আমরা অনেকেই বিভিন্ন প্রয়োজনে টুকটাক মিথ্যা কথা বলে থাকি। বিপরীতভাবে বলা যায়, আমাদেরকে প্রায়ই আশেপাশের মানুষের মুখ থেকে ছোটখাটো মিথ্যা কথা শুনতে হয়। অপ্রয়োজনীয় বা অতিরঞ্জিত মিথ্যা বলাটা বেশ সহজ। যারা এ ধরনের মিথ্যা বলে, তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই তা বলতে পারে। তাই এ ধরনের মিথ্যা সনাক্ত করতে পারা তুলনামূলকভাবে কঠিন। সৌভাগ্যের বিষয়, এ ধরনের মিথ্যা অধিকাংশ সময়ই গুরুত্বহীন, এতে কারো তেমন কোনো লাভ বা ক্ষতি হয় না।
কিন্তু যেসব বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ, যেমন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজন অপরাধীর বক্তব্য, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, ব্যবসায়িক অংশীদারের বা জটিল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সঙ্গীর বক্তব্য- এসব ক্ষেত্রে তারা মিথ্যা বলছে কিনা, সেটা বুঝতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কথা বলার সময় মানুষের চোখ, হাত-পা সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া দেখে অনেক সময়ই বোঝা সম্ভব, কথাগুলো কি কোনো মানসিক চাপের মুখে বলা হচ্ছে, নাকি স্বাভাবিকভাবেই বলা হচ্ছে।
বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বিশেষজ্ঞ ড্যারেন স্ট্যান্টন বলেন, “আমাদের শরীরে একটি প্রক্রিয়া আছে, যাকে বলে ডিটেকশন অ্যাপ্রিহেনশন। এর অর্থ একজন মানুষ একটি মিথ্যাকে যত বেশি গোপন করতে চাইবে, তার শরীর সে বিষয়ে তত বেশি ইঙ্গিত দেবে।”
দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের এজেন্ট এবং ‘How to Spot Lies Like the FBI’ বইয়ের লেখক মার্ক বুটন বলেন, শারীরিক ভাষা দেখে কেউ মিথ্যা বলছে কিনা, সেটা নির্ণয় করার কাজটি প্রধানত গোয়েন্দাদের। তবে সাধারণ মানুষও এই পদ্ধতি থেকে উপকৃত হতে পারে। তিনি একই সাথে বলেন, কেউ মিথ্যা বলছে কিনা, সেটা বোঝার জন্য তাকে ভালোভাবে চিনতে হবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সে কীরকম আচরণ করে, সেটা জানা থাকলেই কেবল তার অস্বাভাবিক আচরণ থেকে তার বক্তব্য মিথ্যা কিনা, সেটি বোঝা যেতে পারে।
গোয়েন্দা এবং শারীরিক ভাষা বিশেষজ্ঞরা মিথ্যা কথা সনাক্ত করার জন্য মানুষের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করেন। তবে এর যেকোনো একটি বা দুইটি মিলে গেলেই যে নিশ্চিত হওয়া যাবে, সে মিথ্যা বলছে, এমন নয়। এটি শুধু প্রশ্নকর্তাকে একটি ধারণা দেবে যে, উত্তরদাতা মানসিক চাপে অথবা অস্বস্তিতে আছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক, গবেষকদের মতে মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের মধ্যে কী কী আচরণগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
চোখের মণির নড়াচড়া
এফবিআই কর্মকর্তা মার্ক বুটন বলেন, মানুষ যখন কোনো বিষয় বলতে গিয়ে অস্বস্তি অনুভব করে, তখন তার চোখের মণি এদিক-সেদিক নড়াচড়া করে। এর দ্বারা বোঝা যায়, সে তার উদ্দেশ্যে করা প্রশ্ন দ্বারা জব্দ হয়ে গেছে, অথবা প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছে না।
ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলা
যখন কেউ মিথ্যা বলে, তখন সে পরপর পাঁচ-ছয় বার খুব দ্রুত চোখের পাতা ফেলতে পারে। মার্ক বুটনের মতে, সাধারণত মানুষ প্রতি মিনিটে পাঁচ থেকে ছয় বার, অর্থাৎ প্রতি ১০ থেকে ১২ সেকেন্ডে একবার চোখের পাতা ফেলে। কিন্তু যখন সে মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়, যখন তাকে চাপের মুখে কোনো মিথ্যা কথা বলতে হয়, তখন সে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খুব ঘন ঘন পাঁচ-ছয়বার চোখের পাতা ফেলতে পারে।
দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া বা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা
