যখন পাঠক লেখাটি পড়ছেন, ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীর কোথাও কোনো জঙ্গলে আগুন জ্বলছে। অক্সিজেন দিয়ে চোখের আড়ালেই যে গাছটি নিশ্বাস নিতে সাহায্য করত, তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে কালো ধোঁয়া। হয়তো সেই গাছের ডালে বাসা বেঁধেছিল দুটো পাখি। আর ক’টা দিন গেলে ছানাপোনাগুলো উড়তে শিখত। গাছের নিচে ওঁত পেতে থাকত কোনো এক মাংশাসী। তার মাটির গুহায় দুটো ছোট ছানা।
অথবা যখন আপনি লেখাটি পড়ছেন, তখন সাগরের পাড়ে বসা পাখি প্লাস্টিক খেয়ে ফেলেছে খাবার ভেবে। মাছের মুখ আটকে গেছে পলিথিনে।
কোথাও গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে বিলাসভবন। কোথাও নদীতে বিষ মিশে মরে যাচ্ছে শত শত মাছ।
আমাদের এই পৃথিবীকে আমরাই বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছি দিনের পর দিন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের সচেতনতা আসতে একটু সময় লেগেছে, তবে তা এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পীড়িত পশুপাখির উপর নিজেদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাব দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ।
কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে। ক্রেতাদেরকে প্লাস্টিক পলিথিন ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে। ফলাফল আজ যেখানে পলিথিন লাগে না, সেখানেও পলিথিন দেয়। এবার বদলটা আনতে হবে ব্যবহারকারীকে, আমাকে, আপনাকে।
একটু ভেবে দেখুন, প্লাস্টিক পলিথিন একেবারে কম ব্যবহার করা জীবন কি বেশ কষ্টের মনে হচ্ছে?
একদম তা নয়, খুব সহজ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আমরা আমাদের জীবনে প্লাস্টিক পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে ফেলতে পারি। এই পদক্ষেপগুলোর প্রথম ও প্রধান শর্ত হল সদিচ্ছা! আপনি যখন এই লেখাটি পড়ছেন, তার মানে আপনি এর মাঝেই জীবনকে প্লাস্টিকমুক্ত করার সদিচ্ছা পোষণ করছেন!
শপিংব্যাগ সাথে রাখুন
বাজারে মুদি দোকানে যেখানেই যাওয়া হোক, দোকানদার পলিথিনেই সবকিছু দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এখানে মাছ-মাংস বাদে অন্য অনেককিছুই পলিথিন ছাড়া নেওয়া সম্ভব। চাল-ডাল বা শুকনো কিছু নেওয়ার সময় দোকানদারের কাছে কাগজের প্যাকেট চেয়ে নিন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগে একটা শপিং ব্যাগ রাখুনম যাতে বাজার থেকে ফেরার সময় হাজারটা পলিথিন না খরচ হয়।
বোতলের পানি কেনা বন্ধ করুন
সংক্রামক ব্যাধির ভয় না থাকলে পানি কেনা বন্ধ করুন। ৫০০ মিলিলিটারের একটি বোতল যদি আপনি প্রতিদিন ব্যবহার করেন, বছর শেষে আপনার ফেলে দেওয়া বোতলসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৫। সবচাইতে ভাল হয় যদি ধাতব বোতল বহন করা যায়। যদি সেটাও না পারেন, বাসা থেকে বড় প্লাস্টিকের বোতলে পানি বহন করুন।
স্ট্র ব্যবহার বন্ধ করুন
জুসের একবার ব্যবহারোপোযোগী গ্লাসে তো বটেই, আজকাল আমরা কফির সাথেও আলাদা স্ট্র নিচ্ছি। স্ট্র যেকোনো পানীয় পান করাকে সহজ করে। কিন্তু, এই ছোট্ট স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আমরা যেন ভুলে না যাই যে আমাদের ব্যবহৃত এসব স্ট্র একসময় সাগরে গিয়ে পড়বে। সাগরের প্রাণীদের জন্য তা ডেকে আনবে এক কষ্টদায়ক মৃত্যু। কখনো কখনো বাজার থেকে কিনে আনা মাছের ভেতর প্লাস্টিক পাওয়া যায়। খুব ভালোমতো পরিষ্কার করা না হলে এই প্লাস্টিক রান্নার সময় গলে গিয়ে মানুষের পেটেও যেতে পারে। তাই নিজের ভবিষ্যতকে বাঁচাতে অন্তত এতটুকু সাময়িক স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দেওয়া যেতেই পারে। রাস্তার পাশে বা কফি হাউজে জুস কিংবা কফি অর্ডার করার সময় বলে দিন যেন আপনাকে স্ট্র দেওয়া না হয়।
অনেকে আছেন যারা বারবার ব্যবহার করার মতো ধাতব স্ট্র সাথে নিয়ে চলাফেরা করেন।
প্রসাধনী থেকে প্লাস্টিক হঠান
