আহমদ ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ উপন্যাসের দুরদানা বেগমের কথা মনে আছে? ঢাকার নাখালপাড়ার এক মহল্লা থেকে প্যান্ট-শার্ট পরা একটা মেয়ে দ্বি-চক্রযান নিজে চালিয়ে ধীরে ধীরে চলে আসতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। আশেপাশে অবস্থানরত যারাই দেখতো এই দৃশ্য, তাদেরই চক্ষু চড়ক! অনেকে বিশ্বাসই করতে পারতেন না, তার চোখের সামনে তিনি কী দেখছেন। যেহেতু একজন মেয়ে হয়ে তিনি সকলের নাকের ডগা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে সমগ্র শহর ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একথা ধরে নেয়া খুবই স্বাভাবিক যে দুরদানা বেগম তখন ছিলেন ‘টক অব দ্য টাউন’। এখনকার সময়ে মেয়েরা সাইকেল চালাচ্ছে, এই ধারণাটি খুবই সাধারণ হলেও একসময় তা মোটেই সাধারণ ছিল না। প্রথম যখন কোনো নারী সাইকেল চালানো শুরু করেন, তখন আশেপাশে জনসাধারণের অবস্থা কেমন ছিল, তা জানতে হবে আমাদের যেতে হবে প্রায় ১২৬ বছর পেছনে।
নারী মুক্তির পথে সাইক্লিং
অ্যাঞ্জেলিন অ্যালেন নামক এক নারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে ১৮৯৩ সালে সর্বপ্রথম প্যান্ট পরে করে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান। শুধুমাত্র প্যান্ট পরিধানের কারণে তা সকলের চক্ষুগোচর হয়। এতদিন মানুষের বাঁধাধরা একটি ধারণা ছিল যে পোশাকেরও লিঙ্গ রয়েছে। তবে অ্যাঞ্জেলিন অ্যালেন সে বৈষম্য ভাঙার পথের অন্যতম প্রধান অগ্রগামী হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন সুন্দরী এবং তরুণী, তাই তার প্রতি আগ্রহেরও কমতি ছিল না মানুষের। তৎকালীন একটি ম্যাগাজিন তার সম্পর্কে শিরোনাম করেছিল ‘সে প্যান্ট পরেছে’! ম্যাগাজিনের শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, হঠাৎ এক নারীর সাইক্লিং কী পরিমাণ আলোচনার ঝড় তুলেছিল তৎকালীন সমাজে!
সে সময়কার রক্ষণশীলরাও গেলো গেলো বলে রব তুলেছিল! তাদের ধারণা ছিল, মেয়েরা এভাবে প্যান্ট পরে সাইকেল চালালে সমাজের নৈতিক অধঃপতন ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল তার উল্টোটা। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় মেয়েরা সাইক্লিংয়ের প্রতি আগ্রহী হতে শুরু করে।
সে ঘটনার তিন বছর পর একজন নারীবাদী নেত্রী নারী মুক্তির পক্ষে সাইক্লিং অন্যতম বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে বলে ঘোষণা দেন। বাস্তবিক অর্থেই সাইক্লিং করতে গিয়েই নারীরা সর্বপ্রথম ভারি পোশাক বর্জন করার সুযোগ পায়। বর্তমান বাংলাদেশেও কোনো নারীকে সাইক্লিং করতে দেখলে সহজেই মানুষ সে নারীর আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যান। তাই সাইক্লিং নিঃসন্দেহে নারী মুক্তির পথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত করেছিল বলে মনে করতেন তৎকালীন নারী মুক্তির আন্দোলনকারীরা।
বিগত ২০০৬ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিহার রাজ্যে মেয়েদের সাইকেল কেনার জন্য ভর্তুকী দেয়, যাতে করে দূরের স্কুলগুলোতে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে উপস্থিত হতে পারে। নতুবা দেখা যেতো, অনেকেই স্কুল দূরে হবার কারণে ভর্তিই হতো না অথবা ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে পারতো না। তাছাড়া সেখানে অন্য যানবাহন চলাচলের খুব বেশি সুবিধা আছে, এমন কোনো খবরও পাওয়া যায় না।
রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ নেয়ার ফলাফল পাওয়া গেলো রাতারাতি। দেখা গেল মেয়েদের সাইকেল কেনায় ভর্তুকী দেয়ার ফলে মেয়েদের স্কুলে অংশগ্রহণের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়ে যায় এবং যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যাবার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেলো। অত্যন্ত সাধারণ একটি বাহন কীভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে বিহার রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ।
সাইক্লিং করে বিশ্বভ্রমণ করা প্রথম নারী
একটি সাধারণ বাজির মাধ্যমে তার এই দুঃসাহসিক অভিযানটি শুরু হয়েছিল। ১৮৯৪ সালে বোস্টন শহরের দুই ধনাঢ্য ব্যক্তি এই মর্মে বাজি ধরেন যে, একজন নারীর পক্ষে একজন পুরুষের মতো সাইকেলে করে সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করা সম্ভব না। এই বাজির পক্ষে বিপক্ষে তারা ১০,০০/২০,০০০ ডলার বাজিও ধরেছিলেন। এমন বাজি ধরার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে- ১৮৮৭ সালে একজন পুরুষ এই কাজ সম্পন্ন করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, একজন পুরুষ যা করতে পারে, একজন নারী তার সবকিছু করতে পারে না এই ইস্যুতেই সেই দুই ভদ্রলোক আলাপ করছিলেন হয়তো।
অ্যানি কোহেন কপচোভস্কি নামক এক নারীকে এই কাজের জন্য নির্বাচন করা হয়। তিনি কীভাবে নির্বাচিত হলেন, তা অবশ্য জানা যায়নি। শুধুমাত্র বিশ্বভ্রমণ করলেই হবে না, সাথে কিছু শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছিলো এ কাজের সাথে। প্রধান শর্তগুলো ছিল–
- তিনি একদম খালি পকেটে এই যাত্রা শুরু করবেন
- যাত্রাপথে তার পাঁচ হাজার ডলার আয় করতে হবে
- ১৫ মাসের মধ্যে এই ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসতে হবে।
এসকল শর্ত পূরণ হলেই কেবল অ্যানি কপচোভস্কি বিজয়ী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যথায় তাকে পরাজিত হিসেবে গণ্য করা হবে। তার অর্থ আয়ের সকল তথ্যও যাত্রা শুরুর প্রথমদিক থেকেই নজরদারির মধ্যে রাখা হয়।
মজার ব্যাপার হলো, এই ভ্রমণ শুরু করার আগে কখনোই সাইকেল চালাননি তিনি। প্রথমবার তিনি সাইকেল চালিয়েছেন, তার যাত্রা শুরুর ঠিক একদিন আগে। সে সময় নারীদের স্বাধীনতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ছিল সাইকেল চালানো। সাইক্লিং করা কোনো নারী দেখলেই তৎকালীন মানুষেরা তাকে অবশ্যই স্বাধীনতাকামী হিসেবেই ধরে নিতো। হয়তো এসব কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েই রাজি হয়েছিলেন অ্যানি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জননী। তার বড় সন্তানের বয়স তখন ছয় বছরও হয়নি এমন এক সময়েই বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে কলম্বিয়ার ৪২ পাউন্ড ওজনের নারীদের সাইকেলে লম্বা স্কার্ট পরে প্যাডেল মারতে শুরু করেন তিনি। দিনক্ষণের হিসেবে তখন ছিল ১৮৯৪ সালের জুন মাসের ২৭ তারিখ।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহর থেকে শুরু করে যাত্রা করেন অ্যানি। যাত্রা শুরুর আগেই লন্ডনডেরী নামক এক পানির কোম্পানি তাকে ১০০ ডলার দেয় বিনিময়ে অ্যানি তার নামের সাথে মিলিয়ে অ্যানি লন্ডনডারী লেখা একটি প্ল্যাকার্ড বহন করতে রাজি হন। তখন থেকেই তার নাম হয় অ্যানি লন্ডনডারী।
