ফেসবুক, পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার করে হলেও নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুঁ মেরে যাচ্ছে ২০০ কোটি মানুষ! আর প্রতিদিন লগইন করার সংখ্যাও একেবারে কম নয়, আর সেই সংখ্যার অংকটি ৫০ কোটি এবং তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষকে ফ্রি সার্ভিস দেওয়া এই ফেসবুক কি আসলেই ফ্রি?
এডওয়ার্ড স্নোডেনের তথ্য ফাঁস ঘটনার পর প্রায় সবাই জেনে গিয়েছে যে অনলাইনের বড় বড় কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। আর ঠিক সেগুলোর মধ্যেই বড় লাল কালিতে লেখা রয়েছে গুগল আর ফেসবুকের নাম। প্রতিদিন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ৫০০ টেরাবাইটের ডেটা সংগ্রহ করে চলেছে ফেসবুক, এর মানেটা হলো পাঁচ লক্ষেরও বেশি এইচডি ব্লু-রে প্রিন্ট মুভির সমান তথ্য! এতক্ষণে আপনার মনে নিশ্চই এই প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে ফেলেছে, “ফেসবুক ব্যবহার কি আসলেই নিরাপদ?” নিচে ফেসবুক সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানার পর প্রশ্নটির উত্তর নিজেই খুঁজে নিতে পারবেন।
ফেসিয়াল রিকগনিশন
যখনই আপনি কোনো ছবি আপলোড করেন কিংবা আপনার কোনো বন্ধু তার ছবিতে আপনাকে ট্যাগ করে, তখনই সেই তথ্য পৌঁছে যায় ফেসবুকের বিশাল তথ্যভান্ডারের দোরগোড়ায়। তারপর ফেসবুকের বিশেষ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেই ছবি বিভিন্ন ধরণের অ্যালগরিদমের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে চিহ্নিত করে ফেলে ছবিটির আসল ব্যক্তি কে এবং যুক্ত করে ফেলে আপনার নামের পাশে। এর ফলে আপনি যখনই কোনো ছবি আপলোড করছেন, ফেসবুক বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে এবং ছবিতে আলোর তারতম্যের ভিত্তিতে আপনার পূর্ণাঙ্গ মুখাবয়বের ছবি নিজেদের তথ্যভান্ডারে যুক্ত করছে। ফেসবুকের এই ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যারের দক্ষতা অবিশ্বাস্যভাবে ৯৮%! যেখানে গুগলও তার ফটো অ্যাপে একজন আফ্রিকান-আমেরিকানকে গরিলা ভেবে চিহ্নিত করে ফেলেছিল!
ফেসবুকের এই অবিশ্বাস্য দক্ষতার পেছনে কারণও রয়েছে। কারণটি হলো, ফেসবুককে এটি করতে এর বিশাল ডাটাবেজের সম্পূর্ণ অংশ মিলিয়ে দেখতে হয় না। আপনার বন্ধু আপনাকে যে সকল ছবিতে ট্যাগ করেছে কিংবা আপনি নিজের যেসকল ছবি আপলোড করছেন শুধুমাত্র সে সকল ছবি থেকেই ফেসবুক যাচাই-বাছাই করে আপনাকে চিহ্নিত করে ফেলছে।
তো পরেরবার কোনো ছবিতে ট্যাগ করা কিংবা আপলোড করার আগে মনে রাখবেন, আপনি আরও নতুন কোনো ছবি দিয়ে মূলত ফেসবুককেই সাহায্য করছেন।
প্লেস হান্টার
আপনি মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করছেন, তার মানে হলো আপনি ফেসবুক মেসেঞ্জার অ্যাপটিও ব্যবহার করছেন, তাই না? অন্তত এই সফটওয়্যার ছাড়া তো চ্যাট করা একটু ঘোরপ্যাঁচই বটে। মেসেঞ্জার ব্যবহার করার সময় যে আপনি প্রতিটি মেসেজের সাথে আপনার সঠিক অবস্থানটিও পাঠিয়ে দেন তা কি আগে জানা ছিল? [জিপিএস এবং শেয়ার লোকেশন অন করা থাকলেই]
ভারতীয়-আমেরিকান একজন প্রোগ্রামার, আরান খান্না সামান্য একটি ক্রোম প্লাগইন তৈরি করেছিলেন তার বন্ধুদের পাঠানো মেসেজগুলো নিয়ে একটু মজা করার জন্য। তার বন্ধুদের প্রতিটি পাঠানো মেসেজ থেকে তিনি তার লোকেশন আলাদা করে ইনপুট দিতেই তার বন্ধুদের চলাচলের রাস্তা খুঁজে বের করে ফেলেছিলেন। মেসেঞ্জারের এই মেসেজ থেকে ফেসবুক দশমিকের পর ৫ অংক পর্যন্ত অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ শনাক্ত করে ফেলতে পারে অর্থাৎ এক মিটারেরও কম দূরত্বের মধ্যে থেকে আপনার নড়াচড়া বোঝা যাবে!