সাধারণত মানুষ কারো সাথে কথা বলার সময় একটানা তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকে না। মিথ্যা কথা বলার সময় এর ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে। অনেকে মিথ্যা কথা বলার সময় চোখে চোখ ধরে রাখার মতো মানসিক শক্তি অর্জন করতে পারে না। ধরা পড়ার ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়, অন্য কিছুর দিকে তাকিয়ে কথা বলে।
কিন্তু সব সময় এটি সত্য না-ও হতে পারে। অনেকেই মিথ্যা কথা বলার সময় বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণের জন্য জোর করে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকে।
এক সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে চোখ বন্ধ রাখা
সাধারণত মানুষের চোখের পাতা ফেলতে ১০০ থেকে ৪০০ মিলিসেকেন্ডের মতো সময় লাগে। অর্থাৎ ১ সেকেন্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগ থেকে ৪ ভাগ সময়ের মধ্যে মানুষ চোখের পাতা ফেলতে পারে। কিন্তু মার্ক বুটনের মতে, মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের শরীর আত্মরক্ষার কৌশলে চলে যায়। ফলে সে অধিক সময় ধরে চোখ বন্ধ রাখতে পারে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সে ১ থেকে ২ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রাখতে পারে।
ডান দিকের উপরের কোনায় তাকানো
যখন কোনো মানুষকে এমন কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যা সে পূর্বে দেখেছে বা শুনেছে এবং তাকে একটু চিন্তা করে বিষয়টা স্মৃতি থেকে স্মরণ করে উত্তর দিতে হবে, তখন তার চোখের নড়াচড়া দেখে বোঝা সম্ভব, সে মিথ্যা বলছে কিনা। মার্ক বুটন ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ডানহাতি মানুষরা কোনো কিছু স্মৃতি থেকে মনে করার চেষ্টা করার সময় তাদের দৃষ্টি থাকে বাম দিকে উপরের কোনে। আর তারা যদি কল্পনাশক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের দৃষ্টি থাকে ডান দিকের উপরের কোনে।
যারা বাঁহাতি, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। তবে বুটন বলেন, কিছু কিছু মানুষ সোজা সামনের দিকে তাকিয়েই স্মৃতিশক্তি বা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে পারে।
নকল হাসি দেওয়া
মিথ্যা কথা বলার সময় অনেকেই কৃত্রিম হাসি দিয়ে শ্রোতাকে আশ্বস্ত করতে চায়, বা তার বিশ্বাস অর্জন করতে চায়। কৃত্রিম হাসি শনাক্ত করার উপায় সম্পর্কে মার্ক বুটন বলেন, কেউ যদি সত্যি সত্যিই হাসে, তাহলে তার চোখ কুঁচকে যায় এবং চোখের নিচে ভাঁজ পড়ে। কিন্তু কৃত্রিম হাসি দেওয়ার সময় শুধু মুখের আকৃতিই পরিবর্তিত হয়, চোখের উপর কোনো প্রভাব পড়ে না।
ঠোঁট ভাঁজ করা
মিথ্যা কথা বলার সময় মানসিক চাপের কারণে এবং শরীরের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে মানুষের মুখ শুকিয়ে যেতে থাকে। ফলে তাকে ঘন ঘন দুই ঠোঁট ভাঁজ করে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে দেখা যায়। এছাড়া মিথ্যা কথা বলার সময় অনেককে ঘামাতে এবং বারবার ঢোক গিলতে দেখা যায়।
মুখমণ্ডল স্পর্শ করা
মার্ক বুটনের মতে, মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের শরীরে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে মুখমণ্ডল চুলকাতে থাকে। ফলে মিথ্যা বলার সময় মানুষকে ঘন ঘন নাকের ডগা, গাল বা ঘাড় চুলকাতে দেখা যায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মনিকা লিউইনস্কির সাথে তার সম্পর্কের কথা অস্বীকার করার সময় ঘন ঘন নাক চুলকাতে দেখা গিয়েছিল।
মিথ্যা কথা বলার সময় অনেকে মুখের সামনে বারবার হাত নিয়ে আসে। তারা হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে, যেটা মিথ্যাটিকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে তার অবচেতন মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অনেককে আবার মিথ্যাটিকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার প্রতীকি আচরণ হিসেবে জামা-কাপড়ের অদৃশ্য ধুলা পরিস্কার করতেও দেখা যায়!