শুরুর দিকে প্রতিদিন প্রায় আট থেকে দশ মাইল সাইকেল চালাতে সমর্থ হন অ্যানি। এভাবে শিকাগো শহরে পৌঁছাতেই ২৪ সেপ্টেম্বর হয়ে যায়। শিকাগো গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, এভাবে সাইকেল চালিয়ে সম্পূর্ণ ভ্রমণ সম্ভব না। তাই নিজের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনেন তিনি। ৪২ পাউন্ডের সাইকেল বদলিয়ে ২১ পাউন্ডের ছেলেদের সাইকেল নেন তিনি যেখানে একটি গিয়ারের সাথে ছিল না কোনো ধরনের ব্রেক। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে এভাবে লম্বা স্কার্ট পরে তিনি সমগ্র ভ্রমণ পরিচালনা করতে পারবেন না, তাই পোশাকেও আনেন ব্যাপক পরিবর্তন। প্রায় অনেকটা ছেলেদের সাইক্লিং স্যুট পরেই বাকি ভ্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন অ্যানি।
ইতোমধ্যেই শীতকাল চলে আসায় অ্যানিকে তার রুট পরিবর্তন করতে হয়। শিকাগো থেকে নিউইয়র্ক ফিরে এসে তিনি যাত্রা করেন ফ্রান্সের উদ্দেশে। প্রায় একমাসের যাত্রায় ফ্রান্সে পৌঁছে যান। তবে ফ্রান্সে গিয়ে তিনি বেশ কিছু ঝামেলায় পড়েন। প্রথমেই ফ্রান্সের কাস্টমস অফিসাররা তার সাইকেল আটকিয়ে রাখে, পরবর্তীতে তার সাথে থাকা টাকা-পয়সা চুরি হয়ে যায়। এমনকি ফ্রান্সের কিছু পত্রিকা তার বিরুদ্ধে নানান কুৎসা রটাতে থাকে। কোনো একভাবে তিনি এসকল সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটান এবং প্যারিস থেকে মারসিলিসে আসেন দুই সপ্তাহ টানা সাইক্লিং করে। পথিমধ্যে তার একটি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
মারসিলিস থেকে সিডনি নামক নৌযানে তিনি রওনা দেন পরবর্তী গন্তব্যস্থলে। যাত্রাপথে তিনি ভ্রমণ করেন আলেকজান্দ্রিয়া, কলম্বো, সিঙ্গাপুর, হংকং, নাগাসাকিসহ আরও বেশ কয়েকটি শহর। প্রতিটা শহরেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতের নিকট হতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন প্রমাণস্বরূপ। এভাবে সর্বশেষ তিনি জাপান থেকে সানফ্রান্সিস্কোর উদ্দেশে যাত্রা করেন মার্চের ৯ তারিখ। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সবক’টি শহর ঘুরে তিনি বোস্টন ফিরে আসেন ২৪ সেপ্টেম্বর। ১৫ মাস শেষ হবার আগেই বিশ্বভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসেন অ্যানি লন্ডনডারী। এবং এভাবেই বিশ্বের প্রথম নারী হিসেবে সাইকেলে পৃথিবী ভ্রমণের ইতিহাস গড়েন তিনি।
সাইকেলে ভ্রমণ করে বিশ্বজয় কিংবা প্রচলিত বাঁধাধরা ধারণা ভেঙে নারীরা হয়তো তাদের সম্পূর্ণ মুক্তি অর্জন করেনি তবে সাইকেল চালানো কিংবা সাইকেলে ভ্রমণ করে বিশ্বজয় নিঃসন্দেহে নারী মুক্তির পথকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।