আরান খান্না কয়েক সপ্তাহ ধরে তার বন্ধুদের পাঠানো মেসেজ থেকে তাদের নির্দিষ্ট অবস্থান বের করে ফেলেন এবং অবাক ব্যাপার হলো তার বন্ধুরা কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া আর কোথাও যায়নি। আপনার কোনো বন্ধুর কাছে এসব তথ্য থাকা হয়তো খুব একটা বিপদজনক নয়, কিন্তু এটি যদি এমন কারও কাছে থাকে যে আপনার ক্ষতি করতে চাইছে? শেষপর্যন্ত ফেসবুকের অনুরোধে খান্না ক্রোম থেকে তার সেই প্লাগইন সরিয়ে নেন এবং ফেসবুকও ডেস্কটপ ওয়েবপেজ থেকে লোকেশন শেয়ারিং এক্সটেনশনটি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কে জানে, আপনার অজান্তেই হয়তো এখনও ফেসবুক আপনার সঠিক অবস্থান বের করে নিচ্ছে!
মতাদর্শ-চিন্তাধারা এবং ফেসবুক
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন জয় এবং ব্রেক্সিট ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর লোকজন ফেসবুকের উপর দোষ দেওয়া শুরু করল যে বিভিন্ন ‘ফেক নিউজ আর্টিকেল’-ই এর মূল কারণ। এসব সংবাদের কারণে লোকজনের চিন্তাধারণা আগে থেকে আঁচ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে ফেসবুক তাদের যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এসব নকল সংবাদ সরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব ফেক নিউজই কি আসল সমস্যা?
উত্তরটা হলো- না। ফেসবুক চায় আপনি আরও বেশি সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার করেন। এ কারণে আপনি যখনই কোনো ক্লিক করেন, ফেসবুক তা যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি কোন ধরণের। আপনি যে ধরণের কন্টেন্ট পছন্দ করেন ফেসবুক ঠিক সেরকম কন্টেন্টই আপনার সামনে নিয়ে আসবে। ধরা যাক, আপনি একজন বামপন্থী। এখন আপনি স্বভাবতই বামপন্থীদেরকে সমর্থন দেওয়া কন্টেন্টগুলোতে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার করবেন। এর ফলে আপনার নিউজ ফিডে কখনোই ডানপন্থী সমর্থনকারী কোনো কন্টেন্ট আসবে না। ফলে আপনার মনে হতেই পারে, আসন্ন নির্বাচন কিংবা অন্যান্য কোনো প্রতিযোগিতায় আপনার দল জয়লাভ করছে!
যেখানে ফেসবুকের লক্ষ্য ছিল সব মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে আসার প্রতিজ্ঞা, বলতে গেলে সেখানে ফেসবুক একে অপরকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
শুধু আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা ধর্মীয় আদর্শ নয়, বরং সবক্ষেত্রেই আপনার মনমানসিকতা-চিন্তাভাবনা আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছে ফেসবুক। আমার কথাই ধরা যাক, আমি একজন ফুটবল ভক্ত। তাই আমার নিউজ ফিডে ফুটবল সম্পর্কিত তথ্যই আমার পছন্দের তালিকায় সবার উপরে থাকবে। তাই ফেসবুক আমার লাইক-কমেন্ট-শেয়ার করা বিভিন্ন ফুটবল সম্পর্কিত কন্টেন্ট দেখেই বুঝে ফেলবে কিভাবে আমাকে ফেসবুকে অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা যায়। এর ফলে ফেসবুকের ডেটা আর্কাইভে থাকা আমার তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিনিয়ত আমার নিউজফিড বড় করতে থাকবে, অর্থাৎ যত নিচে নামতে থাকব ততই কন্টেন্ট আসতে থাকবে!
