তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পিটিশন বা আবেদন করা আগের তুলনায় সহজ হয়ে গেছে অনেকটা। নির্দিষ্ট কোনো স্থানে গিয়ে, পুরো এক বিকেল সময় কাটিয়ে লাইন ধরে, নাম-ঠিকানা লিখে স্বাক্ষর করার এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। ঘরে বসে মাত্র এক মিনিটেই নাম, ইমেইল আইডি এবং ফোন নাম্বার (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐচ্ছিক) দিয়ে সাইন ইন করার মধ্য দিয়ে খুব সহজেই আপনি অনলাইন পিটিশনে অংশ নিতে পারেন। প্রায় প্রতিদিনই ইন্টারনেটে বিভিন্ন পিটিশন সাইটে এরকম হাজার হাজার পিটিশন চালু হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি এই পিটিশনগুলোর ফলাফল কোনো কাজে আসে?
এই প্রশ্নের উত্তর আসলে এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। অনলাইন পিটিশনের সাফল্য অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে অনেকেই যেরকম মনে করে থাকেন, পিটিশনের মাধ্যমে ২০ বা ৩০ হাজার, কিংবা ১ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিলেই তারা সেটাকে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করবেন, ব্যাপারটা সব ক্ষেত্রে সেরকম না। এর একটা সহজ কারণও আছে। বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই এখনো অনলাইন অ্যাকটিভিজমকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। তাছাড়া অনলাইনের মাধ্যমে যেহেতু একই ব্যক্তি একাধিক ইমেইল ব্যবহার করে একাধিকবার ভোট দিতে পারে, কিংবা দাবির সাথে কোনো সম্পর্ক নাই এরকম ব্যক্তিও অন্যের অনুরোধে ভোট দিতে পারে, সে কারণেও অনলাইন স্বাক্ষরকে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
কিছু কিছু উন্নত রাষ্ট্রে অবশ্য সরকারি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইন পিটিশনের আয়োজন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেকোনো নাগরিক হোয়াইট হাউজের উই দ্য পিপল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অনুমোদিত বিষয়ে পিটিশন চালু করার অধিকার রাখেন। কোনো পিটিশন চালু করার পর যদি পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে ১৫০টি স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে সেটি হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটের সার্চ ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর যদি পিটিশনটি ৩০ দিনের মধ্যে ১ লাখ সিগনেচার সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে পিটিশনটির ব্যাপারে একটি জবাব দেওয়া হয়। সে জবাব সে ভোটের পক্ষেই যাবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তারপরেও এর মাধ্যমে অন্তত এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সরাসরি প্রেসিডেন্টের নজরে না পড়লেও ১ লাখ মানুষের আবেদনটি হোয়াইট হাউজের কোনো একজন কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
যুক্তরাজ্যেও অনলাইন পিটিশনে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। সেখানে যেকোনো নাগরিক যুক্তরাজ্যের সরকারি পিটিশন সাইটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অনুমোদিত বিষয়ে পিটিশন চালু করার অধিকার রাখেন। ১০ হাজার ভোট সংগ্রহ করতে পারলে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে পিটিশনটির উত্তর দেওয়া হয়। আর ১ লাখ ভোট পেলে সেটিকে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বিতর্কেযোগ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, এ বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাজ্য সফর বাতিল করার জন্য চালু করা পিটিশনটিতে সে সময়ে স্বাক্ষর করেছিল প্রায় পৌনে ছয় লাখ ব্রিটিশ নাগরিক। ফলে জানুয়ারির ১৮ তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ বিষয়ে বিতর্কের আয়োজন করা হয়, কিন্তু শেষপর্যন্ত অনলাইন আবেদনকারীদের দাবি নাকচ হয়ে যায়।
অনলাইন পিটিশন অনেকটা বাস্তবের প্রচারণার মতোই, কিন্তু কার্যকারিতা একটু কম। নিউস্টেটস-এর এক অনুসন্ধান অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বেশি ভোট পাওয়া ১০টি পিটিশনের একটির আবেদনও পার্লামেন্টে পাশ হয়নি। এরমধ্যে ১ লাখের বেশি ভোট পাওয়া সত্ত্বেও দুটি বিষয়ের উপর কোনো বিতর্কের আয়োজনই করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্রে তাও নাগরিকদেরকে পিটিশন দাখিল করার সুযোগ দেওয়া হয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সেটিও দেওয়া হয় না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো বটেই, এমনকি কানাডাতেও কেবলমাত্র কুইবেক এবং নর্থওয়েস্ট টেরিটোরিজ প্রদেশ দুটো ছাড়া অন্য কোনো প্রদেশে অনলাইন পিটিশনের ফলাফল গ্রহণ করা হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারও কাগজে-কলমে সত্যিকার স্বাক্ষর না থাকলে তা গ্রহণ করে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যেও যে অনলাইন পিটিশনের ফলাফল গ্রহণ করা হয়, তাও কেবলমাত্র নিজেদের ওয়েবসাইট থেকে। কারণ সেখানে তারা একই ব্যক্তির একাধিক আইডি থেকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য বেসরকারি এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত জনপ্রিয় পিটিশন সাইট, চেঞ্জ ডট অর্গ-এ এ ধরনের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অর্থাৎ এরকম সম্ভাবনা খুবই কম যে, চেঞ্জ বা এ জাতীয় অন্য কোনো অনলাইন পিটিশন সাইটের কোনো একটি আবেদনে কয়েক লক্ষ মানুষ ভোট দিল, এবং এরপর তার ফলাফল যথাযথ কর্তৃপক্ষ, হোক সেটা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠন, তাদের কাছে পাঠালে তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