দ্রুত নিশ্বাস নেওয়া
মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়। মিথ্যা কথা বলার সময় মানসিক চাপের কারণে হার্টবিট দ্রুত হয়ে যায় এবং হার্টে বেশি রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। একারণেই তখন দ্রুত নিশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও মিথ্যা বলার সময় কেউ যদি চুইংগাম চিবুতে থাকে, তাহলে তার চিবুনোর হার দ্রুত হয়ে যায়। ধূমপান করার সময় মিথ্যা বলতে শুরু করলে সিগারেট দ্রুত শেষ হয়ে যেতে পারে।
কাশি দেওয়া
অস্বস্তিকর, মিথ্যা এবং আলোচনা করতে আগ্রহী না, এরকম বিষয়ে কথা বলার সময় মানুষ নিজের অজান্তেই কাশি দেয়। অতিরিক্ত উদ্বেগ থেকে গলা শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই মিথ্যা বলার সময় কাশি আসে।
বডি ল্যাংগুয়েজ বিশেষজ্ঞ ড্যারেন স্ট্যান্টনের মতে, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় যদি দেখা যায়, কোনো প্রসঙ্গ এসে পড়ায় সে কাশি দিচ্ছে, তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথমে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাওয়া উচিত। কিছুক্ষণ পর আবারও সেই প্রসঙ্গে ফিরে এলে যদি দেখা যায় সে আবারও কাশি দিচ্ছে, তাহলে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব যে, সে এই প্রসঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে অথবা মিথ্যা কথা বলছে।
হাত-পায়ের নাড়াচাড়া
মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষকে হাতের আংটি, ব্রেসলেট, ঘড়ি, কলম ইত্যাদি ধরে নাড়াচাড়া করতে বা ঘুরাতে দেখা যায়। মেয়েদেরকে হাত দিয়ে চুল প্যাঁচাতে দেখা যায়। অনেকে হাতের তালু দিয়ে পায়ের উপর ঘষতে থাকে।
স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ হাত-পা ছড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে বসে। কিন্তু মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষকে হাত-পা গুটিয়ে নিতে দেখা যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা, দুই হাত ভাঁজ করে বুকের উপর রাখা, পায়ের উপর পা তুলে সেই পা পেছনে লুকিয়ে রাখা, পা ভাঁজ করে চেয়ারের ভেতর দিকে নিয়ে যাওয়া– এগুলো এ ধরনেরই কয়েকটি আচরণ।
গলার স্বরের পরিবর্তন
মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের গলার স্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ সময় নিজের অজান্তেই মানুষের গলার স্বরের তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, অথবা গলার স্বর ভাঙা ভাঙা মনে হতে পারে। অনেকের মধ্যে এ সময় তোতলামিও দেখা যায়। অস্বস্তি কাটাতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলার সময় অনেককে দ্রুত লয়ে কথা বলতে দেখা যায়।
অতিরিক্ত কথা বলা
অতিরিক্ত কথা বলা মিথ্যা বলার আরেকটি লক্ষণ। গুরুত্বপূর্ণ মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে মানুষ প্রাসঙ্গিক, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়, এরকম ছোটখাট বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করতে থাকে।
প্রশ্ন করার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়াটাও মিথ্যা বলার লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে পুলিশি জেরার সময় অপরাধী যদি প্রশ্ন করার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়া শুরু করে, তার অর্থ হতে পারে যে, তার উত্তরটি সাজানো এবং আগে থেকে অনুশীলন করা। এরকম ক্ষেত্রে মানুষকে কোনো ঘটনার দিন, তারিখ, সময় সহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা বিস্তারিত বিষয়গুলো উল্লেখ করতে দেখা যায়।
উত্তর দিতে অস্বস্তি বোধ করা
কেউ যদি আগে থেকেই মিথ্যা উত্তর তৈরি করে রাখে, তাহলে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়া শুরু করতে পারে। কিন্তু যদি নতুন কোনো প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলতে হয়, তাহলে উত্তর গুছিয়ে নেওয়ার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় নেয়।
এছাড়াও মিথ্যা বলার সময় মানুষ নিজে থেকে অপ্রয়োজনীয় বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্টি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ধরা পড়ার ভয়ে সে ব্যাপারে আর বিস্তারিত বলতে আগ্রহী হয় না। বরং পূর্বে বলা বিষয়ই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে।
ফিচার ইমেজ © CORBIS SYGMA (২৭ জানুয়ারি, ১৯৯৮; বিল ক্লিনটন মনিকা লিউনস্কির সাথে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করছেন)