আপনার আইকিউ কিংবা বুদ্ধির সীমানা কিংবা চিন্তার ক্ষমতা যা-ই বলেন না কেন, তার সবই ফেসবুক বুঝে ফেলতে পারে সামান্য মাউসের ক্লিকেই!
তথ্য বিক্রি
আপনার ব্যক্তিগত তথ্যগুলোর দাম কত হতে পারে? আপনার কাছে অমূল্য তো বটেই, অন্যদের কাছেও কিন্তু কম কিছু নয়। কিন্তু কিছুদিন আগেই এক ব্লগার মাত্র ৫ ডলারের বিনিময়ে ১ লক্ষ লোকের ব্যক্তিগত তথ্য কিনে নিয়েছিল এক রহস্যময় কোম্পানির কাছ থেকে! সেই তথ্যগুলোর মধ্যে ছিল আপনার নাম, ইমেইল এবং এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফেসবুকের ইউআরএল লিংকটি।
এখন বলা যায় এই ব্যক্তিগত তথ্যগুলো সেই রহস্যময় কোম্পানি কিভাবে পেল? আপনি যখনই কোনো অ্যাপ কিংবা গেম চালু করছেন তখন তারা আগেই বলে রাখে যে এর বিনিময়ে তারা সেই তথ্যগুলো পেয়ে যাচ্ছে। মনে করা যাক, আপনার নিউজফিডে হঠাৎ করেই আগমন ঘটল এমন কোনো লিংক- “কে আপনার প্রোফাইল সবচেয়ে বেশি ভিজিট করেছে?” এখন আপনি সেই লিংকে ক্লিক করলেই আপনার ফেসবুক প্রোফাইলের সকল তথ্য তাদের কাছে দেওয়ার অনুরোধ করবে। আপনি অত্যন্ত উৎসুকভাবে জানতে চাচ্ছেন আপনার প্রোফাইলে কে ভিজিট করেছে তা নিয়ে এবং সে কারণেই ‘হ্যাঁ’ বাটনটি চেপে দিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হবে, আপনার সকল ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাবে সেই তৃতীয় পক্ষের কাছে যারা সহজেই টাকার বিনিময়ে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে দিতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করবে না!
শুধু তৃতীয় পক্ষই নয়, অনেক সময় ফেসবুক নিজেই আপনার তথ্য বিক্রি করে দেয়। যেমন কিছুদিন আগে মাস্টারকার্ড লোকজনের অনলাইনে কীরকম ব্যবহার করে, তার কিছু তথ্য কিনে নিয়েছিল ফেসবুকের কাছ থেকে এবং তা অন্যান্য ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল! এছাড়াও আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের উপর ভিত্তি করেই আপনার ফেসবুক পেজে কোনধরণের পেজের সাজেশন আসবে তাও নির্ধারণ করা হয়। ধরা যাক, আপনি ইতিহাস ঘাঁটতে ভালোবাসেন। এখন কোনো ইতিহাস সম্পর্কিত পেজ ফেসবুকে তাদের কন্টেন্ট বুস্ট করলেই সবার আগে টার্গেট করবে আপনার মতো ইতিহাস পছন্দকারী লোকদেরকে এবং দেখা যাবে আপনার নিউজফিডে স্পন্সর্ড পেজ হিসেবে!
শুধু ফেসবুক নয়, অন্যান্য অনেক মাধ্যমের সাহায্যেই প্রতিনিয়ত আপনাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে, জেনে নিচ্ছে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে আপনার আচার-আচরণ, ব্যবহার কিংবা বুদ্ধিমত্তা। আপনি যতই ডিজিটাল ডিভাইসের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন ততই আপনার গোপনীয়তা কমে যাচ্ছে। শুরু করার আগে একটি প্রশ্ন করেছিলাম, “ফেসবুক ব্যবহার কি আসলেই নিরাপদ?” আশা করি উত্তরটা পেয়ে গিয়েছেন।