চেঞ্জ অবশ্য দাবি করে, তাদের প্রচুর সফলতা আছে। প্রতিদিনই তাদের অনেকগুলো দাবি বিশ্বে পরিবর্তন আনছে। কিছু ক্ষেত্রে যে আসলেই সফলতা আসছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। যথেষ্ট সাড়া পড়লে এবং কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে এমনটা হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সাফল্যের পেছনে পিটিশনের পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রম, যেমন মিছিল-মিটিং, সরাসরি বিতর্ক, এগুলোরও যথেষ্ট অবদান থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে কোনো রাষ্ট্র কিংবা কর্তৃপক্ষ নিজেদের নীতি বা আদর্শের বিরুদ্ধে রাস্তায় জড়ো হওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রতিবাদ মিছিলকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করে, কিংবা জোরপূর্বক দমন করে, সেখানে শুধু অনলাইন স্বাক্ষরকে তারা কতটুকু গুরুত্ব দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
অন্যদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেঞ্জের দাবির সত্যতা প্রমাণেরও কোনো উপায় নেই। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি চেঞ্জে গিয়ে Bangladesh লিখে সার্চ দেন, তাহলে প্রথমেই দেখতে পাবেন শিশু শ্রম বন্ধের একটি আবেদন, যা চালু করা হয়েছিল কানাডার সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য, যেন তারা বড় কোম্পানীগুলোকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করে। আবেদনটিতে সাড়া দিয়েছেন ১৯,১৪৫ জন ব্যক্তি, এবং এটিকে একটি সফল আয়োজন হিসেবে উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছে, এটি পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ বা সংবাদের লিংক দেওয়া নেই। তাছাড়া উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানি, কানাডা এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অনলাইন পিটিশন গ্রহণ করে না। ফলে চেঞ্চের দাবিগুলোর অনেকগুলোই ভিত্তিহীন কিংবা আংশিক সত্য হতে পারে।
তবে সরাসরি দাবি আদায় না হলেও চেঞ্জ বা এ ধরনের অনলাইন পিটিশনগুলোর গুরুত্ব কিন্তু কম না। এ ধরনের উদ্যোগের প্রধান অর্জন হল, এগুলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে, সমাজে আলোচনার জন্ম দেয়, এবং যথেষ্ট সাড়া পেলে সে আলোচনা গণমাধ্যম পর্যন্ত উঠে আসার সুযোগ তৈরি করে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এবং প্রত্যক্ষভাবে যদি কোনো ফলাফল পাওয়া নাও যায়, দীর্ঘমেয়াদে এবং পরোক্ষভাবে সমাজে এগুলোর কিছু প্রভাব থাকেই। এছাড়াও এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ভোটদাতাদের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়, যেখানে তাদের নাম, ইমেইল আইডি এবং ফোন নাম্বার সংরক্ষিত থাকে। ফলে ভবিষ্যতে অনলাইন থেকে বের হয়ে যদি বাস্তব জগতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, যেমন মিছিলের আয়োজন কিংবা অর্থ সংগ্রহ করা, সেক্ষেত্রে তাদেরকে সহজেই অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানোর সুযোগ থাকে।
এতে অবশ্য কিছুটা ঝুঁকিও থাকে। অনেক সময় কোনো প্রতিষ্ঠান বিপরীত উদ্দেশ্যেও কোনো পিটিশনের আয়োজন করতে পারে। তারা হয়তো এর ফলাফল কারো কাছে পেশ করবে না, কিংবা এর পক্ষে বাস্তবে কোনো প্রচার-প্রচারণাও চালাবে না, কিন্তু আগ্রহীদের নাম, ইমেইল এবং ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে রাখবে। এবং পরবর্তীতে তাদের এই তথ্যগুলো ব্যবহার করে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করবে তাদের মতামত এবং আদর্শিক অবস্থানকে প্রভাবিত করার জন্য। এটা অনেকটাই ফেসবুকের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ক্যালেঙ্কারির মতো, যেখানে ব্যবহারকারীদের লাইক, কমেন্ট গবেষণা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের উপর তৈরি প্রোফাইল অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন প্রদার্শন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে পর্যন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
যেকোনো পিটিশনে সাইন করার আগে তাই কিছুটা অনুসন্ধান করার অভ্যাস তৈরি করা ভালো- কী উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, কারা তৈরি করেছে, প্রাপ্ত ফলাফল কী করা হবে, ইত্যাদি। সব সন্তোষজনক হলে পিটিশনে সাইন করায় লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। তবে শুধুমাত্র অনলাইন পিটিশনে সাইন করে পরিবর্তনের আশায় বসে থাকা যথেষ্ট না। পিটিশন হতে পারে বৃহত্তর প্রচার-প্রচারণা এবং আন্দোলনের একটি প্রাথমিক ধাপ। সুপরিকল্পনা এবং সমন্বিত পদক্ষেপই এনে দিতে পারে কাঙ্খিত পরিবর্তন।
ফিচার ইমেজ- bauhinia.org