রাসায়নিক পদার্থ যে এক্ষেত্রে দায়ী সেটি সম্পর্কে সন্দেহ নেই।
- গর্ভবতী মহিলাদের মশা বেশি কামড়ায় এ তথ্যও গ্রহণযোগ্য নয়। এই গবেষণাটি করা হয়েছিল ৩৯ জন গর্ভবতী মহিলা এবং ৩৯ জন গর্ভবতী নয় এমন মহিলাদের নিয়ে। এত কম সংখ্যক লোক নিয়ে করা গবেষণা থেকে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত গবেষণা নিশ্চয়ই হবে।
- লেমন গ্রাস পুরোপুরি মশা দূর করতে পারে তা প্রমাণ করা যায়নি। তবে পুদিনা এবং নিমপাতার ব্যবহারে কোনোই সন্দেহের অবকাশ নেই।
- কাপড়ের রঙের সাথে মশার আকর্ষণের বিষয়টিও এখনও ধোঁয়াশামাখা।