সাগরের পানিতে যত প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি করছে, তার ভেতর সবচেয়ে বড় অংশ হল মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাইক্রোপ্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের একেবারে ছোট ছোট দানা, যেগুলো ছেঁকে ফেলা সম্ভব নয়। ফলে এই প্লাস্টিক জলজ মাছের শরীরের সাথে আমাদেরও খাদ্যতালিকায় যোগ হচ্ছে। বড় বড় প্লাস্টিক ভেঙেও এমন টুকরো তৈরি হতে পারে। কিন্তু অনেক প্রসাধনী সংস্থা নিজেদের পণ্যের আকর্ষণ বাড়াতে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যবহার করে। ফেসওয়াশ , বা টুথপেস্টে লাল সবুজ নীল রঙের যে দানাগুলো দেখতে পাই, তারাই সেই মাইক্রোপ্লাস্টিক। আজকাল কাপড় কাঁচার পণ্যেও এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বিক্রেতাদের দাবি, এই দানার ঘর্ষণের কারণে ময়লা তুলে ফেলা সম্ভব হয় ত্বক থেকে।
কিন্তু বাস্তবতা হল এত রাসায়নিক ব্যবহারের দরকারই নেই ত্বকে। খুব সহজে রান্নাঘরে থাকা, চালের গুঁড়া বা চিনি-নারকেল তেল দিয়ে খুব সহজে, সস্তায়, ত্বকের ক্ষতি না করেই প্রকৃতি বাঁচানো সম্ভব।
প্লাস্টিকমুক্ত মাসিকচক্র
মাসিকের সময় নিরাপদ স্যানিটারি পণ্য ব্যবহারে এমনিতেই আমাদের দেশ অনেকখানি পিছিয়ে। এখানে যেসব স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, তার অনেকখানি অংশ জুড়ে আছে প্লাস্টিক।
আশার কথা হলো, এর অনেক বিকল্পও আমরা তৈরি করতে পেরেছি। বাইরের বিশ্বে একধরনের সিলিকন কাপ ব্যবহার করা হয়, যা পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও স্বাচ্ছন্দে ৭-৮ বছর চলে যায়। এর ব্যবহারও বেশ সোজাই ও অন্যান্য পণ্যের চেয়ে স্বস্তির। আমাদের দেশেও এধরনের কাপ আসা শুরু হয়েছে।
তাছাড়া দেশেই অনেক উদ্যোক্তা পরিবেশবান্ধব ন্যাপকিন তৈরি করছেন।
টিফিন বক্সের চিন্তা
বিদ্যালয় বা অফিসের টিফিনের সময় বহুল প্রচলিত দু’টো নাস্তার পদ্ধতি হল বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসা, অথবা দোকান থেকে কিছু কিনে খাওয়া। দোকানের খাবার খাওয়ার চেয়ে বাসার খাবার খাওয়া স্বাস্থ্য, অর্থ, বা পরিবেশ সবদিক দিয়েই বেশি ভালো। দোকানের প্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ানোর সাথেই পরিবেশে যুক্ত হয় আরও একটি পলিথিন বা প্লাস্টিকের প্যাকেট। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেই এখানে-সেখানে চিপসের প্যাকেট পাওয়া যাবে।
বাসা থেকে আনা খাবার, নিজের রান্না খাবারে প্যাকেটের ঝামেলা নেই। কেউ কেউ এই খাবার বহন করতে স্টিলের বক্স বহন করেন, কেউ প্লাস্টিক। কিন্তু প্লাস্টিকের বক্স কমদামি, বা সহজে নষ্ট হয় না বলে আমরা এগুলো বহন করলেও এগুলোর নির্দিষ্টবার ব্যবহারসীমা আছে। আপনি চাইলেই তার বেশি এটিকে ব্যবহার করতে পারবেননা। এতে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্লাস্টিকে, পলিথিনে বহন করা খাবার খেয়ে ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একারণে স্টিলের মতো ধাতব বক্স বহন করুন।
বাসন-কোসনে সাবধানতা
আজকাল সবজায়গাতেই ‘ওয়ানটাইম’ প্লাস্টিকের বাসন চোখে পড়ে। এই ব্যবহারগুলো পুরোই অপ্রয়োজনীয়, প্রকৃতির জন্য নিজের ভবিষ্যতের জন্য এতটুকু ছাড় আমরা দিতেই পারি। একবার ব্যবহার করার মতো বাসনাদি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে সগর্বে চলে যায় সাগরে। এর খুবই নগণ্য অংশকে পুনর্ব্যবহার করার উপযোগী করে তোলা হয়। নান্দনিক ছোট ছোট কাঠের চামচ কিনতে পাওয়া যায়, যেগুলো খুব সহজেই ব্যাগে বহন করা যায়। নতুন করে কিনতে না চাইলে সহজ সমাধান স্টিলের চামচ তো আছেই। এতে সংক্রামক ব্যাধির সম্ভাবনাও কমবে, প্রকৃতিও বাঁচবে।
আপনি জানেন কি, পৃথিবীতে যত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্ধেকই হয়েছে গত দশকে? প্লাস্টিকের উৎপাদন দ্বিগুণ হবে ২০৫০ সালে। প্লাস্টিক প্রকৃতিতে টিকে থাকবে অন্তত ৪০০-৫০০ বছর ধরে। সমুদ্রের নির্জন কোনো দ্বীপে গেলে কূল ছেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য চোখে পড়ে। মহাসাগরে প্লাস্টিকেরা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের বিশাল বিশাল দ্বীপ। এখনই আমাদের পৃথিবী পলিথিন-প্লাস্টিকে ছেয়ে গেছে। এরপরেও আমরা যদি সচেতন না হই, রোজকার জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার না কমাই তাহলে, সেদিন দূরে নয় যেদিন আমাদের বসবাসের স্থান হবে পৃথিবী নয়, প্লাস্টিক!